চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন বলতে যা বুঝানো হয় সেই চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থায় অনেক বড় বড় ব্যক্তি নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর থেকে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও এই জেলা ক্রীড়া সংস্থার শীর্ষ পদে ছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত এই ক্রীড়াঙ্গনে তেমন রাজনীতির ছোঁয়া লাগেনি। কিন্তু একযুগে এই ক্রীড়াঙ্গনে যতটা না খেলাধুলার কার্যক্রম হয়েছে তার চাইতে বেশি হয়েছে রাজনৈতিক কার্যক্রম। বিশেষ করে গত প্রায় এক দশকে এই জেলা ক্রীড়া সংস্থা রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, রাজনীতির পাশাপাশি শালিস কেন্দ্রেও পরিণত হয়েছিল দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ক্রীড়া সংস্থাটি। ২০১১ সালের ১০ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথমবারের মত সিজেকেএস এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। আর সেটিই ছিল জেলা ক্রীড়া সংস্থায় সবশেষ বৈধ নির্বাচন। এরপরের তিনবারে কোন নির্বাচন হয়নি। গত বছর সবশেষ যে নির্বাচনটি হয়েছে তা ছিল নির্বাচনের নামে প্রহসন। সেই ২০১১ সালে আ জ ম নাছির উদ্দীন সিজেকেএস সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে শুরু হয় স্টেডিয়ামে রাজনীতির অনুপ্রবেশ। যে ক্রীড়াঙ্গনকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন পর্যন্ত।
২০১১ সালের পর আরো তিনবার সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন আ জ ম নাছির। যার তিনবারই তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলনা। আর এই তিন মেয়াদে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা এবং এম এ আজিজ স্টেডিয়াম হয়ে উঠেছিল রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। শেষ দিকের অবস্থা এমন ছিল যে, ক্রীড়াঙ্গনের লোকজনও কথা বলতে পারতেননা সাধারণ সম্পাদকের সাথে। রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন অনেক ক্রীড়া সংগঠক। রাজনৈতিক বিরোধ, জমি দখল, ঘাট দখল, জমি উদ্ধার, এমনকি পারিবারিক মামলাও নিস্পত্তি হতো এখানে। তাই খেলাধুলার বদলে একরকম রাজনৈতিক কেন্দ্র এবং শালিস কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল স্টেডিয়াম। বিশেষ করে গত তিন মেয়াদে আ জ ম নাছির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীণ সিজেকেএস এরকম আয়না ঘরের প্রতিচ্ছবি দেখেছে। যাকে ইচ্ছা কমিটিতে রাখা হয়েছে। যাকে ইচ্ছা বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি ক্লাবগুলো তাদের প্রতিনিধি কাকে পাঠাবে সে সবও নিয়ন্ত্রণ করতেন আ জ ম নাছির উদ্দিন এবং তার কিছু একনিষ্ট মানুষ। শুধু তাই নয় নিজের পছন্দের মানুষকে প্রতিনিধি করে পাঠাতে কোন কোন ক্লাব মালিককে নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। বলা যায় বড় একটা সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছিল চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা।
গত প্রায় ১২ বছরে জেলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত নানা টুর্নামেন্ট কিংবা জাতীয় পর্যায়ের যেকোন টুর্নামেন্টে আ জ ম নাছিরই একমাত্র রেজিস্টার্ড প্রধান অতিথি। আর কারো এখানে অতিথি হয়ে আসার কোন সুযোগ ছিলনা। অবশ্য এ জন্য জেলা ক্রীড়া সংস্থার কিছু তেলবাজ কর্মকর্তা দিনরাত কানে কানে ফিশ ফিশ করতেন। তিনি অবশ্য বেশ চালাক মানুষ ছিলেন। কমিটিতে তিনি বেশিরভাগই রাখতেন যারা নিয়মিত চাটুকারিতা করবেন তাদের। জি হুজুর প্রকৃতির মানুষের সমাবেশ ছিল গত দীর্ঘ ১২ বছরের চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনে। আর যারা মনে মনে হলেও ভিন্নমত অবলম্বন করতেন তারাও সে ফিশ ফিশানিদের দলে যোগ দিয়ে দেন। নিজেদের স্বার্থের জন্য সবাই শরিক হন তেলবাজদের দলে। যদিও তারা সংখ্যায় ছিলেন খুবই কম। বেশির ভাগই নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য জি হুজুর করতেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি নাছির ভাই নাছির ভাই করে জিকির তুলতেন।
গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেরে পতন হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের। সেদিনই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। আত্মগোপনে চলে গেছে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা। এরই মধ্যে গত ২১ আগস্ট ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে সারা দেশের মত চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটিও। আর তাতেই নতুন চেহারা ভেসে উঠতে থাকে গত ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে জয় বাংলা বলতে বলতে যাদের জিহবার পানি শুকিয়ে গিয়েছিল তাদের আসল চেহারা। অনেকেই এখন নব্য বিএনপি সাজার চেষ্টা করছেন। নিজেদেরকে বিএনপি পরিচয় দিচ্ছেন। আর তাদের উৎপাতে আগে যেমন খাটি আওয়ামী লীগ করা লোকজন জায়গা পায়নি আ জ ম নাছিরের আশে পাশে এখন সেই বর্ণ চোরাদের উৎপাতে জায়া পাচ্ছে না গত ১২ বছর ধরে নির্যাতিত এবং নিপীড়িত বিএনপি করা সংগঠকরা। গত ২১ আগস্ট কমিটি ভেঙ্গে দেওয়ার পর থেকে এডহক কমিটিতে ঢুকতে দৌড়ঝাপ শুরু হয়ে গেছে এসব বর্ণচোরাদের। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলের নানা পর্যায়ের নেতাদের কাছে ধর্না দিচ্ছেন যুগের পর যুগ চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনে সুবিধা ভোগ করা এসব কর্মকর্তারা। আগে যারা বাইরে এসে মাঝে মধ্যে স্টেডিয়ামে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতেন তারা এখন সবার আগে ছুটছেন রাজনৈতিক নেতাদের ঘরে। সেখানে গিয়ে নিজেদের জাহির করছেন একজন খাঁটি, দক্ষ, আদর্শবান বিএনপির নেতা বা কর্মী হিসেবে।
গতকাল বিএনপির একাধিক নেতা সিজেকেএস এর এই সব কমকর্তাদের সমালোচনা করে বলেন তারা নিজের চেয়ার ধরে রাখার জন্য আগে জয় বাংলা বলে বলে মুখে ফেনা তুলেছেন এখন পট পরিবর্তণ হওয়ার সাথে সাথে তারা নিজেদের বিএনপির একনিষ্ট কর্মী হিসেবে নিজেদের জাহির করার চেষ্টা করছেন। বিএনপির এসব কর্মকর্তারা প্রশ্ন করেন বিএনপি করার কারনে আমরা বছরের পর বছর ঘরে থাকতে পারিনি। দেশে থাকতে পরিনি। জেল কেটেছি। আমাদের ঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাহলে তারা কিভাবে বিএনপি করার পরও নির্বিঘ্নে ১২, ১৪ কিংবা ১৫ বছর কাটিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জেলা ক্রীড়া সংস্থায়। তারা কি সেদিন নিজেদের বিএনপি নেতা বা কর্মী বলে পরিচয় দিয়েছিলেন? এখন যেহেতু আওামী লীগ নেই। যে নেতার অধীনে এতদিন জি হুজুর জি হুজুর করে কাটিয়েছেন এখন যেহেতু তিনি নেই বা তারা নেই তাই এখন রং বদলালেও আর কেউ দেখবেনা। কেউ চাপ দিবে না। তাই সুযোগটা বুঝে আবারো চেয়ার দখলের চেষ্টা করছেন এসব বর্ণচোরা কর্মকর্তারা। যারা গত এক যুগেরও বেশি সময় আয়না ঘরের কুশিলব ছিলেন তারাই এখন আয়না ঘর ভেঙ্গে নিজেদের আসল চেহারা দেখাতে চেষ্টা করছেন। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনে কোন অভিজ্ঞ কিংবা দক্ষ ক্রীড়া সংগঠকের জায়গা হয়নি। হয়েছে কিছু চাটুকার, তেলবাজদের। তাই চট্টগ্রামের প্রবীণ ক্রীড়া সংগঠকদের অনেকেই এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি। তারা বলেন এখানে আর মন্তব্য করার কিছু নেই। অতীতের সে সব তেলবাজরাই হয়তো আবার চেয়ারে বসবে। কারণ তাদের কাছে চেয়ারটাই বড়। আর এই চেয়ারের জন্য তারা সবকিছুই করতে পারবে। তাই তাদের নিয়ে কথা বলতেও রুচিতে বাধে। শুধু তামাশা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে।