দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গতকাল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন সাবেক অধিনায়ক এবং প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। গতকাল দায়িত্ব নেওয়ার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিসিবির নতুন বস বললেন সততার সঙ্গে কাজ করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই। কাজ করার অনেক জায়গাও দেখছেন তিনি। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়কের বিশ্বাস, দেশ ও দেশের ক্রিকেট দলকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলে সব কাজই সহজ হয়ে উঠবে। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব পালন করার পর গতকাল বুধবার পদত্যাগ করেন নাজমুল হাসান। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে বিসিবির জরুরি সভায় নতুন সভাপতি হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয় ফারুক আহমেদকে। সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর সভায় উপস্থিত বিসিবি পরিচালকদের সামনে বক্তৃতা দেন ফারুক। তিনি বলেণ
আমার নতুন দায়িত্ব। চেষ্টা করব সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে। একটা জিনিস সবার মাথায় যদি আপনারা ঢুকিয়ে নেন, সবার আগে যদি দেশটার কথা চিন্তা করেন আমাদের বাংলাদেশ এবং এরপর বাংলাদেশ দল, তাহলে কিন্তু অনেক জিনিস সহজ হয়ে যাবে আপনাদের জন্য। কি হয়েছে না হয়েছে, আমরা সবাই জানি। এখন ভাবতে হবে আজকে এবং ভবিষ্যতের কথা।
সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন আগের বোর্ডের বিতর্ক ও প্রশ্নকে পেছনে ফেলে দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় শোনালেন তিনি। লক্ষ্য তো অনেক বড়। প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য দেশের সম্মান বৃদ্ধি করা। দেশের মুখ উজ্জ্বল করা। পাশাপাশি দলকে একটা জায়গায় দেখতে চাই। এটা তো অনেক বড় একটা ব্যাপার। অনেক জায়গায় আমাদের কাজ করতে হবে। অনেক দিন ধরে কাজ হয়েছে কি হয়নি, অনেক প্রশ্ন আছে। তবে আমাদের প্রথম ও প্রধানতম দায়িত্ব হচ্ছে ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরকার পতনের গণআন্দোলনে রূপ নেওয়া অভ্যুত্থানে প্রাণ দেওয়া সবার প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করে শুরু হয় সংবাদ সম্মেলন। তিনিই প্রথম সাবেক ক্রিকেটার, যিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ এই পদে বসলেন। ক্রিকেটার হিসেবে তার ক্যারিয়ার ছিল দেড় যুগের বেশি। দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৯৯৩ আইসিসি ট্রফিতে। দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে। পরে প্রধান নির্বাচক হিসেবে কাজ করেছেন বোর্ডে। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এখন তিনি বিসিবি সভাপতি।
নতুন সভাপতি বলেন আমি অত্যন্ত গর্বিত। খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। আমার খেলোয়াড়ি জীবন থেকে ধরলে, ১৯৮২ থেকে আজকে ২০২৪ সাল, ৪২ বছরের বেশি হবে আমি ক্রিকেটে সম্পৃক্ত। নিজের প্রতিক্রিয়া জানানোর পরই ফারুক বললেন, দেশের ক্রিকেট পরিচালনার পদ্ধতি তিনি নতুন করে সাজাতে চান। বাংলাদেশের মতো সম্ভাবনাময় একটা দেশের যতটা করার দরকার ছিল আমরা ততটা পারিনি। আমাদের সাফল্য একদম কম নেই। তবে সুনির্দিষ্টি কিছু জায়গায় আমাদের আরও উন্নতি করার দরকার ছিল। যা আমরা পারিনি। আমাদের