প্রতিবছর নতুন নতুন বাসস্থান, স্কুল, কলেজ, অফিস, মার্কেট সহ বিবিধ স্থাপনা নির্মাণ করার জন্য ইট ব্যবহার করা হয়। সভ্যতার আধুনিকায়ন ও নগরায়ণেরই অংশবিশেষ ইট তথা ইট–ভাটা। তবে মাত্রাতিরিক্ত ও নিয়ম বহির্ভূত ইট–ভাটা স্থাপন দিন দিন পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হয়। ইট তৈরিতে অনেক কৃষিজমিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথের্র প্রয়োজনে জমির মালিকরা না বুঝে কমপক্ষে চার/পাঁচ ফুট গভীরতায় মাটি বিক্রি করে একেকটা কৃষি জমিকে নিচু ভূমিতে পরিণত করে ফেলছেন বলে অনেকে প্রচার মাধ্যমে লিখেছেন । একটি ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে মাঠের কয়েক বিঘা জমিতে ধানের শীষ নষ্ট হয়ে যায়। ইটভাটার কারণে পরিবেশ ও কৃষির উপর যে নানামুখী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে সেটি এখন অনেকরই জানা । কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি দিয়ে বানানো ইট পোড়াতে কয়লা ও গাছ ব্যবহার করায় পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে। ইট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। দেশে ৭ হাজারের বেশি ইটখোলা বা ইটভাটা রয়েছে। বছরে প্রায় ২৩ বিলিয়নের বেশি ইট বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত পরিবেশ অধিদপ্তরের এক তথ্য অনুসারে ২০১৩ সালে সারাদেশে চার হাজার ৯৫৯টি ইটভাটা ছিল। আর ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে সাত হাজারের উপরে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে আট হাজার ইটভাটা রয়েছে। এই হিসাবে সারাদেশে কয়েক বছরের ব্যবধানে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৬০ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। আরও জানা গেছে ৪ হাজার ৫০৫ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব ইটভাটায় বছরে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ইট তৈরি হচ্ছে। এসব ইটভাটার বছরে প্রায় ১৩ কোটি মেট্রিক টন মাটি লাগে। প্রতিবছরই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ শতাংশ হারে আবাদযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে, অপর দিকে ১ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বাড়ছে। ওই হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আবাদি জমির অবক্ষয় চলতে থাকলে আগামী ৭০ বছর পরে বাংলাদেশে কোনো কৃষিজমি অবশিষ্ট থাকবে না। চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ ইট উৎপাদনে কৃষিজমির মাটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। চীন ৫০ বছর আগে মাটি পোড়ানো ইট উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতেও বিভিন্ন স্থাপনায় ব্লকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে নিয়ম বহির্ভূত ইট তৈরি করা হয় সেখানকার আবহাওয়া ক্রমান্বয়ে চাষাবাদের অনুপযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি চারপাশের পরিবেশে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে।
কথা প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের শিল্পপতি লায়ন হাকিম আলী বলেন, ‘ইটভাটার কারণে কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। পরিবেশদূষণ, ভূমির উর্বরতা হ্রাস ও বন উজাড় হচ্ছে। ফসলের জমি অকেজো হয়ে যাওয়ার কারণে দেশে খাদ্যশষ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পাহাড়ের মাটি কেটে ইট বানানোর সংবাদ আমাদের কাছে আসছে। পাহাড়ের মাটি নষ্ট করলে অবশ্যই পরিবেশের জন্য হুমকি হবে যার কারণে দেশের জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হবে। ইট নির্মাণে জড়িত শিল্প মালিকদের বিকল্প শিল্পগুলোর প্রতি চিন্তাভাবনা করলে আমার মতে ভালো হয়।’ পরিচালক(হিসাব ও অর্থ) এ.বি.এম কামাল উদ্দীন বলেন, ‘বহু বছর ধরে যেহেতু ইট দিয়ে স্থাপনা নির্মাণ হয়ে আসছে সেজন্য ইটের উপর মানুষের আস্থা আছে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ ব্লকের গুণাগুণ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আমার জানামতে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘরবাড়ি নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন ধরণের ব্লক ব্যবহার করা হয়। আমি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি অনুরোধ জানাব ইট শিল্পের সাথে যুক্ত সবার যথাযথ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশে ব্লক শিল্পকে উৎসাহিত করা হোক।’
যে সব ব্লক বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে সলিড ব্লকগুলো আকারে বড় এবং ভারী হলেও ‘হলো‘ (ফাঁপা) ব্লকগুলো বেশ হালকা এবং কাজ করার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক। হলো ব্লকের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে এর ভেতরে ফাঁকা স্থান থাকায় এটি ইট এবং সলিড ব্লক উভয়ের তুলনায় অধিক তাপনিরোধী। বর্ষাকালে অধিক পানি শোষণ করায় ব্লকের দেওয়ালে অতি সহজে ছত্রাক জন্মাতে পারেনা। ব্লক পরিবেশবান্ধব, মূল্যসাশ্রয়ী, ওজনে হালকা, ভূমিকম্প, আগুন ও লবণাক্ততা প্রতিরোধী, অতি উষ্ণ বা অতি শীতল আবহাওয়ার বিপরীতে নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ দেয়।‘ একটা কংক্রিট ব্লক পাঁচটা ইটের সমান। অনেকে বলেন একটা কংক্রিট ব্লক তৈরিতে খরচ ৪০ টাকা। অন্যদিকে একটি ইটের দাম এখন কমপক্ষে ১০ থেকে ১১ টাকা। স্থান বিশেষ ইটের দাম আরো বেশি। ব্লক ব্যবহারে দেয়ালের খরচ অন্তত ৩০–৪০ শতাংশ কম হয়। ১০০০ ইট দিয়ে প্লাস্টারসহ গাঁথুনি করতে বর্তমান সময়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা খরচ হয়। একজন প্রকৌশলী বলেন, ১০০০ ইটের বিপরীতে ২২২ টা ‘হলো‘ ব্লক দিয়ে গাঁথুনি এবং প্লাস্টারের সিমেন্ট, বালু, এবং লেবার খরচ পড়ে ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি। তাই যারা বাড়ি তৈরির চিন্তা করছেন তারা ব্লক ব্যবহার করার চিন্তা করতে পারেন। ব্লকের ওজন কম ও সাইজে বড় হওয়ায় কম জনবল দিয়ে অতি দ্রুত সময়ে কাজ করা যায়।
ইটভাটায় বছরে ১২৭ কোটি সিএফটি মাটির প্রয়োজন হয়। বছরে ৩ দশমিক ৫ টন কয়লা ও ১ দশমিক ৯ টন জ্বালানি কাঠ ব্যবহার হয়, যা থেকে প্রতিবছর ৯ দশমিক ৮ টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়। এই গ্রিনহাউজ ইফেক্ট থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হবে। সরকারি নির্মাণ কাজের সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান, ট্রাক–লরি–বাস মালিক সমিতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট, শপিংমল ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষসহ সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত দেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্িষত সফলতা অর্জন কষ্টসাধ্য।
সরকারের পাশাপাশি সকল ব্যবসায়ী এবং শিল্প মালিকদের পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। দেশের স্বার্থে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমান ইটভাটার মালিকরাও ব্লক কারখানার উদ্যোক্তা হতে পারেন। ব্লক ব্যবহারের সুফলগুলো বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পত্রপত্রিকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। ব্লক তৈরীর পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে আগামীতে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের বিপক্ষে বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থানকে নিশ্চিত করতে পারবে। একদিকে পরিবেশের দূষণ কমবে, অন্যদিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে কৃষিজমি ও বনাঞ্চল। পাশাপাশি অর্থনীতিতেও যুক্ত হবে নতুন অবদান। তাই দেশের আগামী প্রজন্মকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট