স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় আসা হলো। দীর্ঘ দিন ধরে আসবো আসবো করে যেসব ভাবনা মাথায় ঘুরপাক করছিলো, সেই সাধ পূরণ করার সুযোগ ঘটলো। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট–এ আমরা আছি আমাদের বড় ছেলের বাড়িতে। নানা ধরনের ভালো লাগা নিয়ে আমাদের দিন যাপন শুরু হলো। এরই ফাঁকে স্বপ্নের আমেরিকা দেশটি নিয়ে একটু জানার চেষ্টা করছিলাম, যেমন আমেরিকার বিভিন্ন আয়তনের বায়ান্নটি স্টেট নিয়েই সমগ্র আমেরিকা অবস্থিত। ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যটি, যুক্তরাষ্ট্রের ৫২ টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে একটি।
আয়তনের দিক দিয়ে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম রাজ্য হলো আলাস্কা, যার আয়তন হলো ৫৭১,৯৫১.২৬ বর্গমাইল, দ্বিতীয় বৃহত্তম হলো টেক্সাস, যার আয়তন ২৬১,৭৯৭.১২ বর্গ মাইল, আর তৃতীয় বৃহত্তম হলো ক্যালিফোর্নিয়া, যার আয়তন ১৫৫,৯৫৯.৩৪ বর্গ মাইল। এখানে কিলোমিটারে হিসেব করা হয় না, মাইলকেই একক ধরা হয়। তবে ক্যালিফোর্নিয়া জনসংখ্যা ও অর্থনীতির দিক দিয়ে সর্বাগ্রে। যুক্ত্রাষ্ট্রের অন্যান্য স্টেট থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষের বসবাস এই ক্যালিফোর্নিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ এবং সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় রাজ্যগুলির একটি। শিক্ষাক্ষেত্রেও এই অঙ্গরাজ্যের মান অন্যান্য অঙ্গরাজ্য থেকে এগিয়ে রয়েছে।
১৮৫০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সমঝোতার অংশ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়া একটি স্বাধীন অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়, তাই সমগ্র ক্যালিফোর্নিয়ায় ৯ সেপ্টেম্বর ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানীর নাম ‘সেক্রোমেন্টো’। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটকে গোল্ডেন স্টেট নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের মধ্যে অবস্থিত ঐতিহ্যগত সমৃদ্ধ এবং পর্যটক আকর্ষণীয় শহরের মধ্যে সানফ্রান্সিসকো, লস এঞ্জেলস, সান দিয়াগো, সান্টা বারবারা, সান জোস, পাম স্প্রিং ও সেক্রোমেন্টো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বসতি এলাকা হিসেবেও এসব শহর সুপ্রসিদ্ধ। শুধু পর্যটন এলাকা হিসেবে ঐতিহাসিক কিছু স্থান রয়েছে যেমন–ইয়োচিমাইট ন্যাশানেল পার্ক, জোসুয়া ট্রি ন্যাশন্যাল পার্ক, (জাতীয় উদ্যান), ডিজনিল্যান্ড পার্ক, এবং আইকনিক গোল্ডেন গেট ব্রীজ, ও চায়না টাউন ইত্যাদি। এটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করে নিলাম আমাদের ঘোরাঘুরির অনুসঙ্গ হিসেবে যাতে একবারে অঘা হয়ে থাকতে না হয়।
আমরা যেখানটায় আছি অর্থাৎ ছেলের বাসা বা বাড়িটা হলো সানফ্রান্সিসকো শহর থেকে দুশ মাইল দূরে ম্যান্টেকা নামক জায়গায়। এর আশে পাশে কোনো ধরনের দোকান বা শপিং মল নেই, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হলেও দূরের শপিং মল থেকে আনতে হয়। না থাকার কারণ হলো এখানের নিয়ম যেখানে সেখানে শপিং মল দেওয়া যাবে না। তাছাড়া যেহেতু মলে দূর দূরান্ত থেকে মানুষের সমাগম হয়, তাই শপিং মলের সামনে বিরাট একটা মাঠ থাকতেই হবে, বিরাট মানে আমাদের প্যারেড গ্রাউন্ডের মতো, বা কোনো কোনো জায়গায় তার চেয়ে কিছুটা ছোটো। কারণ গাড়ি রাখার ব্যবস্থাটা আগে থাকতে হবে, গাড়ি ছাড়া তো কোনো মানুষ নেই, তাই আগে গাড়ির পার্ক তারপর শপিং মল। শনিবার বিশ্রাম নিয়ে রবিবার সকাল বেলা, সাপ্তাহিক ছুটিতে ছেলে–বৌমা বাজার করে। তাই তাদের সাথে আমাদের প্রথম ঘোরাঘুরি আরম্ভ করলাম। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে আমাদের তো ঘোরাঘুরিই কাজ। আজ বৌমার গাড়ি তাই বৌমা ড্রাইভিং সীটে। বাজার করা মানে তাও শত মাইল দূরের একটি দোকান, শপিং মলটার নাম ‘কস্টকো হোল সেল’ সুসজ্জিত রাস্তা দিয়ে রাস্তার দুপাশের ঝাউ, পাইন গাছের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে এবং সুশৃঙ্খলগাড়ির সারিতে নীরব জনমানব শূন্য রাস্তা, কোথাও কোনো ট্রাফিকও নেই, এমন বিস্ময় অনুভবের ভিতর, সোয়া এক ঘণ্টায় মলে পৌঁছলাম। মলটা আমাদের বাংলাদেশের ‘স্বপ্ন’ বা ‘বেস্ট বাই’ এর মত যে কোনো সুপার শপের মতো তবে এখানে সবকিছু মানে কাপড় চোপড়, রান্নার সামগ্রী সহ ফূল থেকে আরম্ভ করে শাক সবজি মাছ মাংস, বিস্কুট চাল, ডাল, তেল নুন, কসমেটিঙ সব আছে।
বৌমা ও ছেলে প্রথমেই আমাদেরকে নিয়ে জামা কাপড়ের সেগমেন্টে ঢুকলো, আমাদের জন্য তাদের পছন্দমতো এবং আবহাওয়া উপযোগী পোশাক কিনতে হবে নাকি, আমরা যতই বলি আমাদের প্রচুর পোশাক আছে, তারা বলে, না এসব নাকি এখানে পড়া যাবে না অর্থাৎ পড়লে নাকি অসুস্থ হয়ে যাবো, তাই মানতে হলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও অগ্নিমুল্য খরচ করে দুই সেট করে দুজনের জন্য চার সেট জামা কাপড় কেনা হলো। মুলত এসব শীতকালীন কাপড়। পোশাকগুলোর মূল্য দেখে হতাশ হয়ে গেলাম। বাংলাদেশে এর চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ কম মূল্যে কিনতে পারতাম, আসলে অভিজ্ঞতা ছিল না যে এরকম পোশাক পড়তে হবে। যাক খুব খারাপ লাগছিল, আর ভাবছিলাম ধনী দেশের উচ্চতর মূল্যের কারিশমার কথা। সবকিছু এখানে ভালো কিন্তু জিনিস পত্রের ক্রয়মূল্য ভাবনার বাইরে, তাইতো বলা হয়ে থাকে ব্যয়বহুল অঙ্গরাজ্য। বৌমা আর তেমন কিছু কিনলো না, কিছু বিস্কিট ও চা পাতা কিনেই অনলাইন পেমেন্ট করে চেকার কে রশিদ দেখিয়ে বের হয়ে আসলাম। এখানে চা পাতা সুলভে পাওয়া যায় না, অনেক চড়া মূল্যে সংগ্রহ করতে হয়, কারণ চা পাতা নাকি এখানে উৎপন্ন করা যায় না। কফি খুব সহজলভ্য, তুলনামূলকভাবে দামও কম। প্রায় সব মানুষের কাছে কফিই সাধারণ পানীয়।
শপিং মল থেকে বেড়িয়ে সামনে একটি ইন্ডিয়ান খাবারের রেস্টুরেন্ট এ আমাদেরকে নিয়ে আসলো, ঐ একই কম্পাউন্ডে, চারদিকে খেয়াল করে দেখলাম পার্কটাকে ঘিরে ভিন্ন ভিন্ন দেশের রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যেমন–চায়নিজ, থাই, পাকিস্তানি, ফ্রেন্স, আফ্রিকান আর আমেরিকান তো আছেই, ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে বাঙলা খাবার তৈরী হয়। তখন লাঞ্চের সময়। ছেলে বৌমা নাকি প্রতি রোববার দুপুরে এখানেই লাঞ্চ করে। কিন্তু ঢুকেই দেখলাম প্রচণ্ড ভীড়, আমি বের হয়ে যেতে চাওয়াতে একজন ইয়াং ছেলে আমাকে জায়গা করে দিয়ে নিজে উঠে যেতে চাইল, আমি তাকে বাধা দিতেই, সে বললো, ‘নো প্রোবলেম’ ইউ ক্যান ইউস দিস, থ্যাঙ্ক ইউ বলে, আমি বসে পড়লাম। বাকীরা একটু বাইরে অপেক্ষা করেই পড়ে ঢুকলো, ছেলেটা ইন্ডিয়ানই হবে, কেননা সে বন্ধুদের সাথে কখনো ইংরেজী কখনো হিন্দিতে কথা বলছিল, ইয়াং ছেলেটা দাঁড়িয়েই খাবার শেষ করলো, দুমিনিট পরেই বেড়িয়ে গেল। মনে মনে ছেলেটিকে আশীর্বাদ করলা্ম গুরুজনদেরকে সম্মান করা এই ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কার ও শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে গেল ‘বিদ্যা আবরণে, শিক্ষা আচরণে’’।
চারজনকে এক টেবিলে বসার ব্যবস্থা করে দিলেন রেস্টুরেন্ট মালিক, মালিক মানে ইণ্ডিয়ান, আমার ছেলের বয়সের মতোই হবে, কী দক্ষ হাতে এবং সুচতুরতার সাথে জমজমাট ব্যবসা চালাচ্ছে। আসলে কাজ জানা এবং কাজকে ভয় না করে, করে যাওয়ার একাগ্রতার কোনো বিকল্প নেই, ভদ্রলোক ইংরেজী, হিন্দি, বাংলা সব ভাষাতেই সাবলীল, আমাদের পছন্দমতো খাবার তড়িত গতিতে সার্ভ করে দিল। এখানের খাবারটা খেয়ে দাম ও খাবারে মান উভয়ই ভালো লাগলো। খাবারটা বেশ ভালো পরিমাণও অনেক বেশি ফলে সব খেতে না পারাতে আমি দুঃখ করছিলাম, বৌমা বললো’, কোনো অসুবিধা নেই মা,’ বাকী খাবার ওরা পেক করে দিয়ে দেবে’। ঠিকই বাকী খাবার পেক করে আমাদের টেবিলে রেখে দিল। বলতে হয়নি, আমাদের দেশেও এখন এটা চালু হয়েছে, তবে বলতে হয়, তবেই দেয়, এবার খাওয়া শেষ করে, গাড়িতে এসে বসলাম।
গাড়ির ড্রাইভিং সীটে আমার ছেলে বসে আমাদের অসুবিধা হচ্ছে নাকি জিজ্ঞেস করলো,তাদের নাকি অন্য আর একটি মলে যেতে হবে, মাছ মাংস কেনার জন্য। আমরা বললাম, আমাদের অসুবিধা হবে কেনো আমাদের তো ঘোরাঘুরি আর চারদিকের দৃশ্য দেখা, মানে আমেরিকা দেখাই কাজ, বলতে বলতে গাড়ি ১০ মিনিট চালিয়েই ছোট্ট একটা দোকানে ঢুকলাম, লাইন ধরে প্রবেশ করলাম। এটাও ইন্ডিয়ান দোকান, এখানে আসলে মাছ ও মাংসের আড়তের মতো করে রেখেছে, আবার ইন্ডিয়ান এবং বাংলাদেশি খাবার মশলা খই, মুড়ি, চিড়া, দই, মিষ্টি, আতপ চাল, পপকর্ন, ফুচকা সব খাবার আছে, আমার ছেলে আমাকে মাছের শেলফে নিয়ে গিয়ে বললো, মা কী কী মাছ এবং কোনটা কোনটা নিব পছন্দ করো, আমি তো অবাক হয়ে এক একটা মাছের আকার দেখে বিস্মিত। আমি অতিরিক্ত খরচের কথা ভেবে ইতস্তত করছিলাম, তখন ছেলে আমাকে বোঝাল যে এই ক্যালিফোর্নিয়ায় ইন্ডিয়া থেকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাছ আমদানি হয়, এখানের ইলিশগুলো প্রচণ্ড স্বাদ, যা বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যাবে না, আরো বললো ক্যালিফোর্নিয়া আসার আগে মাছ আর মাটন খাওয়া হয়নি কারণ ঐসব স্টেটে মাছ ও মাটন পাওয়া যেত না, কিন্তু এই ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রচুর মাছ পাওয়া যায়, আর ভারত আমেরিকার বাজারে সবচেয়ে ভালো মানের জিনিসগুলোই রপ্তানি করে আমেরিকার আস্থার জায়গা ধরে রেখেছে। আর সবচেয়ে কম মূল্য হলো মুরগী, অবশেষে ইলিশ, কোরাল, মাটন ও চিকেন আরো টুকটাক জিনিস বৌমাই সারা সপ্তাহের জন্য পরিমাণ মতো কিনে নিলেন, আবার এই বড় বড় মাছগুলো সুন্দর করে পিস করে কার্টন ভরে সাপ্লাই দিলেন। বৌমাকে বললাম, কাটার সময় দেখবে না, বৌমা বলল, না মা এখানে সবাই সৎ, দেখতে হয় না। কিছুটা সময় লাগলো, পড়ে সবকিছু নিয়ে গাড়িতে উঠে বাসার পথে রওনা হলাম, এতোক্ষণে রাতের আঁধার নেমে এসেছে রাস্তায়, রাতের আমেরিকার দৃশ্য তো অন্য রকমের সুন্দর। নানা রকমের আলোতে রাস্তার দৃশ্য একেক জায়গায় একেক রকম। আর তো আছে গাড়ি আর গাড়ি যেন হাজার গাড়ির চলমান দৃশ্য। অবশেষে রাত আটটায় বাসায় পৌঁছলাম। এভাবেই আমাদের আমেরিকার প্রথম রোববার বাজার করার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে দিনটি শেষ হলো।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ–হুলাইন ছালেহ–নূর কলেজ।