সরকারি চাকরিতে প্রবেশ এবং অবসরের বয়সসীমা প্রসঙ্গে

এস এম ওমর ফারুক | বৃহস্পতিবার , ১৫ আগস্ট, ২০২৪ at ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ

২৪ মার্চ ২০২৪ ইংরেজি তারিখে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ সেম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর ৩ মাস। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৮ বছর। অন্যদিকে বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর এবং অবসরের বয়সসীমা ৫৯ বছর। যেহেতু রাষ্ট্র একটি গতিশীল সংস্থা, যা জনস্বার্থ ও জনকল্যাণে পরিচালিত হয় বিদায় বাস্তবতার নিরিখে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ও অবসরের বয়সসীমা পরিবর্তন করা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের লেখায় আমরা এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করতে চাই।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা কেন বাড়ানো উচিত? নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ, করোনা মহামারী, রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা, গণতন্ত্রের জন্য নানা সময়ে আন্দোলন সংগ্রাম ইত্যাদি সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে সেসন জটের ফলে স্নাতক পাস করে বের হতেই ২৭ থেকে ২৮ বছর লেগে যাচ্ছে। ঐ প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর সারা দেশে লাখ লাখ চাকরি প্রত্যাশী মেধাবী যুবক স্নাতক পাস করে নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য ভিন্ন রকমের পড়ালেখা শুরু করে (যেহেতু উচ্চ শিক্ষার পাঠ্যসূচির সাথে বিসিএস সহ চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি কোর্সের বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান)। সব মিলিয়ে দীর্ঘ আবেদন প্রক্রিয়া ও বিপুল সংখ্যক প্রার্থীদের সাথে পুনঃ পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করতে হয় বিধায় বর্তমান বয়সসীমা ৩০ বছর হওয়াতে অনেকে একবারের বেশি চেষ্টা করতে পারেন না ফলে অনেক মেধাবী তরুণ হতাশ হয়ে দেশ ত্যাগ করে কিংবা তুলনামূলক কম মেধার প্রয়োজন সেরকম কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য হয়, যা জাতির জন্য অপচয় ও আত্মঘাতী। ফলে দীর্ঘদিন ধরে চাকরিতে প্রবেশের অপেক্ষায় লক্ষ লক্ষ যুবকযুবতীর যে দীর্ঘজট তৈরি হয়েছে তাতে মেধাবীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। ফলে দেশে সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সংগঠন কিংবা গ্রুপ সংগঠিত হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে চলেছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে এরকম একটা গ্রুপ ‘চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ ২০২৪’ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ, যা ক্রমবর্ধমান। এই তরুণরা সংঘবদ্ধ হয়ে চাকরির বয়স বাড়ানোর জন্য নানারকম আন্দোলন সংগ্রাম ও লেখালেখি করে নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বলাবাহুল্য চাকরিপ্রার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে এবং তাদের এ দাবি বাস্তবায়নে সরকারের এখনই উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করেন।

পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি ও আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসলেও তা এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৮ বছর আর সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স ছিল ৫৭ বছর। ১৯৭২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অবসরের এই বয়সসীমা বহাল ছিল। ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স একবারে তিন বছর বৃদ্ধি সাপেক্ষে অবসরের বয়সও তিন বছর বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েও সরকার প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে ৩০ বছর করলেও অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর করার পরিবর্তে মাত্র দু বছর বাড়িয়ে ৫৯ করেন। ১৯৯১ সালের পর দীর্ঘ ৩৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে বর্তমানে ৭২.৩ বছর হয়েছে অথচ চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর যৌক্তিক বিষয়টি এখনো গৃহীত হয়নি।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পরিসংখ্যান যদি দেখি তাহলে বলতে হয় গড় আয়ু বিবেচনায় বাংলাদেশের চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর অথবা কমপক্ষে ৬২ করা উচিত। উদাহরণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি, যুক্তরাজ্যে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার বয়স ৬৫ বছর; নেদারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন ইত্যাদি ইউরোপীয় রাষ্ট্রে অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবসরের বয়সসীমা ৬৬ বছর। আইসল্যান্ড ও নরওয়েতে সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা ৬৭ বছর। অস্ট্রেলিয়া ও বেলজিয়ামে এটা ৬৫ বছর। জাপানে এ বয়সসীমা ৬২ বছর ৭ মাস। জাপানিদের গড় আয়ু বেড়ে চলাতে ২০২৫ সালের মধ্যে অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন জাপান সরকার।

আমরা মনে করি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উচিত বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে তরুণদের মনোভাব বিবেচনায় নিয়ে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর এবং অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর করা। উপরের সার্বিক আলোচনায় আমরা দেখতে পাই পদের তুলনায় চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় চাকরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে জয়ী হওয়ার জন্য গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরও ৪৫ বছর সময় দরকার এবং চাকরিতে প্রবেশের সরকার ঘোষিত বয়সসীমা অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও অনুসরণ করে বলে প্রার্থীরা সেসব চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

অনুরূপভাবে উপরের আলোচনায় আমরা স্পষ্ট হয়েছি যে, ১৯৭২ সালে চাকরিতে অবসরের সাথে গড় আয়ুর ব্যবধান ছিল মাত্র এক বছর। কিন্তু গত ৩৩ বছরে গড় আয়ু বেড়ে ৫৮ থেকে বেড়ে ৭৩ বছর হলেও অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি না করায় দেশ অভিজ্ঞ ও দক্ষ মানুষের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুস্থ, সবল, দক্ষ ও অভিজ্ঞ এসব মানুষের সেবা না নেওয়া বিরাট এক জাতীয় অপচয় বিধায় যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে চাকরির অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর করা আবশ্যক বলে অনেকে মনে করেন।

পরিশেষে বলতে চাই, সমপ্রতি (জুলাইআগষ্ট ২০২৪) বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে শহীদ আবু সাঈদসহ শত শত ছাত্র জনতার জীবন বিসর্জনের মধ্যদিয়ে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিদ্যমান অনিয়ম সংস্কারের লক্ষ্যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তাঁদের কাঠামোতেও আমরা প্রবীণ ও অভিজ্ঞদের উপদেষ্টা করার মধ্য দিয়ে উপরোক্ত দাবির যৌক্তিকতা দেখতে পাই। অতএব আমরা আশা করব প্রবীণ নবীনের সমন্বয়ে গঠিত এ সরকার তাঁদের সংস্কার পরিকল্পনায় আজকের লেখায় বর্ণিত চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ও অবসরের বয়সসীমা পুনঃনির্ধারণ করে যুবকদের মেধা ও অভিজ্ঞদের দক্ষতা কাজে লাগানোর দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে জন আকাঙ্ক্ষার সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজ এগিয়ে নেবেন।

লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিবেশবান্ধব অলিম্পিক ভিলেজ-জাতিসংঘের সতর্কতা
পরবর্তী নিবন্ধবৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ সাইমনের পরিবারকে সন্দ্বীপ বিএনপির অনুদান