আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে পাকের অনেকগুলো আয়াতে মুমিনের গুণাবলী সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। সূরা আনফালের ২ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আসলে মুমিন তো হচ্ছে সে সব লোক, আল্লাহতায়ালাকে যখন স্মরণ করানো হয় (তখন) তাদের হৃদয় প্রকম্পিত হয় এবং যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তেলওয়াত করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়, উপরনু্ত তারা তাদের মালিকের উপর নির্ভর করে’। এই আয়াতের প্রেক্ষিতে হযরত ইবন্ আেব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘মুনাফিকরা যখন সালাত আদায় করে তখন কুরআনুল কারীমের আয়াতসমূহ তাদের অন্তরে মোটেই ক্রিয়াশীল হয় না–না তারা আল্লাহর আয়াতসমূহের উপর ঈমান আনে, আর না আল্লাহর উপর ভরসা করে। তারা সালাত আদায় করে না, আর তারা যাকাতও দেয় না। আল্লাহতায়ালা এখানে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, মুমিন কখনও এরূপ হয় না। সূরা আন নাযেয়াতের ৪০ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘পক্ষান্তরে যে স্বীয় রবের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাত হবে তার মূল স্থান’। মুমিন ব্যক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হযরত শুদ্দী (রহ.) বলেন, ‘সেই ঐ ব্যক্তি–যে পাপ কাজের ইচ্ছা করে, কিন্তু যখন তাকে বলা হয়, আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার অন্তর কেঁপে উঠে’। হযরত উম্মু দারদা (রাঃ) বলেন যে, যে অন্তর আল্লাহর ভয়ে কাঁপতে শুরু করে এবং দেহে এমন এক জ্বালা সৃষ্টি হয় যে, তার পশম খাড়া হয়ে যায়। যখন এরূপ অবস্থা সৃষ্টি হবে তখন বান্দার উচিত যে, সে যেন সেই সময় স্বীয় মনোবাঞ্চনা পূরণের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে। কেননা ঐ সময় দোয়া কবুল হয়ে থাকে। হযরত নোমান ইবন্ বাশির (রহ.) থেকে বর্ণিত–তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তোমরা মুমিনরা পারস্পরিক দয়া, ভালবাসা, এবং হৃদ্যতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে একটি দেহের ন্যায় দেখতে পাবে, দেহের কোন অঙ্গ যদি পীড়িত হয়ে পড়ে তাহলে অপর অঙ্গগুলো জ্বর ও নিদ্রাহীনতাসহ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে থাকে (বুখারী শরীফ–৫৫৮৬)। অন্য একটি হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘সকল মুসলমান একই ব্যক্তির সত্তার মতন। যখন তার চোখে যন্ত্রণা হয় তখন তার গোটা শরীরে তা অনুভূত হয়। যদি তার মাথা ব্যথা হয়, তখন গোটা শরীর তা অনুভব করে (মুসলিম শরীফ–৬৩৫৩)। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত– রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তি ভালবাসা ও দয়ার প্রতীক। ঐ ব্যক্তির মধ্যে কোন কল্যাণ নেই, যে কাউকে ভালবাসে না এবং কারো ভালবাসা পায় না (মুসনাদে আহমেদ–৯১৯৮)। মুমিন হওয়া এত সহজ নয়। আল্লাহর কোরআনে বর্ণিত যে গুণাবলী বিদ্যমান রয়েছে তার আলোকে নিজের জীবনকে গঠন একজন মুমিন ব্যক্তির জন্য অপরিহার্য। অন্তরে আল্লাহতায়ালার ভয়, কোরআন শ্রবণে অন্তরাত্না কেঁপে উঠা এবং নিজের অজান্তে চোখ থেকে অশ্রু বয়ে যাওয়া– মুমিন ব্যক্তির জন্য জীবনের অন্যতম অনুসঙ্গ হওয়া বাঞ্চনীয়। লোক দেখানো নামাজ, তাড়াহুড়া করে নামাজ, রুকু–সেজদা সঠিকভাবে আদায় না করে নামাজ আল্লাহর কাছে কখনও গ্রহণযোগ্যতা পায় না। আল্লাহর কোরআন পাঠে যে ঈমান বৃদ্ধি পায় তা এই আয়াতে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা অন্যত্র একটি আয়াতে বলেন, ‘আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ করা হয়, তখন কেহ কেহ বলে, তোমাদের মধ্যে এই সূরা কার ঈমান বৃদ্ধি করল? অবশ্যই যে সব লোক ঈমান এনেছে এই সূরা তাদের ঈমানকে বর্ধিত করেছে। আর জান্নাতের সুসংবাদ ঐ ব্যক্তির জন্য’– সূরা আত তওবা– ১২৪। ইমাম বুখারী (রহ.) এবং অন্যান্য ইমামগণ এধরনের আয়াতসমূহ দ্বারা এই দলিল গ্রহণ করেছেন যে, ঈমানের মধ্যে হ্রাস বৃদ্ধি হতে পারে। আল্লাহতায়ালা এই আয়াতে আরও বলেন, তাওয়াক্কুল করতে হবে একমাত্র আল্লাহতায়ালার উপর। তিনি একমাত্র আমাদের আশ্রয়দাতা এবং তাঁর কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। এই বিশ্বাস মনে প্রাণে গেঁেথ রাখার মূলে রয়েছে মুমিন ব্যক্তির গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ। সেই মুমিন ব্যক্তির আশ্রয়দাতা বলতে একমাত্র আল্লাহতায়ালাকে মনে করে। কিছু চাইলে তাঁর কাছে চায়। প্রতিটি কাজে তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই মুমিন ব্যক্তি জানেন যে, তিনি যা চান তাই হবে এবং যা চান না তা হবে না। তিনি একক–তাঁর কোন অংশীদার নেই। সব কিছুর মালিক একমাত্র তিনি। তাঁর হুকুমের উপর কারও হুকুম চলতে পারে না। তিনি অতিসত্তর হিসাবগ্রহণকারী। সাঈদ ইবন্ে জুবায়ের (রহ.) বলেন যে, আল্লাহর উপর ভরসা হচ্ছে ঈমানের নির্যাস। মুমিনদের দুটি কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ–যেমন: তারা সালাত আদায় করে এবং তাদের প্রদত্ত সম্পদ থেকে গরীব দুঃখীদেরকে দান করে। সালাত প্রতিষ্ঠা হচ্ছে আল্লাহতায়ালার হকসমূহের মধ্যে অন্যতম হক। হযরত কাতাদাহ (রহ.) বলেন, ‘ইক্বামতে সালাতের অর্থ হচ্ছে সময়মত সালাত আদায় করা, অযু করার সময় উত্তমরূপে হাত, মুখ ধৌত করা, রুকু–সেজদা তাড়াহুড়া না করা, আদবের সহিত কুরআন মজিদ পাঠ করা এবং রাসূল (সাঃ) এর উপর তাশাহ্হুদ ও দরুদ পাঠ করা। অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে আল্লাহতায়ালা মুমিন ব্যক্তিকে যা দিয়েছেন তা যদি যাকাতের নিসাবে পৌঁছে–তাহলে যাকাত প্রদান করবে এবং যা কিছু রয়েছে তা থেকে মানুষকে দান করতে থাকবে। আল্লাহতায়ালার নিকট ঐ বান্দা সব থেকে বেশি স্বীকৃত যে, তাঁর সৃষ্টজীবের বেশি উপকার করে আর এসব গুণে যারা গুণান্বিত তারাই হচ্ছে প্রকৃত মুমিন। মুমিনদের গুণাবলী সম্পর্কে সূরা আল্ মুমিনুনের প্রথম ১১ টি আয়াতে আল্লাহতায়ালা বর্ণণা করেছেন এইভাবে, ‘নিঃসন্দেহে ঈমানদার মানুষেরা মুক্তি পেয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়াবনত থাকে, যারা অর্থহীন বিষয় থেকে বিমুখ থাকে, যারা যাকাত প্রদান করে, যারা তাদের যৌনাঙ্গসমূহের হেফাজত করে, তবে নিজেদের স্বামী–স্ত্রী কিংবা নিজেদের অধিকারভুক্তদের উপর (এ বিধান প্রযোজ্য নয়, এখানে যৌনাঙ্গসমূহের হেফাজত না করলে) কখনও তারা তিরস্কৃত হবে না, অতপর এই (বিধিবদ্ধ উপায়) ছাড়া কেউ যদি অন্য কোন (পন্থায় যৌন কামনা চরিতার্থ করতে) চায়, তাহলে তারা হবে সীমালঙ্গনকারী, যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতিসমুহের হেফাজত করে, যারা নিজেদের নামাজসমূহের ব্যাপারে যত্নবান হয়, এ লোকগুলো (হচ্ছে মূলত জমিনে আমার যথার্থ) উত্তরাধিকারী, যারা হবে জান্নাতুল ফেরদৌস এর উত্তরাধিকারী, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে’। দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবন্ আেব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘তারা সালাত আদায় করা অবস্থায় অত্যন্ত বিনয়ী হয়। তাদের মন আল্লাহর দিকে ঝুঁকে থাকে এবং অন্যদের প্রতি থাকে বিনম্র। হযরত আলী ইবন্ে আবি তালহা (রহ.) বলেন, ‘খুশু’ এর অবস্থান হল অন্তরে। হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন, তাদের খুশু থাকে তাদের অন্তরে আর তাদের দৃষ্টি থাকে নিচের দিকে সুতরাং এই বিনয়ী ও নম্রতা ঐ ব্যক্তি লাভ করতে পারে যার অন্তঃকরণ খাঁটি ও বিশুদ্ধ হয়, সালাতে পুরোপুরিভাবে মনোযোগ থাকে এবং সমস্ত কাজ অপেক্ষা সালাতে বেশি আগ্রহী, তখন মন হয় আনন্দে আপ্লুত এবং চোখে আসে শীতলতা।
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত– রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আমার কাছে সুগন্ধি ও মহিলা খুবই পছন্দনীয় এবং আমার চক্ষু ঠান্ডাকারী হল সালাত – (আহমেদ–৩/১৯৯)। ৩নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, মুমিনরা বাতিল, শিরক, পাপ ও বাজে এবং নিরর্থক কথা থেকে বিরত থাকে। আল্লাহতায়ালা অন্য একটি আয়াতে বলেন, যখন তারা অসার ক্রিয়াকলাপে সম্মুখীন হয়, তখন স্বীয় মর্যাদার সাথে তা পরিহার করে থাকে– সূরা ফোরকান– ৭২। হযরত কাতাদাহ (রহ.) বলেন, আল্লাহর শপথ! এমতাবস্থায় আল্লাহর কাছ থেকে তারা যা প্রাপ্ত হয় তা তাদেরকে খারাপ কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল