ক্যানসারাক্রান্ত হুলিও কোর্তাসার মারা যান ঊনসত্তর বছর বয়সে, ১৯৮৪–র ফেব্রুয়ারিতে; মাদ্রিদের ‘এল পাইস’ পত্রিকা তাঁকে লাতিন আমেরিকার মহত্তম লেখকদের একজন হিসেবে সম্মান জানায়, মৃত্যুর পর টানা কয়েকদিন এগারো পাতার বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে, সেখানে থাকে স্মৃতিচারণ, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন আর বিদায়ীবার্তা।
কোর্তাসার ১৯৫১ থেকে আমৃত্যু ফ্রান্সের প্যারিসে থেকেছেন, সামরিক জান্তা কর্তৃক ১৯৭০–এ চূড়ান্ত নির্বাসনের আগে পর্যন্ত নিয়মিতই তাঁর দেশ আর্জেন্টিনায় যাতায়াত করেছেন।
প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘অধিগৃহীত বাড়ি’ ছিল এমন একটি লেখা যা তাঁর কাছে স্বপ্নে এসেছিল, প্রকাশিত হয়েছিল ৪৬–এ, সম্পাদক ছিলেন হোর্হে লুইস বোর্হেস। ৫১–তে কোর্তাসারের প্যারিসে চলে আসার আগে পর্যন্ত আর তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকাশিত না হলেও লেখাটা কিন্তু চলছিল, নিজের জন্য, পরে যে উপন্যাসটি সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তা লিখিত হতে শুরু হয়েছিল মনে মনে, বুকের ভেতর। ১৯৬৩ সালে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘হপস্কচ’ প্রকাশিত হয়, প্যারিস ও বুয়েনস আইরেসের রাতের জীবনের জঙ্গমতাকে কেন্দ্র করে এক আর্জেন্টাইন অস্তিত্ববাদী ও অধিবিদ্যক কিছু একটা অনুসন্ধান করছেন– এরকম বিষয়–আশয় নিয়েই উপন্যাসটি গড়ে ওঠে।
তিনি আধুনিক ছোটোগল্পের দক্ষ কারিগরের পরিচিতি পেয়েছেন, লাতিন উপন্যাসে রেখেছেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ১৯৭৩–এ প্রকাশিত হয় ‘অ্যা ম্যানুয়েল ফর ম্যানুয়াল’, যে–উপন্যাসের আখ্যান গড়ে উঠেছে লাতিন আমেরিকার এক কূটনীতিজ্ঞের অপহরণের ঘটনা নিয়ে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি নিয়ে ১৯৬০–এ তৈরি হয় মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি–র ছবি ‘ব্লো–আপ’।
হুলিও কোর্তাসারের এই সাক্ষাৎকারটি ‘আর্ট অফ ফিকশন ইন্টারভিউ’ হিসেবে প্যারিস রিভিউ–এ ছাপা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে, এখানে সেই সাক্ষাৎকারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনূদিত হলো–
প্যারিস রিভিউ: আপনার ‘যন্ত্রণাদগ্ধ সময়ের আখ্যান’ বইটির কয়েকটি গল্পে অধিকমাত্রায় বাস্তবজগতের ভেতর ‘উদ্ভট ও অবাস্তব কল্পনা’র অস্বাভাবিক মিশ্রণ ঘটেছে। আপনি কি ব্যাপারটা অনুধাবন করেছেন যে উদ্ভট কল্পনার জগত আর চারপাশের বাস্তবতা একাকার হয়ে যাচ্ছে?
হুলিও কোর্তাসার: হ্যাঁ, শেষদিকের গল্পগুলো লেখার সময় আমার এই অনুভবটি হয়েছে যে, আমরা ‘কল্পনার অদ্ভুত জগত’ আর ‘নিরেট বাস্তব’ বলে যা বুঝে থাকি তাদের মধ্যেকার দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। আমার আগের গল্পগুলোয় কল্পনা আর বাস্তবের ব্যবধান অনেক বেশি ছিল, কারণ কল্পনা সত্যিকার অর্থে কল্পনাই ছিল, মাঝে মাঝে এই কল্পনা অতিপ্রাকৃতকেও স্পর্শ করত। হ্যাঁ, অবশ্যই কল্পনা রূপান্তরিত হয়, বদলে গিয়ে অন্য কিছু হয়ে যায়। কল্পনার জগতের ধারণা যা আমরা ইংল্যান্ডের গথিক উপন্যাসগুলোয় ইতিহাসের উন্মোচন হিসেবে দেখি, উদাহরণস্বরূপ বলছি, সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যসূচক কল্পনার জগতটি আমাদের আজকের ধারণার কাছে কোনো আবেদনই তৈরি করতে পারবে না। আমরা এখন যখন হোরেস ওলপোল–এর ‘ওট্রানটোর দুর্গ’ উপন্যাসখানি পড়ব, তখন আমাদের হাসি পাবে! সবগুলো ভূত সাদা পোশাক পরিধান করেছে। কঙ্কালগুলো, চারপাশে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে আর তাদের শেকল নাড়িয়ে ভীতিকর শব্দ উৎপাদন করছে। আজকের দিনে, আমার কল্পনার ধারণাটি আমাদের ‘বাস্তবের ধারণা’র অনেক কাছাকাছি, কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যেকার দূরত্ব খুব বেশি আর নেই এখন, তার কারণ সম্ভবত এটাই যে– বাস্তবতা এখন অদ্ভুত কল্পনার ভেতর দিয়ে নিজেকে দেখাচ্ছে, মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে এখনকার বাস্তবতা।
প্যারিস রিভিউ: সাহিত্য আপনার কাছে একটা ‘খেলা’– এই কথাটা আপনি বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। ঠিক কোন্ দিকটিকে বিবেচনায় নিয়ে সাহিত্যকে আপনি খেলা হিসেবে দেখেছেন?