দায়িত্ব হবে এই সিস্টেমটাকে পুনর্গঠন করা। অনেক সময় অনেক কাজ করা যায় ন। অনেক বাইরের চাপ থাকে। আশা করব এবার আমি সভাপতি থাকার অবস্থায় যতটুকু সম্ভব এটা সুন্দর সিস্টেম দাঁড় করাতে চাই। নিজের অতীত টেনেও এখানে উদাহরণ তুলে ধরলেন ফারুক। ২০১৬ সালে যখন দ্বি–স্তর বিশিষ্ট নির্বাচক কমিটি গঠন করে প্রধান নির্বাচকের গুরুত্ব কমানো হয়েছিল। তখন এটির প্রতিবাদে এবং আরও বেশ কিছু অভিযোগ করে প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছিলাম। এখন তিনিই যখন বোর্ডের সর্বোচ্চ ব্যক্তি তখন মূল জায়গায় হাত দিতে চান।
বোর্ডের গঠনতন্ত্র বদলানো হবে বলে জানালেন ফারুক আহমেদ। বোর্ড পরিচালক ও সভাপতি হওয়ার বর্তমান পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিলেন তিনি। তার লক্ষ্য, সত্যিকারের ক্রিকেটপ্রেমী মানুষগুলোই যেন বোর্ডে জায়গা পেতে পারেন। বোর্ড পরিচালকদের জন্যও পরিষ্কার বার্তা তিনি দিয়ে রাখলেন। সত্যিকার অর্থেই যারা ক্রিকেট ভালোবাসে এবং ক্রিকেটের জন্য কিছু করতে চায়, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। ১৮ কোটি মানুষের দেশে, আমাদের খেলোয়াড়, দর্শক, সংবাদমাধ্যম, সবাই এত বেশি খেলাপাগল ও ক্রিকেটপাগল, সেখানে অনেক উপাদান ঢুকে যায় এবং ক্রিকেট বোর্ড অনেক গ্ল্যামরাস হয়ে যায়। সবাই এটার অংশ পেতে চায়। আমি চাইব আমাদের প্রথম প্রাধান্য হবে ক্রিকেটের উন্নতি। যাদের কাজ করার আগ্রহ কম অথচ শুধু বোর্ড পরিচালক হিসেবে থাকতে চায় এই পরিচয় আসলে গর্ব করার মতো কিছু হবে না। তাদের কাছ থেকে আশা করব যারা সবাই দারুণ সামর্থ্যবান। তারা যদি একটু চেষ্টা করে, সময় দেয়, আমার মনে হয় ভালো একটা জায়গায় আমরা যেতে পারব। নাজমুল হাসানের সময়ে গত এক যুগে বোর্ডে আর্থিক অনিয়ম, কমিশন বাণিজ্য, সিন্ডিকেট গড়া, প্রশাসনিক নানা অনিয়মসহ অনেক অভিযোগ উঠেছে বারবার। ফারুক জানালেন, এসব দিকে তার বিশেষ দৃষ্টি থাকবে। প্রতিটি সেক্টরে বাংলাদেশে এমন দুর্নীতি হয়েছে এটা আমরা সবাই জানি। আমরা সবাই বাংলাদেশের মানুষ। প্রতিটি সংস্থায় যে দুর্নীতির কথা শুনেছি, ক্রিকেট বোর্ড এটির বাইরে নয়। যদি এরকম কিছু থাকে, অবশ্যই আমরা খোঁজ নেব। দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। কেউ যদি এটা বলে, আমি বিশ্বাস করব না। তবে একটা সিস্টেম চালু করতে হবে, যেখানে এসব দুর্নীতি আমরা কমাতে পারব। আমার মেয়াদ কতদিন হবে জানি না। তবে আপনাদেরকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমার সময়কাল যতদিন থাকবে, ততদিন সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে এই জিনিসগুলোর খেয়াল রাখা।
আমরা প্রথমেই মাইক্রো–ম্যানেজমেন্টে যাব না। যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, যেমন জাতীয় দলের খেলা বাদ দেওয়া যাবে না। জাতীয় দল প্রাধান্য পাবেই। সঙ্গে গেম ডেভেলপমেন্ট, এইচপি (হাই পারফরম্যান্স), ফ্যাসিলিটিজ, গ্রাউন্ডস, এই ধরনের চার–পাঁচটা জায়গা আছে, যেগুলো ক্রিকেটের উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব জায়গায় ফোকাস করতে হবে। তিন–চার বছর পরও যাতে আমাদের বলতে না হয় যে, ঘরোয়া ক্রিকেটে উন্নতি করতে হবে বা পিচ ভালো করতে, এইচপি দল ভালো করতে হবে বা ‘এ’ দলের সফর বেশি করতে হবে। আমরা সবাই চেষ্টা করব। অনেক পারিপার্শ্বিক ব্যাপার থাকে। যারা কাজ করেছেন, তাদের অনেকের ইচ্ছা করলেও অনেক কিছু হয়নি। আবার অনেকের ইচ্ছাও ছিল না। তবে আমরা চেষ্টা করব।