হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১০ আগস্ট, ২০২৪ at ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ

চমকে গিয়েছিলাম তার প্রথম প্রশ্নে। চারপাঁচজন শিক্ষক, পাশাপাশি বসা। আমি একমাত্র ছাত্র। দরোজা ঠেলে তাদের সালাম দিয়ে সামনের চেয়ারে বসার পর শিক্ষকদের মধ্য থেকে সুদর্শন ও তরুণ এক শিক্ষক আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন রাখলেন, ‘আপনি কী জন্যে অর্থনীতি নিয়ে পড়তে এসেছেন।’ প্রথমেই হোঁচট খেলাম, সাথে কিছুটা বিস্ময়। কেননা কোন শিক্ষক ছাত্রকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে এই প্রথম শুনলাম ও দেখলাম। গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অনার্সে লিখিতভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষা দিতে। লিখিত পরীক্ষায় ৬৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬০ জন নির্বাচিত হয়েছিল। তাতে আমার নামও ছিল। মনে প্রাণে চেয়েছিলাম যেন ঝরে যাই। কিন্তু যাইনি। ঝরে যেতে চেয়েছিলাম এই কারণে, অংকে ছিলাম ভীষণ কাঁচা। আর সে কারণে পাশাপাশি ইংরেজি বিভাগেও ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। যাই হোক, সুদর্শন ওই শিক্ষকের প্রশ্নের কোন একটা উত্তর দিয়েছিলাম। কী উত্তর দিয়েছিলাম এত বছর পর আর মনে নেই। এক সময় ওই কামরা থেকে বেরিয়ে এলাম, মনে এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে। তখনও আমার জানা হয়নি কে এই তরুণ সুদর্শন অধ্যাপক। এর কিছুদিন পর যখন ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলাম, আর্টস ফ্যাকাল্টির দোতলা থেকে মাঝে মধ্যে তাকে দেখতাম, ছোট সাইজের একটি প্রাইভেট কারে আসতেন সুদর্শন, সুন্দর করে কথা বলতেপারা সেই অধ্যাপক, দেখে মুগ্ধ হতাম। কিছুদিন পর জানলাম তিনি আমেরিকাফেরত, ফুলপ্রফেসর হিসাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন, নাম অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। ওখানেই শেষ। তার সাথে আর দেখা হয়নি।

ইতিমধ্যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করলাম। বছর চারেক চট্টগ্রামে সাংবাদিকতা করে ঢাকার ইংরেজি সাপ্তাহিক দি টাইডএ রিপোর্টার হিসাবে যোগ দিলাম দ্বিগুন বেতনে। নতুন জীবন শুরু হলো, নতুন জায়গা, নতুন চ্যালেঞ্জ। সেটি ১৯৮৪ সালের কোন এক সময়কার কথা। সে সময়টায় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এশিয়ার নোবেল হিসাবে পরিচিত ‘ম্যাগসেসাই পুরস্কার’ পেলেন। বিশাল ব্যাপার কিন্তু সেটি বাংলাদেশের সে সময়কার পত্রপত্রিকায় যেভাবে আসা উচিত ছিল সেভাবে আসেনি। অথচ এই নিয়ে বিদেশী পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেলে প্রচুর লেখালেখি হয়েছিল। তখন মোবাইল ফোন ছিলনা। অফিস থেকে ফোন করে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে অধ্যাপক ইউনুসকে ফোন করি। ঠিক হলো দুপুরের কোন এক সময় তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের শ্যামলী অফিসে তার সাক্ষাৎকার নেবো। পরিচয় দিয়ে অপেক্ষা করছি। মিনিট কয়েকের মধ্যে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বেরিয়ে এলেন। তার সেই অতি পরিচিত হাসিমুখ। হাত বাড়িয়ে বসতেই তাকে বললাম, ‘স্যার, একটা সময় আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন আপনি, আর আজ আমি এলাম আপনার ইন্টারভিউ নিতে।’ স্বাভাবিকভাবে তার কিছুটা অবাক হবার পালা। অর্থনীতি বিভাগে মৌখিক পরীক্ষার কথা বললাম। সেদিনের ওই সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে একটি ‘এক্সক্লুসিভ’ রিপোর্ট বের হয়েছিল ‘দি টাইড’ পত্রিকায়। এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। তার সাথে আর যোগাযোগ নেই। পত্রিকার চাকরি ছেড়ে যোগ দিলাম ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে। সেখানে পরিচয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের ছোটভাই বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মী, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সাথে। অল্প সময়ে কলিগ থেকে দুজন হয়ে গেলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু যদিওবা তিনি আমার চাইতে ৩/৪ বছরের সিনিয়র। তখন তিনি পেশায় তুঙ্গে, জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব। আজ এই যে আমার দীর্ঘদিনের কলাম, ‘হল্যান্ড থেকে’, তার শুরু জাহাঙ্গীর ভাইয়ের উৎসাহে ও অনুপ্রেরণায়। যাই হোক, হল্যান্ড পৌঁছার বছর দেড় দুই পর ঢাকা থেকে এলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস। তিনি উঠেছেন হেগ শহরের সেন্ট্রাল স্টেশনলাগোয়া হোটেল বেবিলনে। সে সময় বার্তা সংস্থা, ইউ এন বির হল্যান্ড প্রতিনিধি হিসাবে মাঝে মধ্যে সংবাদ পাঠাচ্ছি ঢাকায়। সেটি ঠিক করে দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর ভাই। জাহাঙ্গীর ভাই লিখলেন, ‘মেজ ভাই হল্যান্ড যাচ্ছেন, ওনার হাতে আপনার জন্য ইউএনবির এক্রেডিশন কার্ড পাঠালাম।’ ফোন করলে ইউনুস স্যার বলেন, চলে এসো হোটেলে। ইউএনবির এক্রেডিশন কার্ড পেয়ে যতটা না উৎফুল্ল হয়েছিলাম, তার চাইতে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান মনে হলো নিজেকে, এই কারণে আমার এই পরিচয়পত্র অধ্যাপক ড. ইউনুস নিজে সাথে করে নিয়ে এসেছেন। তখনও তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি।