কোর্তাসার: আমার কাছে সাহিত্য হচ্ছে খেলার একটি রীতি (ফর্ম), তবে এই খেলা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সবসময়ই আমি আরও কিছু কথা বলি, দেখুন, এখানে খেলার ফর্ম আছে দুটি, উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, ধরুন ফুটবল, যা মূলতই একটা খেলা, দ্বিতীয়ত, এটা এমন এক খেলা যার আছে ব্যাপক বিস্তৃতি আর গুরুত্ব। আবার, বাচ্চারা যখন খেলা করে, যদিও তারা শুধুমাত্র নিজেদের আনন্দেই খেলতে নেমেছে, তো, তারা কিন্তু খেলাটাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। এই গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়াটাই খেলার আসল তাৎপর্য। এই খেলাটা তাদের কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে আগামী দশ বছর পর্যন্ত গভীর ভালোবাসায় তারা এই খেলাটা খেলতে থাকবে। আমি খুব ভালো করেই মনে করতে পারি, ছেলেবেলায় মা–বাবা সবসময়ই বলতেন, অনেক হয়েছে, অনেক খেলা খেলেছ, এখন গোসল করতে এস। তাদের এভাবে বলাটাকে সবসময়ই নির্বোধের আচরণ বলে মনে হয়েছে, কারণ, খেলায় মত্ত আমার কাছে গোসল করাটা তখন জঘন্য ব্যাপার। যখন বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় মশগুল, খেলাটা যখন চরম উত্তেজনার পর্যায়ে পৌঁছেছে, গোসল করাটা তখন ফালতু বিষয়। সাহিত্য অনেকটাই এমন প্রকৃতির। একটা উত্তেজনাকর খেলা। কিন্তু সাহিত্য এমন এক খেলা যেখানে কেউ একজন হয়তো তার নিজের পুরো জীবনটাকেই বিলিয়ে দেবে। কেউ একজন এই খেলার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে ঢেলে দেবে।
প্যারিস রিভিউ: অলীক কল্পনার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন ঠিক কখন? ছেলেবেলা থেকেই?
কোর্তাসার: হ্যাঁ, কল্পনার শুরুটা কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই হয়েছিল। আমার সহপাঠীদের অনেকেরই অদ্ভুত ও বিচিত্র কল্পনা সম্পর্কে ধারণা ছিল না। তারা তাদের চারপাশের সমস্ত কিছুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করত যেন সবকিছু খুব মামুলি ব্যাপার, এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে… এটা তো শুধুই একটা চারাগাছ, ওই যে একটি আর্মচেয়ার। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে, বস্তুজগতের কোনোকিছুই ভালো করে নির্ধারণ করা ছিল না। মা, যিনি এখনও বেঁচে আছেন, যিনি এক আশ্চর্য কল্পনাশক্তিধর নারী, আমাকে উসকে দিতেন, উৎসাহ দিতেন। না, না, এটা নয়, এটা ঠিক নয়, তোমাকে আরও মনোযোগী হতে হবে– এইসব কথার পরিবর্তে কেবল আমার কল্পনাশক্তিকে বাড়তে দিতেন তিনি, নানাভাবে। আমি যে তার এক কল্পনাপ্রবণ ছেলে, এটা দেখে তিনি আনন্দিত হতেন। যখন আমি কল্পনার আশ্চর্য জগতে ঢুকে পড়ছি শৈশবের অগাধ কৌতূহলে, মা তখন নানারকমের বই পড়তে দিয়ে আমাকে আরও বেশি করে কল্পনার জগতে ঢুকিয়ে দিলেন। ‘এডগার অ্যালান পো’ প্রথম পড়ি মাত্র ন–বছর বয়েসে। পো–র বই আমি চুরি করে পড়েছিলাম কারণ মা চাইতেন না যে এখনই আমি এই বই পড়ি। তিনি ভাবতেন আমি এখনও অনেক ছোটো আর তিনিই সঠিক ছিলেন। পো–র বই আমাকে ভীত, আতঙ্কিত করে তোলে; প্রায় তিন মাস আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকি, বইয়ের ঘটনাগুলোকে আমি বিশ্বাস করে ফেলি! ফরাসিরা যেমন বলে– সে এটিকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছে। আমার কাছে কল্পনার জগতটাই ছিল স্বাভাবিক জগত, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক– এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। বস্তুকে আমি কল্পনায় রাঙিয়ে নিতাম। যখনই আমার বন্ধুদের এসব বই পড়তে দিতাম, তারা বলত, না, এসব নয়, এসব বইয়ের চেয়ে আমরা কাউবয়দের গল্পগুলো পড়তেই বেশি পছন্দ করি। তখন কাউবয়রাই বেশি জনপ্রিয় ছিল। আমি এই ব্যাপারটা বুঝতামই না যে কেন এসব এত জনপ্রিয়। আমার কাছে তখন অপার্থিব জগতই প্রিয়, আমি কল্পনার জগতে বিচরণ করতেই বেশি পছন্দ করছি।
প্যারিস রিভিউ: আপনার লেখায় একটা বিচিত্র ও অনিন্দ্যসুন্দর ব্যাপার আছে, তা হল চরিত্রগুলোর জন্য সত্যিকার আন্তরিকতা আর প্রীতিপূর্ণ মমত্ব!
কোর্তাসার: আমার চরিত্ররা যখন শিশু থাকে কিংবা হয়তো শৈশব–কৈশোরের মধ্যবর্তী সময়টা তারা পার করছে, ঠিক তখনই তাদের জন্য অতিমাত্রায় কোমলতা ও মমত্বের জন্ম হয়। আমি প্রায়ই ভাবি যে এই চরিত্রগুলো আমার গল্পে, উপন্যাসে তীব্রভাবে জীবন্ত হয়ে থাক–এক অপার্থিব ভালোবাসা নিয়েই তাদের সঙ্গে আমার হৃদয়ের খেলাটা চলতে থাকে, লেখার লাইনে–লাইনে, শব্দে–শব্দে। আমি যখন গল্প লিখতে থাকি, সে গল্পের চরিত্রটি তার বয়ঃসন্ধিতে থাকলে, তখন, গল্পটি লিখতে থাকাকালে আমিও তার সঙ্গে বয়ঃসন্ধিকাল পার করি, আবার আমার চরিত্রটি যখন পূর্ণবয়স্ক তখন কিন্তু ভিন্নরকম ব্যাপার ঘটতে থাকে।
প্যারিস রিভিউ: গল্পের বেশিরভাগ চরিত্রই কি পরিচিতজনদের অনুকরণে সৃষ্ট?
কোর্তাসার: দেখুন, গল্পের সব চরিত্রই আগে থেকে চেনা, আমি এমন কথা অবশ্যই বলব না, তবে, হ্যাঁ, তাদের সম্পর্কে জানাশোনা কিছুটা তো থাকেই, কম করে হলেও থাকে। আমার চরিত্রদের বেলায় এরকম ব্যাপারও ঘটেছে, এমন একটি চরিত্র আছে যে আসলে কয়েকজনের সমষ্টি, দুই থেকে তিনজন লোকের একটা সংমিশ্রণ। কখনও আমি হয়তো দ’ুজন নারীকে মিলিয়ে একটি চরিত্র নির্মাণ করে ফেললাম, সেই দ’ুজন নারীকে আমি কিন্তু চিনি, জানি। এতে যা ঘটে, এই সংমিশ্রণের ব্যাপারটা গল্পের চরিত্রকে এমন একটি বিশেষ ব্যক্তিত্ব দান করে যা অনেক বেশি জটিলতায় আক্রান্ত, কখনও মনে হবে জীবনের প্রগাঢ় অনমনীয়তা যেন ভর করেছে তার উপর!
প্যারিস রিভিউ: আপনার যখন মনে হয় চরিত্রকে আরও জটিল কিংবা আরও গভীর করতে হবে, তার জন্য আরও বিস্তৃত পরিসর তৈরি করতে লাগবে, তখনই কি একটি চরিত্রের মধ্যে একাধিক চরিত্রের জটিলতা প্রবেশ করান?
কোর্তাসার: না, না; এভাবে আসলে কাজের কাজ কিছুই হয় না। আসল বিষয় তো এটা– চরিত্ররাই আমাকে চালিত করে, পথ দেখায়। এভাবে আমি দেখি একটি চরিত্র, সে হয়তো এখানেই দাঁড়িয়ে আছে, আর আমি এমন কাউকে চিহ্নিত করে ফেলি, যাকে আমি চিনি, জানি। কিংবা মাঝেমধ্যে আকস্মিকভাবে দু–একজনকে পাওয়া যায় যারা অন্যদের মিশ্রণে তৈরি। ব্যাস, ওইটুকুই। কিন্তু পরে হয় কী, চরিত্ররা তাদের নিজেদের ধরনে আচরণ করতে থাকে, নিজেদের বৈশিষ্ট্যে প্রকাশিত হতে শুরু করে। তারা বলতে থাকে… আমি কোনোভাবেই জানব না চরিত্ররা কী কথা বলতে যাচ্ছে যখন তাদের নিয়েই আমি সংলাপগুলো লিখতে যাচ্ছি। আসলে, সবকিছুই নির্ভর করছে তাদের ওপর। আমি শুধু টাইপ করছি তারা কী কথা বলছে, তা। মাঝে মাঝে তো এমনও হয় যে লিখতে লিখতেই আমি হা হা করে হেসে উঠছি কিংবা কাগজটাকে দুমড়ে–মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে তাদেরকে বলছি, ‘এইখানে, ঠিক এইখানে এসে তোমরা বিশ্রী বিষয় নিয়ে কথা বলছ। যাও, দূর হও।’ তারপর টাইপরাইটারে অন্য একটি কাগজ ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের কথোপকথন আবার লিখতে শুরু করি।
প্যারিস রিভিউ: এবার তাহলে বলুন, তারা কি আপনার চেনাজানা চরিত্র নয়?
কোর্তাসার: না, মোটেই তা নয়। প্রায় সময় হয় কী, গল্পের জন্য মাথায় একটা আইডিয়া খেলা করতে থাকে। শুধুই একটি আইডিয়া। কিন্তু তখন পর্যন্ত সেখানে কোনো চরিত্রের ভাবনা কী আভাসও নেই। মাঝে মাঝে আমার মাথায় এক আজব চিন্তা খেলা করে–শহরের কোনো একটি বাড়িতে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, আমি যেন দেখছি… আমি যখন যা লিখি তখন তা প্রত্যক্ষ করি। সবকিছু দেখি। সমস্ত খুঁটিনাটি। সুতরাং, প্রথমে আমি দেখি বাড়িটি, তারপর চরিত্রগুলোকে সেখানে সংস্থাপন করি, ধীরে ধীরে। এবং ঠিক এই জায়গাটায় চরিত্রদের মধ্যে কোনো একজন এমন হবে অবশ্যই যাকে আমি আগে থেকেই চিনি, কিন্তু এই চেনার ব্যাপারটা সুনিশ্চিত করার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত থাকি না, আর, আসল কথা হল, বেশিরভাগ চরিত্রই আমার নিজের সৃষ্টি, নিজের তৈরি করা। তো, এখন, অবশ্যই এদের মাঝে স্বয়ং আমিও আছি। ‘এক্কাদোক্কা খেলা’ [হপস্কচ] উপন্যাসের ওলভিরা চরিত্রটির মধ্যে অজস্র আত্মজীবনীমূলক ব্যাপার ঢুকে পড়েছে, ঢুকে পড়ে ওলভিরা আর কোর্তাসার–এর মধ্যে সম্পর্কসূত্র তৈরি করেছে যদিও, তবুও চরিত্রটি কোনোভাবেই আমি নই, কিন্তু আমার অনেক কিছুই, যেমন প্যারিস জীবনের প্রথম দিককার বেহিসেবি বোহেমিয়ান দিনগুলির অনেক কথাই আছে। এখন, পাঠক যদি ওলভিরা–কে পড়তে গিয়ে পড়ে বসেন প্যারিসের কোর্তাসারকে, সেটা ভুল হবে। আমি সম্পূর্ণ আলাদা একটা লোক।
প্যারিস রিভিউ: আর সেজন্যই কি লেখাকে কোনোভাবেই আত্মজীবনীমূলক করে তুলতে চান না?
কোর্তাসার: জীবনস্মৃতি আমি পছন্দ করি না আর জীবনে কখনও স্মৃতিকথা লিখবও না। কিন্তু অন্যদের স্মৃতিকথা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, অবশ্যই তার একটা মর্ম আছে, কিন্তু আমার জীবনের কোনো লিখে যাবার মতো কথা নেই। আমি যদি লিখে ফেলি, তাহলে আমাকে কিন্তু সত্যের সঙ্গে এগোতে হবে, সত্য আর একই সঙ্গে প্রচণ্ড সততা না থাকলে সেটা আত্মজীবনী নয়। আমি কখনোই মনঃকল্পিত আত্মকথা বলতে যাব না। আমাকে করতে হবে অন্যরকম একটা কিছু, ঐতিহাসিকদের মতো কাজ করতে হবে; নিজের জীবনকে অনুসন্ধানকারীদের মতো খুঁড়ে খুঁড়ে সত্যকে বের করে আনতে হবে। কারণ আমি আবিষ্কার করতে পছন্দ করি ততটাই যতটা কল্পনা করি তার চেয়েও বেশি। তবে হ্যাঁ, ব্যতিক্রম যে একেবারেই ঘটবে না তা কিন্তু নয়। প্রায়ই এরকম ঘটে– আমার কাছে যখন কোনো উপন্যাস কি গল্পের আইডিয়া থাকে, বাস্তবতা আর নিজের জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত যেন প্রকৃতির নিয়মেই সেই লেখায় ঢুকে পড়ে। আমার ‘যন্ত্রণাদগ্ধ সময়ের আখ্যান’ গল্পটিতে একটা ব্যাপার আছে, একটা ছেলের বন্ধুর বড়ো বোনের সঙ্গে তার প্রেমের যে আশ্চর্য সংযোগ তা কিন্তু প্রকৃত অর্থেই জীবনের বাস্তব পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। তো, আমার লেখায় ঠিক এটুকুই আত্মজীবনীমূলক,খুব ছোটো পরিসরে; কিন্তু, বাকিটুকু অপার্থিব, কল্পনার জাদুমন্ত্র।
প্যারিস রিভিউ: যে–কোনোভাবে, হতে পারে কোনো একটি বিশেষ দৃশ্য থেকে, ঠিক কীভাবে আপনি লিখতে শুরু করেন?
কোর্তাসার: যে উৎসবিন্দুটি থেকে লিখতে শুরু করি সেটা আমার ক্ষেত্রে কীরকম তা বলতে গেলে বলব, গল্প কিংবা উপন্যাস শুরু হয়ে যেতে পারে যে–কোনো একটি জায়গা থেকে। লেখার ক্ষেত্রে, ব্যাপারটা যখন শুধুমাত্র একটা লেখা, তো, যখনই আমি লেখাটা লিখতে শুরু করলাম, তখন, গল্পটা দীর্ঘ সময় ধরে আমার ভিতরে পাক খেতে শুরু করে, দীর্ঘ সময় ধরে একটা ঘূর্ণন, আমার ভেতর সেই গল্পের; মাঝে মাঝে পুরো একটা সপ্তাহ কেটে যায় এই ঘোরে, কিন্তু তাই বলে গল্পটা যে আমার কাছে আদ্যোপান্ত জানা হয়ে গিয়েছে বা আমি সমস্তটা দেখে ফেলেছি, তা কিন্তু নয়, দিনে দিনে তখন গল্পটি সম্পর্কে খুব সাধারণ একটা ধারণা পাওয়া যায়। সম্ভবত গল্পের ওই বাড়িটাতে, বাড়িটির একটা কোনায় কিছু লালরঙের চারাগাছ আছে, আর, আমি শুধু আর–একটি বিষয় জানি, সেই বাড়িটিতে আছেন বয়োবৃদ্ধ একজন লোক যিনি বাড়িটির সর্বত্র ঘুরে বেড়ান–ব্যস, এইটুকুই আমি জানতে পেরেছি। গল্পের অবিরাম ঘূর্ণনের ফলে এরকম কিছু ঘটে থাকে, গল্পটা এখান থেকেই শুরু হয়ে যায়, তারপর আর যা কিছু করার বাকি থাকে তা হল, স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখা। আমার জন্য ঠিক এ–সময়টাই হল গর্ভধারণের সময়। এই সময়ের ভিতরে আমার স্বপ্নগুলো ভরা থাকে অজস্র সূত্র আর কিছু পরোক্ষ ইঙ্গিতে, কিছু ইশারায়, যা গল্পের ভেতর ঢুকে যেতে চলেছে। কখনও দেখা যায় পুরো গল্পটাই একটা স্বপ্নের ভিতর নিমজ্জমান। আমার প্রথম দিকের এবং খুবই পাঠকপ্রিয় গল্প ‘অধিগৃহীত ঘর’ হচ্ছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি, এক দুঃস্বপ্ন নিয়ে লেখা, যে অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে আমি নিজে গিয়েছি। দুঃস্বপ্নের রেশ কাটতে না কাটতেই আমি দ্রুত, খুব দ্রুত গল্পটি লিখে ফেলি। কিন্তু এরকম ব্যাপার সবসময় ঘটে না। আমার ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়–স্বপ্ন থেকে লেখার উপকরণ যা যা পাই, তা হল, কিছু সূত্র, গল্পের ভাঙা কিছু টুকরো। তো, এভাবে যা কিছু পাই, তাতেই আমার অবচেতনে একটা বিশেষ কর্মপ্রক্রিয়া সক্রিয় হয়ে থাকে, আর আমাকে দিয়ে গল্পটি লিখিয়ে নেয়। গল্পটিকে অবলম্বন করে যখন স্বপ্নটা দেখতে থাকি, ঠিক তখন থেকেই ভিতরে লেখাটাও চলতে থাকে। সুতরাং, আমি যখন বলি, আমি শুরু করি যে–কোনো একটি জায়গা থেকে, এর মানে হল, আমি আসলে জানিই না শুরুটা কীভাবে হল, এটা কি শুরুর জায়গা, না সমাপ্তির? যখন আমি লেখাটা লিখতে শুরু করি, যেভাবে শুরু করি, সে জায়গাটাই হয়তো তার প্রবেশমুখ। তবে আমি আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকি না যে গল্পটা ঠিক এভাবেই শুরু করব। খুব মামুলি ঘটনার মতো লেখাটা শুরু হয়ে যায় এবং নিয়মিত গতিতে সামনে এগোয়। আর, প্রায় সময়ই গল্পের সমাপ্তি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকে না; আমি জানিই না প্রকৃতপক্ষে কী ঘটতে চলেছে। ধীরে ধীরে, একমাত্র যখন গল্পটা এগিয়ে যেতে থাকে, তখন বেশ কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ঘন কুয়াশার ভেতর অস্পষ্ট কিছুর মতো অপ্রত্যাশিতভাবে গল্পের শেষটুকু আমি দেখে ফেলি!
প্যারিস রিভিউ: শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা দাঁড়াল এই– যখন লিখতে থাকেন, লিখতে লিখতেই গল্পটাকে কুয়াশার ভেতর থেকে বের করে আনেন?
কোর্তাসার: হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আমি বলব, ব্যাপারটা জ্যাজ সংগীতের তাৎক্ষণিক সুর সৃষ্টির মতই, অনেকটা। আপনি কিন্তু একজন জ্যাজ শিল্পীকে এ–কথা জিজ্ঞেস করবেন না, আচ্ছা বুঝলাম, কিন্তু এখন আপনি কী বাজাতে যাচ্ছেন? কথাটা শোনামাত্রই শিল্পী আপনাকে নিয়ে হাসতে শুরু করবেন, কারণ তার একটা থিম আছে, তার ঘরানার কর্ডেও একটা সিরিজ আছে, ‘হারমোমিয়াস একটা অবস্থা’; তারপর তিনি তার ট্রাম্পেট কিংবা স্যাক্সোফোনটি হাতে তুলে নেবেন এবং বাজাতে শুরু করবেন। এখানে কিন্তু কোনো আইডিয়ার ব্যাপার নেই, কেন–না ভিন্ন ভিন্ন অজস্র ছন্দময় হৃদ্স্পন্দনের অবিরাম স্রোতের ভিতর দিয়েই তাকে যেতে হচ্ছে, আর এই যাওয়া থেকে সংগীতের যে জাদুকরি মূর্চ্ছনা, কখনও তা হৃদয়কে তোলপাড় করে দেবে; মাঝে মাঝে বাজানোটা খুব একটা ভালোও হবে না। আমার নিজের সঙ্গেও তা একেবারে মিলে যায়। মাঝে মাঝে আমিও গল্প লিখতে বসে অস্বস্তিতে পড়ে যাই, তবে সেটা শুধু গল্পের বেলায়, উপন্যাসের বেলায় বিষয়টা অন্যরকম, একেবারেই অন্যরকম, কারণ, উপন্যাসের জন্য আমি ব্যাপকভাবে প্রস্তুত হয়েই কাজ শুরু করি, আর উপন্যাস লিখতে লিখতেও বিস্তর প্রস্তুতি নেওয়া হয়, একটা আর্কিটেকচার যেন, গেঁথে গেঁথে কতদূর চলে যাওয়া যায়… কিন্তু আমার গল্পগুলো করে কী, তারা নিজেই যেন আমাকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়, যে নির্দেশনাগুলো আমার ভিতরে বিক্ষিপ্তভাবে ছিল; কখনও মনে হয় ঘটনাগুলোর লিপিবদ্ধকারী যেন আমি নই, আমি কিছুই করিনি, যদিও গল্পগুলো আমার নামেই লিখিত হয়েছে। তাহলে সেগুলো আমারই কাজ, অবশ্যই তারা আমার লেখা, কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় অচেনা কারও লেখাকে আমি নিজের বলে স্বীকার করে নিয়েছি।
প্যারিস রিভিউ: গল্প লেখার জন্য আপনার যে নিজস্ব কিছু রীতি, ভঙ্গি ইত্যাদি আছে সেগুলো নিয়ে কি কখনও সমস্যায় পড়েছিলেন?
কোর্তাসার: সাধারণত সমস্যা তৈরি হয় না, কিন্তু আমি যদি এখন এই বিষয়টির বিশ্লেষণ করতে থাকি তাহলে বলব, গল্পটা কিন্তু আমার ভিতরে কোনো একটা জায়গায় ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে, আর, তৈরি যেহেতু হয়েই গেছে, সুতরাং তার গড়ন, কাঠামো এবং মাত্রাও রয়েছে। লেখাটা যদি একটি ছোটোগল্পের দিকে যেতে থাকে কিংবা মোটামুটি একটি বড়ো গল্প, যা–ই হোক, তা যেন আগে থেকেই ঠিক করে রাখা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আমি যেন লেখা শুরু করতে গিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়ছি। কাগজের ওপর আমি যেন এক সঙ্গে বহু কিছু এঁকে ফেলতে চাইছি কিন্তু আমার লেখার গতি ক্রমশই যেন ধীর হয়ে যাচ্ছে, যেন কোথাও আমি স্থির হয়ে আছি এবং এমনভাবে লেখাটা লিখছি যেন দরকারের চেয়ে বেশি লিখে ফেলছি, অতিকথনের মতো, কিংবা লিখছি একেবারে সংক্ষেপে; সংক্ষিপ্ত আকারে। কয়েকজন সমালোচকও আমাকে এ–ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। সমালোচকরা বলছেন, আমি নাকি একটু একটু করে গল্পের ভেতরকার কোমলতা ও সংবেদনশীলতাকে মেরে ফেলছি, হারিয়ে ফেলছি। তাদের কথাই যদি সত্য হয়, তাহলে আমি আসলেই জানি না লেখার এই বিবর্তন ভালোর জন্য হচ্ছে, না কি এক নিদারুণ অপচয়… তবে, যাই হোক, এটাই এখন আমার লেখার সর্বশেষ পদ্ধতি। এভাবেই আমি এখন লেখালেখি করছি।
প্যারিস রিভিউ: উপন্যাস সম্পর্কে আপনি বলে থাকেন যে উপন্যাস হচ্ছে বিস্তৃত স্থাপত্যরীতি। আপনার কাজের ভিন্নধর্মীতা বোঝাতে গিয়েই কি এভাবে বলেন?
কোর্তাসার: ‘হপস্কচ’–এর যে অংশটি আমি প্রথমে লিখি তা ছিল এই উপন্যাসটির পুরো একটা অধ্যায়, অবশ্য সে অধ্যায়টি এখন বইটির মাঝখানে চলে গেছে। এটা ছিল সেই অধ্যায় চরিত্ররা যেখানে লম্বা একটুকরো কাঠকে এক অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির জানালা থেকে পাশের বাড়ির জানালায় এমনভাবে লাগিয়ে রাখে যাতে অনায়াসে ওই বাড়িতে চলে যাওয়া যায়, জানালা দিয়ে; আর দেখুন, ঘটনাটি আমি লিখেছি এটা না জেনেই যে কেন আমি লিখছি! আমি চরিত্রদের দেখছিলাম, এমনকি সিচুয়েশনটাও দেখছিলাম; পুরো ব্যাপারটাই ছিল বুয়েনস আইরেসে, সময়টা ছিল প্রচণ্ড গরমের, মনে পড়ছে, আমি জানালার পেছনে টাইপরাইটারে বসেছিলাম। একজনকে দেখছিলাম যে চেষ্টা করছিল তার স্ত্রীকে ওই কাঠের ওপর দিয়ে পাশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে। সেই কাঠে পেরেকগুলো এমন বিপজ্জনকভাবে বের হয়ে ছিল যে মহিলাটি কিছুতেই যেতে পারছিল না। আমি একদম কাছ থেকেই যেন সব দেখছি, সেভাবেই টাইপ করছিলাম, সবকিছুই আমি লিখলাম, যা ছিল বেশ দীর্ঘ, মোট চল্লিশ পাতার মতো দীর্ঘ, লিখে ফেলবার পর নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, সবকিছু ঠিকঠাক আছে বুঝলাম, কিন্তু করলামটা আসলে কী? কারণ লিখে ফেলা অংশগুলো কিন্তু গল্প ছিল না। তাহলে কী? তখন বুঝতে পারলাম যে আমি একটি উপন্যাস শুরু করেছি, কিন্তু আমি যেন ঠিক এই জায়গাটি থেকে শুরু করতে চাইনি। আমাকে এতটুকু লিখেই থামতে হল, পরে প্যারিসে বসে আমাকে পুরো অধ্যায়টা লিখতে হল যা হবে উপন্যাসটির প্রথম অধ্যায়, আর সেটা হবে ওলভিরা–র সমস্ত খুঁটিনাটি আর পটভূমি। শেষ পর্যন্ত লিখতে লিখতে আগের লেখা সেই অধ্যায়টার কাছে এলাম, সেই যে কাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া পাশের অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িতে, তারপর বাকি অধ্যায়গুলোও লিখতে শুরু করলাম।
প্যারিস রিভিউ: লেখাকে কি বারবার পড়েন, কাটাকাটি করেন?
কোর্তাসার: না, খুব কমই এরকম করে থাকি, এর কারণ বোধহয় এটাই যে যা লিখেছি, যা লিখতে যাচ্ছি, তা তো আমার ভিতরেই জেগে আছে, আমার ভিতরেই প্রবাহিত হচ্ছে! যখন আমার লেখক বন্ধুদের পাণ্ডুলিপি দেখি, সেগুলো আসলে পরিমার্জন আর সংশোধন করা খসড়া লেখাটা, যেখানে আগাগোড়া কাটাকুটি, অদলবদল, এদিক থেকে ওদিকে সরিয়ে নেওয়া, পুরো লেখাটার ওপর অজস্র তির–চিহ্নিত জায়গা… না, না, না। আমার পাণ্ডুলিপিতে একটুও কাটাকাটি নেই, খসড়াটি একেবারে ঝকঝকে।
প্যারিস রিভিউ: লেখার অভ্যাসটা কী রকম আপনার? যেভাবে শুরু করেছিলেন, এখন সেই নিয়মটা কি কিছুটা বদলেছে?
কোর্তাসার: কিছু কিছু বিষয় কিন্তু পরিবর্তিত হয়নি, কোনোদিনও হবে না, তা হল বাস্তবিক নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলা। বদলে যাওয়ার প্রশ্নে বলতে হবে লেখালেখির ক্ষেত্রে আমার একেবারেই বিশেষ কোনো অভ্যাস বা পদ্ধতি নেই। যখনই বুঝতে পারি আমাকে এখন গল্প লিখতে হবে, তখনই বসে পড়ি। গল্পটি আমি লিখি।
প্যারিস রিভিউ: প্রায়ই আপনাকে বলতে শোনা যায়, লাতিন আমেরিকা ও তার সমস্যাগুলোর প্রশ্নে, কিউবা বিপ্লব আপনাকে প্রেরণা যুগিয়েছে, উদ্বুদ্ধ করেছে।
কোর্তাসার: এবং, এখনও তাই বলছি।
প্যারিস রিভিউ: লেখালেখির জন্য কি আপনার পছন্দের কোনো জায়গা নির্দিষ্ট করা আছে?
কোর্তাসার: না, সত্যিকার অর্থেই না। লেখালেখির একেবারে শুরুর দিকে বয়সে যখন তরুণ আর শারীরিকভাবেও বেশ শক্তপোক্ত ছিলাম, তখন, এই এখানেই, উদাহরণ হিসেবেই উল্লেখ করছি প্যারিসের দিনগুলোর কথা, এখানকার এক ক্যাফেতে বসেই ‘এক্কাদোক্কা খেলা’ [হপস্কচ] উপন্যাসটার একটা বড়ো অংশ লিখে ফেলেছিলাম। ক্যাফের কোলাহলমুখর পরিবেশ নিয়ে মোটেও চিন্তা করিনি, পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছি, জায়গাটা লেখার জন্য সম্পূর্ণ উপযুক্ত ছিল। প্যারিসে এসেই আমি কাজে একেবারে ডুবে গিয়েছিলাম–লেখালেখি আর অবিরাম পাঠে।
কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও যেন ব্যাপকমাত্রায় জটিল আর দুর্বোধ্য হয়ে পড়লাম। এখন আমি চারপাশে নিশ্চিত নীরবতা ছাড়া এক লাইনও লিখতে পারি না, এমনকি কাছেপিঠে কোথাও যদি গানও বাজে, লেখাটা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। মনে হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটতে শুরু করেছে! আসলে সংগীত এক জিনিস আর সাহিত্য অন্য কিছু। আমার লেখালেখির জন্য এখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে নিস্তরঙ্গ স্থিরতা, তবে, এই কথাটি আমাকে কিন্তু বলতেই হচ্ছে যে, হোটেলের কক্ষ, মাঝে মাঝে বিমানে উড়ে যাওয়া বা কোনো বন্ধুর বাড়ি কিংবা এই ঘরটি–আমার জন্য খুব জরুরি, যেখানে প্রশান্ত নীরবতার মাঝে আমি লিখতে পারব।