(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বোর্ডিং ব্রিজ পার হয়ে সামনের দিকে হাঁটছিলাম। পুরো বিমানের মানুষই হাঁটছে। এদের কেউ কেউ ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে অন্য দেশের বিমানে চড়বেন, কেউবা ইমিগ্রেশন করে চীনে প্রবেশ করবেন। আবার কেউ কেউ ইমিগ্রেশন করে ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল থেকে ডোমেস্টিক টার্মিনালে গিয়ে চীনের অন্য কোন গন্তব্যের ফ্লাইট ধরবেন। যেমন আমরা। কিন্তু সবার আগে আমাদের ইমিগ্রেশন করিয়ে লাগেজ কালেকশন করতে হবে। কিন্তু পথ ফুরোচ্ছিল না। হাঁটছি তো হাঁটছি! কখনো চলন্ত সিঁড়ি, কখনো এক্সেলেটর, কখনোবা হাঁটাপথ। নির্দেশনা দেখে দেখে হাঁটছিলাম। গন্তব্য ইমিগ্রেশন। কিন্তু কত দূর গেলে যে ইমিগ্রেশন অফিসারের মোলাকাত হবে তা বুঝতে পারছিলাম না।
এই বিমানবন্দরে আমি আগেও এসেছি। কিন্তু প্রথম বারের সাথে এবারের দেখা অনেককিছুই মিলাতে পারছিলাম না। আচ্ছা, এরা কী প্রতিদিনই উন্নয়ন করে! প্রতিদিনই নিজেদের সমৃদ্ধ করে, পাল্টায়! ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে, চীনের গুয়াংজুর এই বিমানবন্দর ইউরোপ আমেরিকার নামী দামি বহু বিমানবন্দরের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ, বেশি সুসজ্জিত, সুন্দর।
লায়ন ফজলে করিম লিটন ভাইকে আমি মজা করে ‘হাফ চায়নিজ’ ডাকি। চীনের সাথে ওনার ব্যবসা বাণিজ্য। কম করে হলেও পঞ্চাশ বার তিনি চীনে এসেছেন, বছরে তিন চারবারও আসেন। চীনের বহু কিছু ওনার নখদর্পনে। বেশিরভাগ সময়ই এই বিমানবন্দরই তিনি ব্যবহার করেন। তাই এখানের অলি গলি থেকে শুরু করে সবই তার চেনা। চোখ বন্ধ করে তাকে অনুসরণ করলে ঠিকই ইমিগ্রেশনে পৌঁছে যাবো। তবে নির্দেশনা দেখে দেখে পথ চলতে বেশ ভালোই লাগছিল। বিমানবন্দর জুড়ে চীনা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজীও রয়েছে। সুতরাং ইমিগ্রেশন কিংবা লাগেজ কালেকশনের পথ চিনতে কারো অসুবিধা হয়না।
ইমিগ্রেশন ডেস্কে পৌঁছে গেলাম। যথারীতি বিশাল। অসংখ্য অফিসার বসে আছেন। অধিকাংশই তরুণী। সবগুলো চীনা। ছোটখাটো শরীরের চীনা তরুণীদের দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল। আমরা দলছুট হয়ে গেলাম। লায়ন ফজলে করিম ভাই এক ডেস্কে, আমি এবং ভাবী অন্য ডেস্কে। আমাদের সাথে ব্যবসায়ীদেরও একেকজন একেক ডেস্কে গিয়ে পড়েছেন। একজন অফিসার লাইন থেকে সিরিয়াল অনুযায়ী একেকজন যাত্রীকে একেক ডেস্কে পাঠাচ্ছিলেন। এক মিনিটের মধ্যে ফজলে করিমের ইমিগ্রেশন হয়ে গেল। পাসপোর্টে সিল নিয়ে তিনি ডেস্ক পার হয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ডালিয়া ভাবীও অনেকবার চীনে এসেছেন। সুতরাং তারও খুব বেশি সমস্যা হলো না। আমার পাসপোর্ট দেয়ার পর যেনো পেয়ে বসলো। প্রথমবার চীনে এসেছি কিনা জানতে চাইলেন। আমি দ্বিতীয়বার বলে কিছুটা নির্ভার হলাম। এবার যেনো মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়লেন তিনি। কেন এসেছি, কোথায় যাবো। আমি ‘জ্যাক টেকনোলজির’ নাম বললাম। তাদের আমন্ত্রনে এসেছি বলার পর বেচারি ‘ইনভাইটেশন লেটার’ দেখতে চাইলেন। ইমিগ্রেশন ফরমে ‘জ্যাক টেকনোলজির’ ঠিকানা লিখে দিতে বললেন। ফজলে করিম ভাই পেছন থেকে কথা বললেন, কাগজপত্র এগিয়ে দিলেন। আমার পাসপোর্টে সিল দেয়া হলো।
সাংবাদিকদের ব্যাপারে প্রায় পুরো পৃথিবীই কিছুটা রক্ষণশীল। চীন একটু বেশি। বাইরের সাংবাদিক কেন তার দেশে আসবে, কি না কি জেনে কোন তথ্য কোথায় ফাঁস করবে এসব নিয়ে মনে হয় তারা কড়াকড়ি করেন। অনেক দেশেই ইমিগ্রেশনে উটকো সমস্যায় পড়তে হয়, পড়েছি। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে কোন দেশই কোনোদিন আমাকে ফিরতি ফ্লাইটে উঠিয়ে দেয়নি।
ইমিগ্রেশন ডেস্ক পার হয়ে আমরা আবারো একসাথে হয়ে গেলাম। এবার লাগেজ কালেকশন করতে হবে। লাগেজ কালেকশনের নির্দেশনা দেখে নিলাম। যদিও আমরা গুয়াংজুতে বিমানবন্দরের বাইরে যাবো না, তবুও ঢাকা–গুয়াংজু ফ্লাইটের পাঠ এখানে চুকিয়ে দিতে হবে। আমরা একই এয়ারলাইন্সের টিকেট করলেও ইমিগ্রেশন যেহেতু গুয়াংজুতে করছি তাই লাগেজ এখানেই কালেকশন করে ডোমেস্টিকে নিয়ে যেতে হবে। আমরা সাংহাই বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন করলে এখানে আর লাগেজ নিয়ে টানাটানি করতে হতো না। এখন এখান থেকে আমাদেরকে লাগেজ কালেকশন করে আবার নতুন করে এয়ারলাইন্সকে গছাতে হবে। অথচ আমরা যেই এয়ারলাইন্সে ঢাকা থেকে এসেছি, সেই একই এয়ারলাইন্সের অন্য ফ্লাইটেই সাংহাই যাচ্ছি।
গুয়াংজু এয়ারপোর্টে লাগেজ কালেকশনের ব্যাপার–স্যাপার আমার আগেও দেখা ছিল। এলাহী কারবার। হাজার হাজার যাত্রীর হাজার হাজার লাগেজ। একই সাথে ৩৪টি বেল্ট, অধিকাংশই ঘুরছে। আমাদের ফ্লাইটের লাগেজ কত নম্বর বেল্টে দেয়া হয়েছে বা হবে তা দেখে নিলাম। লাগেজ এরিয়াতেই ডিজিটাল স্কিনে ফ্লাইটের বেল্ট নম্বর দেখানো হয়, সুতরাং বেল্ট খুঁজে পেতে কোন বেগ পেতে হলো না। তবে সমস্যা যা হলো তা হচ্ছে লাগেজ ট্রলি। এতা মানুষের জন্য ট্রলির ব্যবস্থা করা আসলে কঠিন। খালি ট্রলি যে কোথায় রাখা হয়েছে কে জানে! আমাদের পুরো গ্রুপেরই ট্রলি ব্যাগ। তাছাড়া খুব বেশি বড়সড়ও নয়। তাই ট্রলি না নিয়ে ব্যাগ টেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখন ভালোয় ভালোয় আমাদের লাগেজ পৌঁছালেই হলো। সিঙ্গেল রুট ফ্লাইট, তাই লাগেজ মিস হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। তবুও লাগেজ হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কিছুটা ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। আমিও আছি। জীবনে এই লাগেজ নিয়ে কম ভোগান্তি আমার হয়নি। খুব চাচ্ছিলাম যে, অনেকদিন পর বিদেশ এসেছি, এবার যেনো আমাকে ব্যাগ নিয়ে অন্তত কোন ঝামেলায় পড়তে না হয়।
বেল্ট ঘুরছে, একটির পর একটি লাগেজ আসছে। নানাজন নিজেদের লাগেজ বেল্ট থেকে নামিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু আমার লাগেজের দেখা মিলছিল না। আমাদের গ্রুপের কারো লাগেজ কি এসেছে? খেয়াল করে দেখলাম। না, কারো আসেনি। ভুল বেল্টে দাঁড়িয়ে নেই তো! স্কিনে চোখ বুলালাম। না, ঠিকই আছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই নববধূর মতো উঁকি মারলো ডালিয়া ভাবীর বড়সড় লাগেজটি। চীনা ব্যাগটি বেশ সুন্দর। ঢাকা এয়ারপোর্টেই আমার নজর কেড়েছিল। তাছাড়া করিম ভাই এবং ভাবী তাদের দুইটি ট্রলি ব্যাগের হাতলে জ্যাক কোম্পানির ‘রিপন’ বেঁধে রেখেছিলেন। এতে করে দূর থেকেও ব্যাগটি যে ভাবীর সেটি বুঝতে আমাদের কারোরই অসুবিধা হলো না। কাছে আসতেই করিম ভাই টুপ করে ব্যাগটি তুলে নিলেন, ভাবীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজেরটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, কোন অঘটন না ঘটলে এবার আমাদের লাগেজও হাজির হবে। হলেও তাই। অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা সবাই লাগেজ পেয়ে গেলাম।
ট্রলি ব্যাগ টেনে কিছুদূর আসার পরই আমি একটি খালি ট্রলি পেয়ে গেলাম। তাতে তিনটি ব্যাগ অনায়াসে তুলে দেয়া সম্ভব হলো। ট্রলি ঠেলে ডোমেস্টিক টার্মিনালের দিকে এগুতে লাগলাম। গুয়াংজু এয়ারপোর্টে ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল থেকে ডোমেস্টিক টার্মিনালে যাওয়ার পথ আমাদের ঢাকা এয়ারপোর্টের মতো সংক্ষিপ্ত নয়, বিশাল, দীর্ঘ। মানুষে মানুষে গিজগিজ করা দীর্ঘ এক পথ পাড়ি দিয়েই ইন্টারন্যাশনাল থেকে ডোমেস্টিকে যেতে হয়। গতবার এই পথে আমি দলছুট হয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এবার যাতে না হারাই সেজন্য করিম ভাই আমাকে আগে আগে থাকতে বললেন।
হাঁটছিলাম। বিদেশে আসলে জনম জনমের হাঁটা যেনো কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ে যায়!
ডোমেস্টিক টার্মিনালে পৌঁছে গেলাম। বিমানযাত্রায় ফর্মালিটির অভাব নেই। কতভাবে যে চেক করা হয়। বিমান থেকে নেমে বিমানবন্দরের ভিতর দিয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে ডোমেস্টিকে এসেছি। অথচ আমাদের আবারো চেক করা হলো। লাগেজ স্ক্যান করা হলো। অবশ্যই এর সবকিছুই আমাদের জন্য। যাত্রীদের নিরাপদ রাখতেই এসব করা হয়। তাই মেজাজ মাঝেমধ্যে খারাপ হলেও আবার শান্ত হয়ে যায়। আসলেই তো, যদি কেউ বোমা বা গ্রেনেড নিয়ে ঢুকে যায়!!
ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালের মতো গুয়াংজুর ডোমেস্টিক টার্মিনালও বিশাল। বিশাল মানে আসলেই বিশাল। কত হাজার মানুষের ধারণক্ষমতা যে এই টার্মিনালের রয়েছে কে জানে! তবে চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। গিজগিজ করছিল। অসংখ্য নারী পুরুষ। মা কিংবা বাবার হাত ধরে ছুটছে শিশু, কিশোর। বান্ধবীর হাত ধরে ছুটছে যুবক, প্রিয়তম স্বামীর হাতে হাত রেখে লাইনে দাঁড়িয়েছে তরুণী বধূ। কী চমৎকার এক আবহ চারদিকে, সুখময়। ভালোবাসায় মাখামাখি, কানাকানি প্রেমের, মায়ার। কতজন কত কষ্ট সয়ে এই যাত্রায় সামিল হয়েছে তার যেনো কোন ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। কে যে কী কষ্টের খবরে বাড়িতে বা গন্তব্যে ছুঁটে যাচ্ছে তারও কোন চিহ্ন নেই কারো চোখে মুখে। সুখী সুখী ব্যস্ত মানুষগুলো প্রিয় কোন সান্নিধ্যের জন্য যেনো মরিয়া হয়ে উঠেছে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।