চিন্তা ও কর্মে যিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, মানবব্রতী ও আধুনিক

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ২০ আগস্ট, ২০২৪ at ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ

বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হককে আমরা হারিয়েছি গত ২৫ জুলাই। তাঁকে হারিয়ে আমার মনে হয়েছে আমরা প্রকৃত এক অভিভাবককে হারালাম, হারালাম জ্ঞানসাধনায় আজন্ম নিমগ্ন একজন বহুমাত্রিক মানুষকে। তিনি ছিলেন একাধারে গবেষক, ভাষাবিদ, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সমালোচক, সম্পাদক, ফোকলোরিস্ট ও শিক্ষাবিদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। কুমিল্লা সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। অধ্যাপনার পাশাপাশি প্রায়োগিক বাংলা ও ফোকলোর চর্চা, গবেষণা, সম্পাদনা, অনুবাদ ও পাঠ্যবই রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন দেশেবিদেশে। বাংলাদেশ, ভারত ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অর্ধশতাধিক বই। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ নানা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাঁর। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নজরুল পদক, মধুসূদন পদক, চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা।

মৃত্যুর পর ড. মাহবুবুল হককে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর ঘনিষ্টজনরা নানাভাবে শোক প্রকাশ করেছেন। অভিমত দিয়েছেন, মূল্যায়ন করেছেন। বলেছেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। শিল্পসাহিত্যশিক্ষাসংস্কৃতিরাজনীতি তথা বাঙালির সামগ্রিক যাত্রায় তিনি ছিলেন এক প্রাগ্রসর পথিক। প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চায় দেশের একজন সংগ্রামী মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে তিনি সমাসীন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সদা জাগ্রত ও অবিচল থেকেছেন। প্রগতিশীল শিক্ষাসমাজসভ্যতা তথা মানব মুক্তি ও মানব বিকাশে তিনি ছিলেন সতত সক্রিয়। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও অপরিসীম ধৈর্য ও মনোবলের সাথে তিনি নানা সামাজিকসাংস্কৃতিক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাজে যথাসাধ্য বিচরণশীল ছিলেন।

বরেণ্য ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক পবিত্র সরকার তাঁর টাইমলাইনে লেখেন, “দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার একটা নেতিবাচক দিক হল বয়সে যারা ছোট তাদের মৃত্যু দেখা ও শোনা। আমার সেই কোটা অব্যাহত আছে। আমি ঢাকার বাংলা একাডেমিতে বাংলা ব্যাকরণ সম্পাদনার সময় সহকারী হিসেবে যাদের বিপুল সহায়তা পেয়েছিলাম, তাদের একজন ছিলেন ড. মাহবুবুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ও পরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। যেমন বিদ্বান ছিলেন তেমনই ছিলেন সদাপ্রস্তুত মানুষ। তাঁর সাইডব্যাগে কত কী থাকত, আঠা, কাঁচি, স্কেল ইত্যাদি। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন, তবু একজন গুণী মানুষ আমার আগেই চলে গেলেন।”

অধ্যাপক মাহবুবুল হক চট্টগ্রামে অবস্থান করেও জাতীয় মানের কাজই উপহার দিয়েছেন। বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য অঙ্গনে তিনি পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত। তাঁর পরিচিতি বিভিন্ন পরিসরে পরিব্যাপ্ত। লেখালেখি, সম্পাদনা, শিক্ষকতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর কৃতিত্ব ও প্রয়াস তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সামগ্রিকভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায় যে অবদান রেখেছেন, তারজন্য তিনি সম্মানিত হয়েছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির গবেষণায় যে কৃতিত্ব তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, তা এককথায় অসামান্য ও অতুলনীয়। চট্টগ্রামবাসী এজন্য তাঁর কাছে ঋণী।