এলো ১৩ নভেম্বর ২০০৬ সাল। গোটা বাংলাদেশের জন্য এ এক পরম গৌরবের দিন। সকালের দিকে প্যারিস থেকে ফোন করলেন বাংলাদেশে মাইম আর্টের স্থপতি বন্ধুপ্রতিম পার্থ প্রতিম মজুমদার, কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা। বললেন, ‘বিকাশ বাবু, টিভি অন করুন। অধ্যাপক ইউনুস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।’ দেরি না করে টিভি খুলতেই দেখি বিশেষ প্রতিবেদন। বর্তমান রাণী, সে সময়কার প্রিন্সেস ম্যাক্সিমার সাক্ষাৎকার। তিনি বলে চলেছেন, ‘প্রফেসর ইউনুস আমার আদর্শ। তার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেই আমরা আর্জেন্টিনায় মাইক্রোক্রেডিট প্রকল্প চালু করেছি। আমার ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা। ভাবছি কীভাবে ইউনুস স্যারকে অভিনন্দন জানাতে পারি। জানতাম সে সময় তাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা রাষ্ট্র প্রধান, নামিদামি ব্যক্তিরা ফোন করছেন, অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এই সব জানা সত্ত্বেও ভাবলাম, দেখি না চেষ্টা করে। ফোন করলাম তার ছোট ভাই, বন্ধু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে। অভিনন্দন জানিয়ে জাহাঙ্গীর ভাইকে জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনি কোথায় এই মুহূর্তে, স্যার (অধ্যাপক ইউনূস) কই?’ লক্ষ্য করি উনিও বেশ উত্তেজিত। বললেন, ‘আমি তো মেজ ভাইয়ের পাশেই বসে আছি। বিভিন্ন দেশ থেকে ফোন আসছে মেজ ভাইয়ের জন্যে। আমি ধরছি, আর তাকে দিচ্ছি।’ বললাম, ‘জানি উনি অতি ব্যস্ত, কিন্তু আমি কি তাকে একুট লাইনে পেতে পারি। কেবল অভিনন্দন জানাবো।’ আমি শুনতে পাচ্ছি, জাহাঙ্গীর ভাই বলছেন, ‘মেজদা, হল্যান্ড থেকে বিকাশ ফোন করেছে, কথা বলতে চায়।’ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সাথে সাথে বললেন, ‘দাও, দাও’। আনন্দে উত্তেজিত বলি, ‘স্যার, অভিনন্দন, এই মুহূর্তে ডাচ টিভি চ্যানেলে হবু ডাচ রাজার স্ত্রী, প্রিন্সেস ম্যাক্সিমা আপনার ভূয়সী প্রশংসা করে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, আপনার জন্য আমরা গর্বিত। আজ ফলাও করে এই সংবাদ ছাপা হয়েছে ডাচ মিডিয়ায়।’ সাথে সাথে তিনি বললেন, ‘পাবলিশড সব নিউজ জাহাঙ্গীরের কাছে পাঠিয়ে দাও।’ তখন আমি দৈনিক জনকণ্ঠে নিয়মিত লিখতাম। ক’দিনের মাথায় দৈনিক জনকন্ঠে (১৬ অক্টোবর ২০০৬) অধ্যাপক ইউনুসকে নিয়ে লেখা, ‘. ইউনূসের নোবেল জয়ে আনন্দের বন্যা’ শীর্ষক আমার একটি লেখা ছাপা হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বন্ধু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সম্পাদনায় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখার সমন্বয়ে মাওলা ব্রাদার্স বের করে ৩১৮ পৃষ্ঠার বই, ‘শান্তির শিরোপা’। খুব ভালো লাগলো যখন বইটির সম্পাদক বন্ধু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের হাত ধরে আমার হাতে এলো বইটি। দেখলাম বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন, ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, . ফখরুদ্দিন আহমদ, ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, মাহবুব উল আলম চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আবুল মোমেনের মত বরেণ্য লেখকের পাশাপাশি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত আমার লেখাটিও ওই বইয়ে স্থান পেল। এই স্থানপাবার কর্মটি যে বইয়ের সম্পাদক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের লেখকবন্ধুর প্রতি কিছুটা পক্ষপাতিত্ব তা বলা বাহুল্য।

সেই জাহাঙ্গীর ভাই আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন চিরতরে। এর কিছুদিন পর অপ্রত্যাশিত এক বার্তা এলো অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের কাছ থেকে। ইংরেজিতে দুই লাইনের এই ইমেইল বার্তায় তিনি লিখলেন, ‘আমি আমস্টারডাম আসছি, তোমার সাথে দেখা করতে চাই’। এ ছিল আমার আশাতীত। নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পাঁচেক আগে আমস্টারডামে স্থায়ীভাবে বসবাসরত বুলবুল জামানকে সাথে নিয়ে তার হোটেলে গেলাম। লবিতে পাশের একটি হলরুমে তিনি বক্তব্য রাখছিলেন। সবাই ইউরোপীয়। তিনি এলেন, হাতে একগাদা বই, ম্যাগাজিন। হাত বাড়িয়ে দিলেন। লবির এক কোণায় আমরা তিনজন গোল হয়ে বসি। তিনি বললেন, ‘জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তার কাছের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চাইছি। তাতে এক ধরনের প্রশান্তি খুঁজে বেড়াই। সে কারণে তোমাকে ডাকা।’ তাকে বললাম, ভগ্ন শরীর নিয়ে তার (জাহাঙ্গীর) হল্যান্ড আসা, রাজধানী সহ বিভিন্ন শহর ঘোরা, প্যারিস যাওয়ার কথা। ইউনূস স্যার বললেন, জাহাঙ্গীর ছিল রিয়েল ফাইটার। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে ক্যান্সারের সাথে লড়ে গেছে, কাজ করে গেছে শরীরে যতক্ষণ শক্তি ছিল।’ লক্ষ্য করি, এক পর্যায়ে তিনি কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়েন। এরপর পুরানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, ‘ছোটকালে জাহাঙ্গীরকে ডেকে ধমক দিলে সে পাশে এসে মাথা নিচু করে থাকতো। কিছু বলতো না, কেবল তার চোখ দিয়ে টস টস করে পানি পড়তো।’ এক পর্যায়ে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর সম্পাদিত বইটি তার সামনে তুলে ধরি। তিনি তাতে লিখলেন, ‘বিকাশকে শুভেচ্ছা সহ। মুহাম্মদ ইউনুস, ৪ মার্চ ২০২০ আমস্টারডাম।’ বইটি আমার কাছে আরো মূল্যবান হয়ে পড়লো। ইতিমধ্যে তার জার্মান সেক্রেটারি কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, তার তাড়া আছে। বলেন, ‘আমার আর একটি অনুষ্ঠানে যেতে হবে।’ তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

সবশেষে, দুঃখের মাঝে আনন্দের কথা এই দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তিনি এলেন হাল ধরতে। তার কাছে গোটা জাতির অনেক প্রত্যাশা। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেখানেই হাত দেন সেখানে সোনা ফলে। কথায় নয়, সে আমরা কাজে দেখেছি। গোটা বিশ্ব তাকে চেনে, সম্মান করে। দেশের বাইরে তার পরিচয়ে আমরা হই পরিচিত, গর্বিত। নিজেকে অতি সৌভাগ্যবান মনে হয় যে আমার সুযোগ হয়েছে, একবার নয়, অনেকবার, এই জননন্দিত অনন্য ব্যক্তির কাছাকাছি আসার, একান্তে কথা বলার। তার সাথে কাটানো সব মুহূর্ত এই স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। সে কথা লিখবো কোন এক সময়, আগামীতে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুযোগ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশায়।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধনোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসের নতুন যাত্রা
পরবর্তী নিবন্ধবরেণ্য অর্থনীতিবিদই সচল অর্থনীতির পুরোধা