বিগত সরকারের আমলে ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য অনেক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন, যার ফলে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
গতকাল সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে ‘ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এ দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে বড় বড় অন্তত ২৪টি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, যার পরিমাণ ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়। খবর বাংলানিউজ ও বিডিনিউজের।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, খেলাপি ঋণ অব্যাহতভাবে বেড়েছে। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি নিয়ে এখনও তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ করার জন্য সিআইডি ৭৯ বার সময় নিয়েছে। নতুন সময় ৪ সেপ্টেম্বর। ভবিষ্যতে এমন দেখতে চাই না। আমরা চাই ওই তদন্ত প্রতিবেদন উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক।
আর্থিক খাতের অন্যতম সমস্যা মামলা জটিলতা। মামলার কারণে বিপুল পমিমাণ টাকা আটকে আছে উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আর্থিক আদালতে মামলার সংখ্যা ৭২ হাজার ৫০০টি। টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তথ্য–উপাত্ত যাচাই–বাছাই করে আর্থিক কেলেঙ্কারি খুঁজে বের করা প্রয়োজন। আমাদের গবেষণায় দেখিয়েছিলাম ২৪টি আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে, যার পরিমাণ ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।
মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল উল্লেখ করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগ বাতিল করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগ অর্থাৎ এফআইডি রয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে তার কার্যক্রম করতে পারে না। এটা সৃষ্টি করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকিং সেক্টরকে প্রভাবিত করা। তিনি বলেন, অন্যায়ভাবে ঋণ কিংবা ভুল সিদ্ধান্ত যেগুলো নেওয়া হয়েছে, তার একটি তদন্ত হওয়া উচিত। আমাদের সুপারিশ এফআইডি বন্ধ করে দেওয়া উচিত, এই বিভাগের কোনো প্রয়োজন নেই।
ব্যাংক একীভূত করার ব্যাপারে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকগুলো একীভূত করার পূর্বশর্ত হলো অডিট করে ফাইনান্সিয়াল অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখা। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ক্যাটাগরি ঠিক করে দিতে হবে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পুঁজি হিসেবে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও দেখা প্রয়োজন।
অনেক ব্যাংক ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’: দেশের কিছু ব্যাংক ইতোমধ্যে ‘মৃতপ্রায়’ আর অনেক ব্যাংকের ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ হয়েছে বলে মনে করছে সিপিডি। এর মধ্যে ‘মৃতপ্রায়’ ব্যাংকগুলোকে একবার সচলের চেষ্টা এবং ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ ব্যাংকগুলোকে মরতে দেওয়ার সুপারিশ করছে বেসরকরি গবেষণা সংস্থাটি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, মৃতপ্রায় ব্যাংকগুলোকে রক্ষায় শেষবারের মত আরেকবার চেষ্টা করা যেতে পারে। এজন্য এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালক পর্ষদে বদলাতে হবে। সংস্কার করতে হবে পুরোটা। তিনি বলেন, অনেক ব্যাংক ক্লিনিক্যালি ডেড হয়ে গেছে। এসব ব্যাংক আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। স্বাভাবিকভাবে এদের মরে যেতে দেওয়া দরকার। সরকার এসব ব্যাংকগুলোকে অর্থ দিয়ে, মূলধন দিয়ে পুনর্ভরণ করে চালাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে ‘মৃতপ্রায়’ ও ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ ব্যাংকের সংখ্যা না জানালেও ফাহমিদা বলেন, ব্যাংকগুলোর ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী– ১১টি ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল নীতিমালা অনুযায়ী বিভিন্ন হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো ক্লিনিক্যালি ডেড হয়ে গেছে। একসময়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ভালো ব্যাংক ছিল; এটিকে দখলের পরে মুমূর্ষু হয়ে গেছে।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, স্বাধীনতার পরে দেশের অর্থনীতি অনেক খারাপ ছিল। তখন অর্থনীতি সাজাতে এগিয়ে এসেছে দেশের ব্যাংক খাত; তৈরি করেছে উদ্যোক্তা, করেছে অর্থায়ন। ব্যাংক খাত শিল্পায়নে ভূমিকা রাখায় পরবর্তী সময়ে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। এসব শিল্পগোষ্ঠী অর্থনীতি সচল রাখতে ভূমিকা রাখছে মন্তব্য করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের ব্যাংক খাত এখন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রসারে কাজ করছে। গুটি কয়েক গোষ্ঠীর জন্য নিয়মনীতি করা হচ্ছে।