. মাহবুবুল হকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত শ্রদ্ধার। দীর্ঘদিন ধরে আমি তাঁর সাহচর্য লাভ করেছি। চিন্তা ও কর্মে অসাম্প্রদায়িক, মানবব্রতী ও আধুনিক এই মানুষটি আমাকে সবসময় নানা বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। আমি প্রত্যক্ষ করেছি তাঁর শুভবোধ। দেখেছি, . মাহবুবুল হকের মধ্যে সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য ছিল গভীর মমত্ববোধ। কাজের প্রতি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সততার গুণে তিনি পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন এমন এক স্থানে, যা অনেকের জন্য কঠিন। তাঁর মেধার সঙ্গে সমন্বয় ঘটেছে তাঁর শ্রম। বাংলাদেশে একজন মানুষের জীবিত অবস্থায় তিন তিনটি সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশ চাট্টিখানি কথা নয়। ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কার প্রদান উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয়েছিল ‘মাহবুবুল হক সম্মাননাগ্রন্থ’। এর প্রচ্ছদ করেছিলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী। ২০১৮ সালে তাঁর ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয় আরেকটি সম্মাননা গ্রন্থ ‘একাত্তরে মাহবুবুল হক’। এটির প্রচ্ছদ করেছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ। এরপর ২০২৩ সালের নভেম্বরে তাঁর ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষ থেকে আয়োজিত হয়েছিল ‘ড. মাহবুবুল হক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান’। এতে প্রকাশ করা হয়েছে একটি সংবর্ধনাগ্রন্থ। নাম : ‘মাহবুবুল হক সংবর্ধনাগ্রন্থ’। এটির প্রচ্ছদ করেছেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী দীপক দত্ত। আমার সৌভাগ্য, সব কটি সম্মাননা গ্রন্থের সম্পাদক ছিলাম আমি। গ্রন্থগুলোতে বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন যশস্বী লেখকের লেখা সংকলনভুক্ত করার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। লেখকরা অধ্যাপক মাহবুবুল হকের সৃষ্টিকর্ম ও জীবনের বিভিন্ন দিকে আলোকপাত করার প্রয়াস পেয়েছেন। বলা যায়, তাঁদের পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বড় উপহার। ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ‘মাহবুবুল হক সংবর্ধনাগ্রন্থ’ প্রকাশনায় প্রাবন্ধিক শাকিল আহমদ ও নিজামুল ইসলাম সরফী আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। তাঁরা সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাবন্ধিক নিজামুল ইসলাম সরফী পাঠকের সঙ্গে ড. মাহবুবুল হকের দুর্লভ সংগ্রহশালার পরিচয় করে দিয়েছেন তাঁর এক লেখার মাধ্যমে। মাহবুবুল হকের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে বিভিন্ন রচনাবলি, যেমন মুহাম্মদ এনামুল হক রচনাবলি, বঙ্কিম রচনাবলি, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ রচনাবলি, রমেশশীল রচনাবলি, রবীন্দ্র রচনাবলি, নজরুল রচনাবলি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনাসংগ্রহ ইত্যাদি। লাইব্রেরিতে আছে জাতীয় চরিতাবিধান যেটিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন মনীষীর জীবন চরিত উল্লেখ আছে। বিজ্ঞান জাতীয়, শিক্ষা বিষয়ক, সোভিয়েত সাহিত্য, বিভিন্ন দেশের ভাষা শিক্ষার বই।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সমাজ প্রগতির অবিনশ্বর নিরন্তর লড়াইয়ের অকুতোভয় সংগ্রামী ও এ দেশের শিক্ষাশিক্ষক আন্দোলনের একজন নেতা হিসেবে মূল্যায়ন করেন কলামিস্ট অধ্যাপক কানাই দাশ। তিনি বলেন, ছাত্র জীবন থেকেই প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির একজন নেতা হিসাবে, একজন বৈজ্ঞানিক বিশ্ব দৃষ্টি সম্পন্ন সচেতন সমাজ চিন্তক ও বোদ্ধা পাঠক হিসাবে একটি বিষয়ে তাঁর স্থির প্রতিজ্ঞ প্রতীতি জন্মে যে সর্বজনীন, বিজ্ঞান মনস্ক ও ইহজাগতিক ভাবনায় ঋদ্ধ একটি শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া, একটি মুক্ত জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ ছাড়া কোন জাতির প্রকৃত অগ্রগতি সম্ভব নয়। বৌদ্ধিক সমৃদ্ধিই একটি জাতির প্রকৃত সমৃদ্ধি। তিনি বিশ্বাস করতেন জীবন ও জগতের পরিদৃশ্যমান প্রপঞ্চগুলোর সতত পরিবর্তন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কৌতূহল জাগিয়ে তোলা, অবাধ জিজ্ঞাসা ও সংস্কারমুক্ত পরিবেশে শিক্ষার্থীর এই কৌতূহলের যথার্থ উত্তর দেওয়াই হল প্রকৃত শিক্ষার স্বরূপ। প্রকৃতির প্রাসাদে অনুক্ষণ বিবর্তিত আমাদের জীবন ও জগতের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাকেও অবশ্যই হতে হবে সতত পরিবর্তনশীল জীবন ও প্রকৃতি ঘনিষ্ঠবিজ্ঞান বিরোধী কোনো স্থির অতিন্দ্রীয় কল্পনা কেন্দ্রিক নয়। এ বোধ থেকেই তিনি জীবনের নানা পর্বে ভিন্ন ভিন্ন মঞ্চে দাঁড়িয়েও মূলত একটি পরিবর্তনশীল বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি, উন্নত জীবন বোধ ও সাম্যের সমাজ বিনির্মাণের কায়িক, মানসিক ও বৌদ্ধিক সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন একে ঋদ্ধ করেছেন সৃজনশীল কর্মকুশলতার অনন্য নৈপুণ্যে। কৃতী ও কীর্তির জন্য এই মানুষটি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;

ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজ্বালানি সেক্টরে নজর দেওয়া জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধদেশের কোন বিশেষ এলাকার জনগণকে পিছিয়ে রাখা হবে না : সুপ্রদীপ চাকমা