লিফট থেকে নেমে করিডোরে পা রাখতেই চোখ দুটো চলে গেল সোজা কন্সিয়ার্জ ডেস্কে মিস ইনার খোঁজে! কিন্তু হা হতোম্মি! ওখানে এখন খাঁ খাঁ শূন্যতা! সাথে সাথেই মনে হল রাতের এই দ্বিতীয় প্রহরের মাঝামাঝি সময়েরও শেষ দিকে এসে কন্সিয়ার্জ ডেস্কের ব্যস্ততা থাকার কথা নয়। তারপরও নিয়ম মেনে এ সময়েও ডেস্কটি জায়গামতো মজুদ থাকলেও ডেস্কের লোকজন হয়তো একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, কিম্বা গুলতাপ্পি মারছে ডেস্ক ছেড়ে অন্য কোথাও। আচ্ছা পাঁচ তারকা হোটেলের কন্সিয়ার্জ সার্ভিস ২৪ ঘণ্টাই সচল থাকে না কি?
না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। আজ পর্যন্ত পেশাগত কারণে নানান ভ্রমণে এ জাতের নানান হোটেলে নানান জায়গায় নানান সময়ে রাতে বিরাতে চেক ইন চেক আউট করতে হলেও, ঐরকম সময়ে কন্সিয়ার্জ ডেস্কের সহায়তা নিতে হয়েছে এমনটা তো হয়নি। অতএব এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতাপ্রসূত কোনো জ্ঞানই সঞ্চিত নাই অধমের ভাণ্ডারে। অতএব এরকম একটি অকিঞ্চিৎকর বিষয় নিয়ে এ রাতে মাথা না ঘামালেও চলবে। তার চেয়ে বরং হাতের এই আবর্জনাপোটলা বাইরের কোনো ডাস্টবিনে ফেলে ফেরার পথে খবর নিতে হবে মিস ইনার। অতীব জরুরি বিষয় সেটাই। এসব ভাবতে ভাবতে হোটেলর মুখের স্বয়ংক্রিয় ঘূর্ণায়মান দরজায় ঢুকে তার সাথে ঘুরে হোটেলের ওম ওম গরম ছেড়ে রাখলাম পা ফের বেইজিঙয়ের হিমসাগরে! এরি মধ্যে এ ক’দিনের আমাদের এই অস্থায়ী আবাসের আশপাশটা যে রকম চেনা হয়ে গেছে, তাতে মনে পড়ছে না যে দেখেছি কোনো ডাস্টবিন আশেপাশে। তবে হ্যাঁ গেটের বাঁয়ে আর ডানে দু দিকেই আছে ধূমপায়ীদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান, যেখানে রাখা কোমর সমান উঁচু ছাইদানি। ঐ দুটোর যে কোনটিরই পেটে অনায়াসে চালান করে দেয়া যাবে এই আবর্জনাপোটলা।
স্বয়ংক্রিয় ঐ ঘূর্ণায়মান দরজার ডান দিকে দিয়েই যেহেতু বেরিয়েছি, তাই সাথে সাথেই চোখে পড়লো বেইজিঙয়ের রাতের তীব্র হিমেও একাকী সটান বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকা ডানের ছাইদানি কাম ডাস্টবিনটা। দ্রুত কাজ সারার জন্য যেতেই পারি ঐদিকে। এই হিমে বাইরে বেশিক্ষণ থাকার মানে নাই। ঐদিকে দু পা এগুলেই দ্রুত কাজ সেরে সেঁধিয়ে যেতে পারি ফের করিডোরের ওম ওম আরামে। কিন্তু তারপরও এক মিছে আশায় দু তিন পা সামনে এগিয়ে তাকালাম বাঁ দিকের ছাইদানিটার দিকে। মনে বড় আশা; যদি দেখা যায় ওখানে কেউ করছে সেবন এখন ধুম্রশলাকা, তবে লজ্জার মাথা খেয়ে হলেও জীবনে প্রথমবারের মতো এই চায়নায় এসেই না হয় তার কাছে একটা সিগারেট চাইব সমপ্রদান কারকে।
না, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়, কথাটা তো এমনি এমনি তৈরি করেননি আমাদের গুরুজনেরা। তদুপরি এ বিড়ালের কপালে এ যাবতকালে কোনো শিকেই ছিড়েনি যখন ছিঁড়ল না তা এবারেও। ফলে ব্যর্থমনোরথে দ্রুত ডানে গিয়ে আবর্জনা মুক্ত হয়ে হোটেলের পেটে ঢুকে গিয়ে দিলাম হাজিরা শূন্য ঐ কন্সিয়ার্জ কাউন্টারে।
ভেবেছিলাম কাউন্টারের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে, কেউ না কেউ আসবেই এগিয়ে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণের অপেক্ষার পরও তা না হওয়ায় ভাবছি যখন, এ রাতে কী বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় অন্য কোথাও গুলতাপ্পিতে ব্যস্ত থাকা এই কাউন্টারের কর্মীকে, তখনই নজরে পড়লো এই ডিজিটাল জমানায়ও কাউন্টারের এক কোণায় চুপচাপ বুক চিতিয়ে শুয়ে থাকা সাবেকি আমলের কলিং বেলটি। চকচকে স্টিলের সেই কলিং বেলটি নজরে পড়তেই দ্রুত সেটির মাথায় কয়েকটি চাটি মারতেই টুং টাং শব্দ তুলে সেটি আর্তনাদ করে উঠতেই, ডান পাশের একটা বন্ধ দরজা ভেতর থেকে ঠেলে এক হোটেল কর্মী বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই, বললাম মিস ইনাকে দরকার আমার।
এতরাতে এভাবে সরাসরি মিস ইনাকেই আমার দরকার বলাতে এ তরুণ সন্ধিগ্ন হল নাকি ভির্মি খেল বুঝতে পারলাম না তার চায়নিজ ব্র্যান্ডের চোখ বা মুখ দেখে। তবে কিছু যে একটা হয়েছে তার তা বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার নির্বাক তার চাহনি দেখে। তবে অচিরেই একটু দম নিয়ে চিংলিশে সে যা জানান দিল তাতে বুঝলাম, মিস ইনার মিলবে না দেখা আগামীকালকের সকাল ৮ টার আগে!
আরে বলে কী? হবে কী এখন তাহলে? আমরা তো খুব দেরী করলেও সাড়ে ছটায় রওয়ানা করবো এয়ারপোটের্র উদ্দেশ্যে। সে মতোই যাতে আমাদের শোফার লি খাঁ হাজিরা নিশ্চিত করার জন্যইতো খুঁজছি মিস ইনাকে। আচ্ছা, জিজ্ঞেস করবো নাকি একে ব্যাপারটা? কন্সিয়ার্জ রেজিস্টারে আমার দেয়া বুকিংটা ঠিকঠাক মতো নোট করা আছে কি না? যদি থাকে তা, তবে একেই তো সেটা রিকনফার্ম করে যেতে পারি। তা হলেই তো হয়।
নাহ, তা আর না করি। কে জানে মিস ইনা যেহেতু তার ভাইয়ের গাড়িই বুক করেছে সেই প্রথম দিন থেকেই আমাদের জন্য, তাই হয়তো এই ব্যাপারটা হোটেলের রেজিস্টারে তুলেইনি। সে রকম কিছু হয়ে হোটেলের আইনে এরকম ব্যাপার তো গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয় অবশ্যই। অবশ্য বোনদের কাছে নিজ নিজ ভাইদের জন্য যে আইন বই আছে তার কাছে এসব হোটেলের আইনতো অতি সামান্য ব্যাপার। পৃথিবীর তাবৎ আইনই তো বেঘোরে মার খেয়ে যায় ভগ্নিদের হাতে থাকা ভ্রাতাবিষয়ক আইনের কাছে। অতএব আগামী কাল গাড়ি নিয় লি খাঁ ঠিক সময়ে আসবে কি না তা নিয়ে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেও, কথা আর না বাড়িয়ে সামনে মজুদ কিছুটা বিভ্রান্ত কন্সিয়ার্জম্যানকে শুভরাত্রি জানিয়ে ধরলাম হাঁটা লিফটের দিকে।
লিফটের সাথে উর্ধগামি হতে হতে, অনেকটা জোরজার করে মনের উত্তেজনা কিছুটা প্রশমন করতেই মনে হল, আচ্ছা এ আমার কেমন ভাবনা? শুধু মিস ইনা কেন, এই হোটেলের সবাই তো কাজ করে ডিউটি রোস্টার মেনে। অতএব কারোই উপস্থিতি যে এখানে, সার্বক্ষণিকের নয় এ তো জানা কথা। তারপরও করলাম কেন মনে ধরে আছি আমি ভুল এই আশা?
এরই মধ্যে লিফট জায়গা মতো পৌঁছে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই বাইরে পা রাখতে রাখতে নিজের নিতান্তই এই বালখিল্য চাওয়াটি নিয়ে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালাম মনে মনে, যা হলো ; মানুষ যখন কারো উপর খুব বেশি নির্ভর করতে শুরু করে, তখন হয়তো অবচেতন মনেই সে তার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি কামনা করে।
‘এই শোন, এই শাল দুটো দিয়ে আসো তো ঐ রুমে হেলেনের কাছে। এ গুলো ওর।’
কপাল ভাল আমার যে রুমে ঢুকতেই স্ত্রীআজ্ঞা ঠিক সময়ে কানে গেছে, আর তাতেই সময়মতো মিস ইনা পালালেন লেজ তুলে! কাচুমাচু করে দ্রুত তাই এগিয়ে দেয়া শাল দুটো হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে স্ত্রীর চোখের আড়াল হতেই ফিরে এল ফের মিস ইনা ভাবনা! ভাবছি এবার, আচ্ছা মিস ইনার ফোন নম্বর তো আছে আমার কাছে। এখন ইচ্ছা করলে তো তাকে ফোন করেও বলে দিতে পারি, লি খাঁ যাতে ঠিক সময়ে আসেন!
কিন্তু নাহ সাথে সাথেই এই চিন্তাও বাতিল করে দিলাম নিজের জন্য নিজে করা আরেকটি নিয়মের কথা মনে পড়তেই। বেশ অনেকদিন ধরেই পেশাগতভাবে এই নিয়মটি কঠোরভাবে মেনে আসছি আমি নিজ থেকেই। সে নিয়মটি হল কোনো নারী সহকর্মী বা যে কোনো নারী পেশাদারকে তার অফিস সময়ের বাইরে কখনোই ফোন করি না, কোনো অবস্থাতেই। কারণ আমাদের দেশ বা সমাজ ছাড়াও শ্রীলংকাতেও দেখেছি পেশাজীবী মেয়েদের নিজ নিজ পেশাগত দায়িত্ব পালনের সাথে, ঘরও সামলাতে হয় একই রকম নয় শুধু অনেক সময় এমন কি তারচেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে। না হয় তাদের সংসারসমুদ্রে যে কোনো সময় জন্ম নিতে পারে তুমুল বিধংসী ক্ষমতার সাইক্লোন টাইফুন। ঠিক একই রকম ব্যাপার তো হতে পারে চায়নার নারীদের ক্ষেত্রেও। অতএব শিকেয় তোলা থাক এ রাতে মিস ইনাকে ফোন করার ভাবনা।
তদুপরি কথা হচ্ছে, এখানে আসার পর যে দুদিন লি খাঁর সার্ভিস পেয়েছি তাতে তো তার সময়ানুবর্তিতা নিয়ে সন্দেহ করার মোটেও কোনো কারণ দেখছি না! আর সে যদি না ই আসে সময়মতো কাল সকালে, তবে তখনি না হয় মিস ইনা কে করা যাবে। নাহ, সেই ঝামেলাও করার কী দরকার, তারচেয়ে বরং সে সময় কন্সিয়ার্জ ডেস্কে যে থাকবে, তাকে বলেও তো কোনো না কোনো গাড়ির ব্যবস্থা করা যাবে। লি খাঁর গাড়িতেই যেতে হবে আমাদের এমন তো কোনো দিব্যি দেয়নি কেউ আমাদের! আপাতত এ নিয়ে চিন্তা থাকুক বাদ একদম। এসব ভাবতে ভাবতে এ রুমের দরজার বেল চাপলাম।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দরজা খুলতে খুলতে বলল হেলেন
‘সরি দাদা, সুটকেস গোছাচ্ছিলাম’
জবাবে কিছু না বলে, ওর হাতে শাল দুটো তুলে দিয়ে ওকে পাশ কাটিয়ে ঢুকলাম রুম, দীপ্রর কী করছে তা জরীপ করার জন্য। ‘আচ্ছা এগুলি এখনি আমার কাছে পাঠানোর কী দরকার ছিল? ঢাকায় গিয়েই তো নিতে পারতাম! নাকি আমার এ শাল দুটোর জায়গা হচ্ছিল না ভাবীর ব্যাগে?’ রুমে ঢুকতে ঢুকতে পেছন থেকে এসব কথা কানে এসে ঢুকলেও, সাথে সাথেই তা বের করে দিলাম দ্রুত অন্য কান দিয়ে। সংসারে ননদ ভাবীর মধ্যে এ ধরনের অতীব গুরুতর কারণেই দেখেছি শুরু হয় তুলকালাম দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ যার মাঝখানে পড়ে বিবাহিত পুরুষ প্রবরদের হয় প্রাণ ওষ্ঠাগত। ভ্রমণের এই শেষ পর্যায়ে এসে ঐ রকম কোনো অবস্থার মুখে পড়তে চাই না।
রুমে ঢুকে এরইমধ্যে স্বভাবগত হৈ হুল্লোড় আর ল্মফঝম্প বাদ দিয়ে দীপ্রকে গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে প্রমাদ গুনলাম মনে মনে। ভ্রমণের এই এক্কেবারে শেষদিকে এসে অবশেষে পুত্র কি আমার অসুস্থ হয়ে পড়লো না কি? দ্রুতপায়ে বিছানার ওপাশে গিয়ে ওরা কপালে হাত দিতেই, পিটপিট করে চোখ খুলে বলল ও ‘খুব ঘুম পাচ্ছে বাবা! টায়ার্ড লাগছে।’
লেখক: কলামিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।