শুনেছি শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। যে মেরুদণ্ড না থাকলে কোনো মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে বসতে বা হাঁটতে পারে না। শিক্ষা পদ্ধতি এমন হওয়া উচিত যার বদৌলতে শিক্ষার্থীর মানসিক ইতিবাচক পরিবর্তন এবং বাস্তব সংসারে তার প্রয়োগ ও সুপ্রভাব পরিলক্ষিত হবে।
আমাদের সমাজ পরিবর্তনশীল। তার সাথে সাথে সব কিছুর পরিবর্তন আমাদের কাম্য। কিন্তু সেই পরিবর্তনের জোয়ারে যদি আমাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ভেসে যায় তাহলে কী লাভ এই পরিবর্তনের? নিশ্চয়ই শিক্ষানুরাগী কিংবা জ্ঞানপিপাসু কোনো মানুষের পক্ষে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা সফলতা বিফলতা এসব বিষয়ে না হয় পরেই আসছি। তার আগে গত জুন মাসে ঘটে যাওয়া ষান্মাসিক পরীক্ষা অর্থাৎ ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির পরীক্ষা ও তার প্রভাব সম্পর্কে বলছি।
মাত্র দুই মাস আগে দেশের সমস্ত সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি স্কুলে অনুষ্ঠিত হয় ষান্মাসিক পরীক্ষা। পরীক্ষার তারিখ রুটিন এবং প্রশ্নপত্রের ধরন প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই একই রকম ছিল। কেউ কেউ এই পরীক্ষা পদ্ধতিকে ‘মূল্যায়ন উৎসব’ নামেও প্রকাশ করে। গোলাপকে যে নামেই ডাকুক না কেন সে সুগন্ধ ছড়াবেই। নাম যাই হোক না কেনো শিক্ষার্থীরা যথারীতি এই বই অনুসরণ করেই প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ওদের এতদিনের ছয় মাসের লব্ধ যে জ্ঞান যে প্রস্তুতি যে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা তার কোনো কিছুর নাম গন্ধ মাত্র ওই প্রশ্নপত্রে ছিল না। এমনকি গণিত পরীক্ষার দিন গণিত পরীক্ষার প্রশ্ন পেয়ে শিক্ষার্থীরা হতভম্ব। প্রশ্নপত্র দেখে আশ্চর্য হতে হয় শিক্ষার্থীদের। এটা কি গণিত প্রশ্ন না অন্য কিছু! তেমন কোনো গাণিতিক প্রশ্ন ছিল না সেই প্রশ্নে। অনেকটা বিজ্ঞান বা বিসিএস প্রশ্নের মতোই। এভাবে ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন নতুন নতুন পরীক্ষার পরিবর্তিত স্বাদের অভিজ্ঞতা লাভ করতে থাকে শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি ঘরে ঘরে অভিভাবকদের কপাল যায় কুঁচকে, বিমর্ষ হয় হতাশায়। কারণ শিক্ষার্থীরা আর পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। বসে না আর পড়ার টেবিলে। অনেক শিক্ষার্থী বেশ মজা পায় এই সময়টাতে। কারণ পড়ালেখার বালাই নেই। পরীক্ষার রুটিনের ফাঁকে ফাঁকে ওদেরকে দেখা যায় খেলার মাঠে গল্প গুজবে হাসি ঠাট্টায় আড্ডায় মেতে থাকতে। শিক্ষার্থীদের মতে, এতদিন বইয়ের পাতায় পাতায় যে ছক পূরণ করেছে সেগুলো আর শিক্ষকরা চেক বা মূল্যায়ন করে মন্তব্য দিচ্ছে না। দিচ্ছে না কলমের খোঁচায় কোনো চিহ্ন বা সই। এসব ছাড়াও খুঁটিনাটি যে অল্প বিস্তর জ্ঞান ওরা অর্জন করেছিল সেখান থেকে কোনো প্রশ্নের ছিটেফোঁটা প্রশ্নপত্রে দেখা মেলেনি ছাত্রদের। অভিভাবকের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষার্থীদের বলতে শোনা যায়– ‘আমরা বই থেকে যা–ই পড়ি তা তো পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে থাকে না। তাছাড়া পরীক্ষার হলে গিয়ে প্রশ্নপত্র দেখে আমাদের মাথায় কিছু আসে না কারণ এতদিন তো এগুলো আমরা চর্চা করিনি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তার কোনো চর্চা ছিল না ” প্রশ্নপত্রগুলো বরাবরই শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন। আর তাই কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরাই প্রশ্নের সমাধানে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করে গেছে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে-, পরীক্ষার আগের দিন রাত বারোটার দিকে ইউটিউবে তিনটা অ্যাপ থেকে প্রশ্ন ফাঁস করা হতো। অ্যাপগুলো হলো– কোর্স টিকা, নাতি নাতনি পাঠশালা, শিক্ষা একাডেমী। শিক্ষার্থীরা যথারীতি ওই প্রশ্নগুলো সংগ্রহ করে। সমাধান করে বাসা থেকেই নিয়ে যায়। কোনো কোনো শিক্ষার্থী বাসা থেকে লিখে নিয়ে গিয়ে দেখে দেখে খাতায় পরীক্ষায় তুলতো। শিক্ষকরা কিছুই বলতেন না । কারণ তা না হলে শিক্ষার্থীরা অবশ্যই মূল্যায়নে ফেল করবে। সারা মাসজুড়ে যদি আলু ভর্তা, ডিম সিদ্ধ, ভাত রান্না এমনকি ক্রাফটের কাজ শেখানো হয়েছে কিংবা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে যেভাবে সচেতন করা হয়েছে সেগুলোও তো ব্যবহারিক পরীক্ষা হিসেবে থাকতে পারতো। কারো কারো মতে এই ব্যবহারিকগুলো হাস্যকর হলেও কোনো না কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জন হয়েছিল।
শিল্প ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা–বিশেষ করে এই চারটা পাঠ্যপুস্তকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা যে খালি ছকগুলো রয়েছে এগুলো বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা পূরণ করতে সক্ষম হয় না। তাছাড়া এখানে এমন সব সমস্যা বা প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে যেগুলো বইয়ের ভেতরেই সমাধান মেলে না। তার সমাধানের জন্যও শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল ডিভাইসের শরণাপন্ন হয়। কিংবা বারবার জোর দিয়ে যে কোচিং বা প্রাইভেট টিউটরের প্রয়োজন নেই বলা হচ্ছে তারই দ্বারস্থ হতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। আশ্চর্যের বিষয় একটা কবিতা মুখস্থ করে খাতায় লিখবে, তাও উঠে গেছে। আর কোনো পড়া মুখস্থ্ত করা লাগে না। তাদের যেন পড়ার টেবিলেও সময় দিতে হয় না। আমাদের দেশে বা প্রবাসে থাকেন এমন অনেকেই মন্তব্য করেছেন শিক্ষক ছাত্র মিলে শিক্ষা ক্যাম্পাসে একসাথে আনন্দ করে শিখবে অথবা কেউ কেউ এও বলেছেন যে– শিশুর জীবন আতঙ্কের নয় আনন্দের হোক। বেশ ভালো।
প্রথমত যদি কয়েকটি স্কুলে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা হতো কিংবা কয়েকটা স্কুলে শিক্ষক–শিক্ষার্থী মিলে শেখার পরিবেশ তৈরি করা হতো। তবে এটি ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যেত। বেশিরভাগ স্কুলে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী দিনের পড়ার ডায়েরি হিসেবে দেখা গেছে শুধু এইচ–ডব্লিউ দিতে। অর্থাৎ স্কুলে কোনো সি–ডব্লিউ কিংবা কোনো সমস্যার সমাধান করে দেওয়া হতো না। আর দ্বিতীয়তঃ আতঙ্কের নাইবা হলো শিক্ষা ক্যাম্পাস কিন্তু এতোটা আনন্দের পরিবেশ আনতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ভেস্তে গেছে সেই আদিম যুগের মতো। যেভাবে ছেলেমেয়েরা অনেক বয়স পর্যন্ত মাঠে ময়দানে খেলাধুলা করে মায়ের বানানো পিঠা খেয়ে খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতো ঠিক সেই পরিস্থিতি। বাসায় শিক্ষার্থীরা যেসব ছক পূরণ করেছে তা অভিভাবক, বড় ভাই–বোন কিংবা টিউটরের সহযোগিতায় করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের এবং পুরনো শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন। এছাড়াও কিছু কিছু পত্রিকা নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের আভাস দিয়েছে। সমপ্রতি নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের ব্যাপারটি বিভিন্ন মহলে আন্দোলন হিসেবেও উঠে এসেছে। এ পর্যন্ত শিক্ষা পদ্ধতিতে অনেকবার পরিবর্তন এসেছে।
যেকোনো পরিবর্তনে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা স্বাভাবিক, কতটা বোধগম্য, কতটা সহায়ক উপযোগী কিংবা ফলদায়ক? নতুন যে ধরনের শিক্ষাক্রম চালু করা হোক না কেন কিছু বিষয় মাথায় রাখা খুব জরুরি, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের কথা।
২০২৩ সালের আগে যে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল সেটাও যে তেমন ফলপ্রসূ ছিল তা কিন্তু নয়। সাতটা সৃজনশীল প্রশ্নের সমাধান করা অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাছাড়া শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী উভয়ে এ ব্যাপারে কতটা পারদর্শিতার পরিচয় দিতে পেরেছিল জাতির কাছে সেটাও একটা প্রশ্ন। সৃজনশীল পদ্ধতির আগে যে পদ্ধতি ছিল–একটা অধ্যায় শুরু হতো কোনো একটা রচনা গ্রন্থ প্রবন্ধ কিংবা কবিতা দিয়ে। শিক্ষার্থীরা পড়ে অনুধাবন করে একটা অনুশীলনী পেয়ে যেত। সেই অনুশীলনীর প্রশ্নগুলো নিজেরা সমাধান করতো। তাছাড়া তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণি থেকেই অল্প অল্প করে গ্রামার কিংবা ব্যাকরণ রপ্ত করতো। এভাবে জ্ঞান অর্জন করতো এবং পরীক্ষায়ও উপস্থাপন করতে পারতো। আর এখন যেটা ছক পদ্ধতি বা মন্টেশ্বরী পদ্ধতি এতে করে কোনো ছাত্র গাইড ছাড়া টিউটর ছাড়া এক কদমও এগোতে পারে না। প্রত্যেকটা মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য নিজেকে চেনার জন্য জানার জন্য বাংলা ইংরেজি গণিত এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে বেসিক নলেজ থাকা দরকার। ইংরেজি বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য ট্রান্সলেশন খুব জরুরি যেটা ইদানীং গ্রামার বইয়ে দেখা যায় না। আমার মতে, নতুন পদ্ধতি এবং এর আগের সৃজনশীল পদ্ধতির চেয়ে আগের পদ্ধতিই শিক্ষার্থীদের জন্য যথোপযুক্ত। যে যে প্রতিষ্ঠান নবম শ্রেণি পর্যন্ত অনলাইন পদ্ধতি চালু রেখেছে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের হাতে ডিভাইসের বদলে বই তুলে দেয়া হোক। আগের মতো সকল শিক্ষার্থী বাসায় বা স্কুলে টেবিলে বসে গুনগুন রবে পড়া শুরু করবে। মা বাবার মনে স্বস্তি আসবে। যথারীতি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। ঘন ঘন পরিবর্তন নয় একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা হোক। শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মাথায় শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের নামে হঠাৎ বজ্রপাত না হোক। মোবাইল কোম্পানির প্রতি বিনীত অনুরোধ ১৭–১৮ বছর বয়সী ছেলে–মেয়ে শিক্ষার্থী হোক অশিক্ষার্থী হোক তাদের জন্য বিশেষ মোবাইল ডিভাইস বানানো হোক যাতে বাজে ছবি থাকবে না, থাকবে গঠনমূলক সব শিক্ষণীয় বিষয়। সকল উদ্যোক্তা বিক্রেতাকে সতর্ক করে দেয়া হোক এই বিশেষ মোবাইল ছাড়া অন্য কোনো মোবাইল এই বয়সীদের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়ে। বোর্ড বইয়ের প্রতি সবচেয়ে বেশি আস্থা থাকে মানুষের। সেই বইয়ের কোনো মুদ্রণ প্রমাদ কাম্য নয়।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক