পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, পলিথিনের বিরুদ্ধে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে অভিযান কার্যক্রম শুরু হবে। ২১ আগস্ট দুপুরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিযান শুরুর তারিখ এখনো নির্ধারণ হয়নি। কারণ এর সঙ্গে আরও কয়েকটি সংস্থা সম্পৃক্ত। এখন সবাই একটা আন্দোলনের মুডে আছে। সবাই সবার দাবি পেশ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওইদিকে ব্যস্ত আছে। তবে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আপনারা কার্যক্রমের শুরু দেখতে পারবেন। উপদেষ্টা বলেন, আপনি যে দোকানে যান সে দোকান থেকে পলিথিন ব্যাগ কিনে আনেন। আমি আপনিও বলি না পলিথিন ব্যাগ দিচ্ছেন কেন, এটা তো নিষিদ্ধ। আমরাও তো হাতে করে নিয়ে আসি। মার্কেটগুলোতে গিয়ে পলিথিন ব্যাগগুলোর সম্পর্কে আমরা প্রথমে ১৫ থেকে ২০ দিন বলব, তারপর অভিযানে যাব। এগুলো আপাতত সিদ্ধান্ত। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, শীত মৌসুম শুরুর আগেই ঢাকার বায়ু দূষণ কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এক্ষেত্রে ঢাকার চারপাশের অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করাসহ বায়ুু দূষণ রোধের ব্যবস্থা না করে নতুন ভবন নির্মাণের লাইসেন্স দেওয়া হবে না। খোলা ট্রাকে বালু বা ইট বহন করা যাবে না। বায়ুু দূষণ মিটিগেশনের ব্যবস্থা না থাকলে নির্মাণ কাজের অনুমতি দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরকে সবচেয়ে দূষিত নদীর তালিকা এবং দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা দিতে বলা হয়েছে। নদী রক্ষায় হাজার কোটির না হলেও ছোট ছোট প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। শব্দদূষণ রোধেও হর্নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে সচেতনতা তৈরির কাজ শুরু হবে। খালগুলো পুনরুদ্ধারে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।
পরিবেশ সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার যেমন শেষ নেই, তেমনিভাবে প্রচার–প্রচারণা ও গবেষণার অন্ত নেই। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব উপাদানকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, তার মধ্যে পলিথিন অন্যতম। পলিথিন পরিবেশ সুরক্ষার জন্য চরম হুমকি ও বিরাট চ্যালেঞ্জ। একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, আমাদের দেশে দিন দিন পলিথিনের ব্যবহার বেড়েই চলেছে, যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির দিকে। আশির দশকে প্রথম দেশের বাজারে পলিথিনের ব্যবহার শুরু হয়। এখন পাইকারি বিক্রয়সহ প্রায় সব হাটবাজারেই অবাধে পলিথিন ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ সহজলভ্য ও এর দাম কম হওয়ায় দোকানিরাও যথেচ্ছভাবে সেগুলো ব্যবহার করে চলেছেন। একবার ব্যবহারের পর সেগুলো যত্রতত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে। অপচনশীল সর্বনাশা পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ভরাট হচ্ছে নগর–মহানগরের পয়ঃনিষ্কাশনের নালা–নর্দমা। ভেঙে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পলিথিন বর্জ্যের কারণে বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ। ভরাট হচ্ছে খাল–বিল–নদী, দূষিত হচ্ছে পানি। পলিথিন খাল–বিল, নদী–নালায় জমা হয়ে তলদেশ ভরাট করে ফেলে। নাব্য নষ্ট হওয়ায় নৌপরিবহনে বিঘ্ন ঘটে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হয়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ পানিবদ্ধতা। দুর্ভোগের শিকার হয় নগরবাসী।
পরিবেশবিদদের মতে, ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় পলিথিন তৈরিতে। পলিথিন মাটির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পচনশীল না হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করে সব ধরনের চাষাবাদে। পলিথিন মাটির অভ্যন্তরে চলে যাওয়ার ফলে মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। মাটির নিচেও তা পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে, মাটির গুণগত মান ও উর্বরতা হ্রাস পাওয়ায় শস্যের উৎপাদন কমে যায়। মাটির নিচের পলিথিনের কারণে গাছ খাবার পায় না। এ কারণে গাছ কম আক্সিজেনের উৎপাদন করায় বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড, সীসা এসবের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অক্সিজেনের স্বল্পতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে হাঁপানি কিংবা শ্বাসরোগ বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জনসাধারণ সচেতন হলেই কমানো যায় পলিথিনের ব্যবহার, রক্ষা পায় আমাদের পরিবেশ ও শত শত মানুষ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করে ২০০২ সালে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫’–এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন ও পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সেইসঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসেই জেলসহ ১০ হাজার টাকার জরিমানার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাজারগুলোয় প্রকাশ্যে ব্যবহার করা হলেও এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। তাই আগামী প্রজন্মকে একটি সুন্দর পরিবেশ উপহার দিতে পলিথিনের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বাজারে পলিথিন বন্ধ করার পাশাপাশি বিভিন্ন কারখানায় অভিযান চালাতে হবে। কারখানার মালিকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।