ইতিহাস কথা বলে–জুলুম কোনদিন চিরস্থায়ী হয় না। জুলুমকারীরা কখনো আল্লাহর পছন্দের পাত্র হতে পারে না। জালেমের অত্যাচারে নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ যখন অসহায়, যখন তাদের প্রাণ ওষ্টাগত–জালেমের অত্যাচারে মজলুমের আত্না যখন হু হু করে কাঁদে তখন আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। ঐ সময় আল্লাহ এবং মজলুমের মধ্যে কোন পর্দা থাকে না। আর ঐ অবস্থায় মহান রব মজলুমের দোয়া সরাসরি কবুল করে ফেলেন। ১৬টি বছর সাধারণ মানুষের কোন বাক স্বাধীনতা ছিল না। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে পারেনি। হক কথা বলতে ভয় পেতেন আম জনতা। মসজিদের মিম্বর থেকে খতিব সাহেবেরা হক কথা বলতে ভয় পেতেন–কখন যেন চাকুরি চলে যায়। এভাবে অপরাধের আস্তরণ যখন সীমালঙ্ঘন করেছে আল্লাহতায়ালা তখন সেটা সহ্য করতে পারেননি আর তখনি সামান্য কোটা ইস্যু দিয়ে মজলুম ছাত্র জনতার বিজয় এনে দিয়েছেন এই বাংলার জমিনে। দুর্ধর্ষ রাজা আবরাহা বাহিনী যখন কাবা ঘর ধ্বংস করতে এসেছিল তখন আল্লাহতায়ালার নির্দেশে ছোট ছোট আবাবিল পাখি দিয়ে আবরাহার বিশাল হস্তি বাহিনীকে পরাজিত করেছে, ‘তুমি কি দেখোনি তোমার মালিক (কাবা ধ্বংসের জন্য আগত) হাতিওয়ালাদের সাথে কি ব্যবহার করেছেন? তিনি কি (সেদিন) তাদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেননি? তিনি তাদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি পাঠিয়েছেন, এই পাখিগুলো তাদের উপর পাথরের টুকরো নিক্ষেপ করছিল, অতপর তিনি তাদের জন্তু জানোয়ারের চর্বিত (ঘাসপাতা) এর মত করে দিলেন’ সূরা– ফিল– ১–৫। রাষ্ট্রযন্ত্র ধ্বংসের মহোৎসবে পরিণত করেছিল এদেশের শাসকরা। সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে অকার্যকর করে তুলেছিল। যেমন: বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা–সব কয়টি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দিয়েছিল এদেশের শাসকগোষ্ঠী। যদিও দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন হয়েছিল এদেশে। রাস্তাঘাট, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপেসওয়ে, সাবওয়ে, ফ্লাইওভার, টানেলসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নের অংশীদার হয়েছে এদেশের জনতা। হ্যা,ঁ এসবের জন্য সদ্য পদত্যাগী সরকার প্রশংসার দাবী রাখে বটে। দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, সে উন্নয়নের বিপরীতে আমরা পেয়েছি ন্যায়বিচারহীনতা, দেশের ৮ কোটি ভোটার ভোট দিতে না পারার চরম হতাশা, প্রাণ খুলে কথা বলতে না পারার বেদনা, সত্য ও হক কথা বলতে গেলেই কারারন্তীন হওয়ার আশংকা, মিডিয়াগুলোতে কোরআন হাদীসের কথা বলার কারণে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আশংকা, মাঠে ময়দানে আল্লাহর কোরআনের আওয়াজ তুলতে গেলেই চরম বাধা, মারধর, হত্যার ষড়যন্ত্র, কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে বছরের পর বছর অবস্থান ইত্যাদি। দেশ থেকে লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে একথা বলতে গেলেই গুম করে ফেলা যেন নিত্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর এই জন্যেই দীর্ঘ ১৬ টি বছর সাধারণ আম জনতার পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরাও ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। আর এদিকে চরম বৈষম্যের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছিল। মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকুরীতে নিয়োগ না দিয়ে কোটা ভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে এই ক্ষোভ, এই হতাশা চরমে উঠেছে যার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ ২০ দিন উত্তাল ছিল এই বাংলার জমিন। গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল সেই বিক্ষোভ। সারা বাংলাদেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিল। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে অভিভাবক, সাধারণ জনতা আর এই ছাত্র জনতাকে দমাতে গিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বেছে নিয়েছে ভয়ংকর পদক্ষেপ। শত শত ছাত্রকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অনেক লাশ গুম করা হয়েছে। অনেক লাশের হদিস পাওয়া যায়নি। সরকারের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। আর এই ফলশ্রুতিতে জনরোষের শিকার হয়ে সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে। ১৬ বছরের অপশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে নির্যাতিত মজলুম জনতা। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত–রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা জুলুম করা থেকে বিরত থাক। কেননা জুলুম কেয়ামতের দিন অন্ধকারাচ্ছন্ন ধোঁয়ায় পরিণত হবে। তোমরা কৃপণতা ও কলুষতা থেকে দূরে থাক। কেননা কৃপণতা তোমাদের পূর্বের অনেক লোককে ধ্বংস করেছে। কৃপণতা তাদের রক্তপাত ও মারামারি করতে প্ররোচিত করেছে। এবং হারামকে হালাল করতে উস্কানি দিয়েছে’ (মুসলিম ৬৩৪০)। অন্য একটি হাদীসে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। কিন্ত যখন তিনি তাকে গ্রেপ্তার করেন তখন আর ছাড়েন না। অতঃপর নবী করিম (সাঃ) এই আয়াতটি পাঠ করলেন, ‘আর তোমার রব যখন কোন জালিম জনবসতিকে পাকড়াও করেন তখন তাদের পাকড়াও এমনিই হয়ে থাকে। তার পাকড়াও বড়ই কঠিন, নির্মম ও পীড়াদায়ক’ (বুখারী– ৪৩২৯)। আল্লাহতায়ালা উদ্ধত অহংকারীকে কখন পছন্দ করেন না। হযরত লোকমান তাঁর বৎসকে যে নসিহত করেছেন তা তিনি তাঁর কোরআনে কোড করেছেন এভাবে, ‘(হে বৎস) কখনো অহংকারবশে মানুষদের জন্য তোমার গাল ফুলিয়ে রেখে তাদের অবজ্ঞা কর না এবং আল্লাহর জমিনে কখনো ঔদ্ধ্যতপূর্ণ বিচরণ কর না, অবশ্যই আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক ঔদ্ধ্যত অহংকারকারীকে অপছন্দ করেন’ সূরা – লোকমান– ১৮। হযরত নূহ জাতি আল্লাহর উপর ঈমান আনেনি। তাদের অপরাধের মাত্রা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, হযরত নূহ তার জাতিকে ধ্বংস করার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন করেছে। পরে তাদেরকে সীমালঙ্ঘনের কারণে পানিতে নিমজ্জিত করেছে এবং সেখান থেকে আগুনের গর্তে নিক্ষেপ করেছে। এই জাতির সীমালঙ্গনের ব্যাপারে আল্লাহর কোরআন বলছে, ‘(নবী নূহের সময়) যখন পানি সীমা অতিক্রম করল তখন আমি তোমাদের নৌকায় উঠিয়ে নিয়েছিলাম’ সূরা– হাক্কাহ – ১১। অন্য একটি আয়াতে হযরত নূহের যে দোয়াটি আল্লাহর কাছে পেশ করেছিলেন সেটি হল, ‘হে আমার রব তুমি আমাকে, আমার পিতা–মাতাকে, তোমার উপর ঈমান এনে যারা আমার সাথে এই ঘরে আশ্রয় নিয়েছে, এমন সব ঈমানদার পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষমা করে দাও, জালেমদের জন্য চূড়ান্ত ধ্বংস ছাড়া কিছুই তুমি বৃদ্ধি কর না’–সূরা নূহ–২৮। আল্লাহর এই জমিনে অনেক গৃহহীন মানুষের থাকার জায়গাটুকু পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে প্রভাবশালী জালেমরা। তাদের জন্যে কড়া বার্তা রয়েছে, ‘হযরত সায়েদ ইবনে জায়েদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত–তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে জুলুম করে অপরের এক বিঘা জমিও আত্নসাৎ করবে, কেয়ামতের দিন তার গলায় সাত তবক জমি ঝুলিয়ে দেওয়া হবে’ (সহীহ বুখারী–২৯৭১)। আর এদিকে অহংকারীর জন্য রয়েছে বড় বার্তা। আল্লাহর কোরআন বলছে, ‘এখন যাও দোযখের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়। সেখানেই তোমাদের চিরকাল থাকতে হবে। অহংকারীদের জন্য তা বড়ই মন্দ ঠিকানা’ সূরা– নাহল– ২৯। হযরত আবু দাউদের একটি হাদীস, ‘হযরত হারেসা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, অহংকারী ও অহংকারের মিথ্যাবয়ানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’ (আবু দাউদ – ৪৪২৬)। আল্লাহর এই জমিনে অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছে শুধুমাত্র দম্ভ আর সীমালঙ্ঘনের কারণে। ফেরাউন জাতি, লুত জাতি, নুহ জাতি, নমরুদ জাতি এভাবে অনেক জাতিকে আল্লাহতায়ালা ধ্বংস করেছেন আল্লাহতায়ালার অবাধ্য হবার কারণে। দাম্ভিকতার কারণ, অহংকারের কারণ আর দাম্ভিকতার পরিণাম আজকের এই বাংলাদেশ।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল