ভূমিকা :
চলতি শতকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন ছেয়ে গেছে মিডিয়া সংস্কৃতির জোয়ারে। বেতার, টেলিভিশন, সিনেমা, ভিডিও গেমস্, মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার– ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ঘিরে ধরেছে শিশুর মন ও শরীর। তার কোন কোনটা সবুজ– অবুঝ বাড়বাড়ন্ত শরীরমনের সুস্থ–স্বাভাবিক বিকাশ–বৃদ্ধির হমকিস্বরূপ।
ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ‘পাবলিক হেলথ ইস্যু ’ হিসেবে বিবেচনায় না নিয়ে অভিভাবক, গবেষক এবং নীতি নির্ধারকেরা এখনো চরম উদাসীনতা প্রদর্শন করছেন। কেউ–বা বসে আছেন একে ‘অবসরের বিনোদন’ গণ্য করে। বস্তুত এখনিই সময়– মিডিয়া জালে বন্দী শিশুদের ওপর তার প্রভাব নিয়ে ভাববার। কেননা এই ডিভাইস–প্রীতি এবং অপব্যবহার শিশুর মনো–সামাজিক সুরক্ষার অন্তরায়।
সেকাল ও একালের শৈশবে পার্থক্য:
ঠাকুর দাদার ছুটি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার ছুটি নীল আকাশে, তোমার ছুটি মাঠে,
তোমার ছুটি থইহারা ওই দিঘির ঘাটে ঘাটে।
তোমার ছুটি তেঁতুল–তলায়, গোলাবাড়ির কোণে,
তোমার ছুটি ঝোপঝাপে পারুল–ডাঙ্গার বনে।
তোমার ছুটির আশা কাঁপে কাঁচা ধানের ক্ষেতে,
তোমার ছুটির খুশি নাচে নদীর তরঙ্গেতে।
মিডিয়া শিশু : ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী
তোমার ছুটি ছাদের নিচে, তোমার ছুটি সোফায়,
তোমার ছুটি থইহারা ওই ফেইস্ বুকেতে ফোঁপায়।
তোমার ছুটি টিভি–তলায়, মোবাইল সেটের কোণে,
তোমার ছুটি ইন্টারনেটে কার্টুন–ম্যুভির বনে।
তোমার ছুটির আশা কাঁপে কম্পিউটার উইনডোতে,
তোমার ছুটির খুশি নাচে ভিডিও গেমস্ শোতে।
বর্তমানের শিশু কতটা পরিমাণ মিডিয়া স্রোতে ডুবে আছে:
শিশুর স্মাার্ট ফোন ব্যবহার করতে দেওয়ার সঠিক বয়স সুনিদিষ্ট নয়। কেননা একেক শিশুর বিকাশ–বৃদ্ধির গতিপথ ও বেড়ে ওঠার ধরন তার নিজস্ব প্রকৃতির। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক তথ্যমতে বলা হয়– ৬ স্কুলগ্রেড বা ১২ বছর বয়স (পূর্বে যা নির্ধারিত ছিলো–৮ স্কুল গ্রেড, ১৪ বছর বয়স) থেকে শিশু এর সঠিক ব্যবহার রপ্ত করতে সক্ষম ।
মা–বাবা সাধারণভাবে আপন সন্তান দুষ্ট প্রতিবেশি ও সহপাঠীদের পাল্লায় পড়বে বলে দুশ্চিন্তায় থাকেন। কিন্তু তাঁরা ভেবে দেখেন না–এই খারাপ সংসর্গ বরং এখন ঘরের মধ্যে। যখন ২০ ফিট দূরে থাকা এক চোখা টেলিভিশন জাদুকর, ২ ফিট দূরের কম্পিউটার উইনডো, কিংবা ১০ ইঞ্চি তফাতে থাকা সেল ফোনের সাহচর্যে সে সময় কাটাচ্ছে।
আামেরিকাতে শতকরা ৮০ জন ছেলেমেয়ে যে কোন এক প্রকারের মিডিয়ায় সময়–যাপন করে, টেক্সট ম্যাসেজ, ই মেইল–কোনো ব্লগ বা ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতিতে।
দৈনিক সময় কাটানোর পরিমাণ ৬ ঘণ্টা ২১ মিনিট। শোবার ঘরে টেলিভিশন দেখে এক চতুর্থাংশ শিশু।
শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর কাজকর্ম, কম্যুনিটি ও সোশ্যাল ক্রিয়াকর্ম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার।
ছোট বাচ্চা যারা ফ্যান্টাসি ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য বোঝে না– তারা এবয়সে ভয়ংকর দৃশ্য অবলোকন পরবর্তী আচরণজনিত জটিল সমস্যায় পতিত হয়।
শিশুর ওপর মিডিয়া সংস্কৃতির কুফল :
শিশুর বাক্স্ফুটুন সমস্যা: এ–বয়সে, শিশুর মস্তিষ্ক স্নায়ু–তারজালি ঘিরে থাকা বাক্শক্তি বিকাশের যে বিন্যাস স্তর, তা ঘরে প্রচলিত মাতৃভাষা ও মিডিয়ায় উচ্চারিত অন্যভাষার মধ্যে গরমিল দেখে–শোনে খেই হারিয়ে ফেলে, তার বাক্শক্তি বিলম্বিত হয়।
মারদাঙ্গা ছবির বিষয়বস্তু তাকে মারমুখী করে গড়ে তোলে, সে তাৎক্ষণিকভাবে তা প্রয়োগও করতে চায়। ভায়োলেন্স দৃশ্যায়ন তাকে ভয় পাইয়ে দেয়, সে বিষণ্নতা ও দুঃস্বপ্নে ভোগে। তার মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হয়, ও তার স্কুল ফলাফল খারাপ হয়– (গবেষক–ইয়ামা এট্ অল্)।
সুইসাইড প্রবণতায় ইন্ধন। ডানপিটে–দুরন্তপনা প্রবৃত্তি, শিশুর প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা।
মাঠে খেলাধুলার মাধ্যমে শিশু সামাজিক নিয়মনীতি–সূত্রের শিক্ষা পায়। কিন্তু তার চারপাশের ভুবনব্যাপী থাকা টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেটের ছড়াছড়ি, তাকে গড়ে তোলে অসামাজিক জীব হিসেবে।
স্থূলকায় হবার ঝুঁকি: সপ্তাহে ১ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় টেলিভিশন দেখার খেসারত হিসেবে শিশুর ওজন প্রায় ২ শতাংশ বাড়ে। এসব শিশু অভিভাবককে রাজী করিয়ে বিজ্ঞাপনে প্রলোভিত নানা অস্বাস্থ্যকর খাবার মেন্যুর স্বাদ বেছে নেয়। এরা ফলমূল, শাকসবজী খায় কম। এ কারণে রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্য অণুপুষ্টি গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়।
কিশোরী কন্যারা ‘ফ্যাশন ম্যাগাজিন’ পড়ে–দেখে ‘স্লিম নায়িকা’ হওয়ার ঘন স্বপ্ন দৌড় ফাঁদে কংকালসার অস্বাস্থ্যের শিকার হয়।
ধূমপান, অ্যালকোহল ও মাদকাসক্তি। পিআইডিসহ বিপজ্জনক যৌন–ব্যাধি ও অবাঞ্চিত গর্ভধারণ ঝুঁকি ।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শিশু–স্বাস্থ্য বিভাগে পরিচালিত গবেষণা ফল:
শিশু–স্বাস্থ্য বিভাগের শিশু–বিকাশ কেন্দ্রে আসা ‘দেরিতে কথা বলা ’ উপসর্গের বেশি হার লক্ষ্য করে দায়িত্বে থাকা আমার মেধাবী ছাত্রী ডা. রাজিয়া সুলতানা মণিকে গবেষণাকমের্র দিক–্নির্দেশিকা তৈরি করে দিই। বর্তমানে শিশুস্বাস্থ্যের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজিয়া ৬০ জন শিশুর ওপর সুচারুভাবে সমীক্ষাটি সম্পন্ন করেন, যা ‘সার্ক আন্তর্জাতিক শিশু–স্বাস্থ্য বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে’ গবেষণাপত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছিলাম।
গবেষণায় প্রাপ্ত মূল উপাত্ত (স্টাডি সামারি)- ছেলে (৮০ শতাংশ), উচ্চবিত্ত, পৌর এলাকায়–আরবান বসবাস(৬০ শতাংশ), দৈনিক ৩ ঘন্টার অধিক ও একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল দেখা, মায়ের কম সাহচর্য সময় পাওয়া সন্তানে ‘দেরিতে কথা বলা, বা ‘স্পীচ্ ডি–লে’ উপসর্গের সাথে যোগসূত্র রয়েছে।’
শিশু–বয়সে মিডিয়া–মাধ্যম ব্যবহারের নানা সুফল :
এ প্রসংগে রবীন্দ্রনাথের ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধটি স্মরণযোগ্য। পাঠাগারের অধুনা রূপ হিসেবে বিবেচনায় রেখে গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনের সুপ্রয়োগ মানবজীবনে বিপুল জ্ঞান–ভান্ডার গুপ্তধন আহরণ–পথ সুগম করে দেয়।
শুভ চিন্তা–চেতনার নানা চিত্রযোগ, জিওগ্রাফিক্যাল চ্যানেল, কুইজ প্রোগ্রাম দেখে ও বড় বড় রাষ্ট্রনায়কের ভাষণ শোনে, তার মেধাশক্তি শাণিত হয়। ভাষাজ্ঞানে সবলতা। শিশু স্পোকেন ইংলিশে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে, যেমন–কার্টুন চ্যানেল।
একাকী শিশু সাহচর্য পায়, নিরানন্দ গুমোট আবহাওয়াজনিত বন্দিদশার মুক্তিদাতা।
মিডিয়া পরিচালন কর্তৃপক্ষের দায়–দায়িত্ব :
প্রিন্ট মিডিয়া ‘মডেল উপস্থাপনে’ সতর্ক থাকবে। শিশুর জন্য স্বাস্থ্যকর বার্তা পরিবেশন, যেমন– খেলাধুলা, স্বাস্থ্যকর খাবার মেন্যু বয়:সন্ধিকাল, স্থূলকায়ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে শিশুকে সচেতন করা।
ট্র্যাজিক সংবাদ পরিবেশনকালে শিশু–মন যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়–সেরূপ সাবধানতা অবলম্বন। মিডিয়া ব্যবহারে সর্বদা ৫–সি মডেল ধারণ– চাইল্ড (শিশু), কনটেন্ট বিষয়বস্তু), কাম(শান্তভাব), ক্রাওডিং আউট(ঘিঞ্জি এড়ানো), ও কম্যুনিকেশন( যোগাযোগ)।
মিডিয়া অপব্যবহার রোধে অভিভাবকের দায়িত্ব–কর্তব্য:
ক্ষতিকর চ্যানেল বিষয়ে সচেতনতা। শিশুকে সাথে রেখে চ্যানেল উপভোগ ও সে সম্পর্কিত খোলামেলা আলোচনা।
বিশেষজ্ঞ এডউনা ইউয়াং পিএইচডি জানাচ্ছেন– শিশুর যতো কমবয়স থেকে মিডিয়া সময় সুচারুভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তা ততোই মঙ্গলজনক।
অভিভাবকের নিজের মিডিয়া–সময় সীমিত রাখা ও অন্য অভিভাবকদের সাথে এ নিয়ে ভাবনা বিনিময়।
আমেরিকান এসোসিয়েশন অব প্যাডিয়ট্রিকস–এএপি কর্তৃক শিশু–বয়সে মিডিয়া ব্যবহার নির্দেশিকা:
ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে প্রতিপক্ষ না ভেবে, শিশু–কিশোরবান্ধব রূপে ব্যবহারে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ।
১৮ মাসের কম বয়সী শিশুদের জন্য, ভিডিও–চ্যাটিং ব্যতীত স্ক্রিন মিডিয়ার ব্যবহার এড়িয়ে চলা। ১৮ থেকে ২৪ মাস বয়সী বাচ্চাদের বাবা–মা যারা ডিজিটাল মিডিয়া চালু করতে চান, তাদের উচিত উচ্চ–মানের প্রোগ্রামিং বেছে নেওয়া এবং বাচ্চাদের সাখে একত্রে বসে দেখা।
২ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য, উচ্চ–মানের প্রোগামগুলোর জন্য প্রতিদিন ১ ঘন্টা স্ক্রীন ব্যবহারে সীমাবদ্ধ রাখা। অভিাবকদের উচিত–সন্তানের সাথে মিডিয়া দেখা, তারা যা দেখছে তা বুঝতে এবং তাদের চারপাশের বিশ্বে তা প্রয়োগে সহায়তা দেওয়া।
৬ বছর বা তার বেশি বয়সী শিশুদের জন্য স্কুল খোলার দিনগুলোতে দৈনিক ১ ঘণ্টা ও স্কুল বন্ধের দিনে সপ্তাহে ২ ঘণ্টার মিডিয়া সময় নির্ধারণ। মিডিয়ার ধরনগুলোর উপর সামঞ্জস্যপূর্ণ সীমা বজায় রাখা এবং নিশ্চিত করা যে, মিডিয়া যেন সন্তানের পর্যাপ্ত ঘুম, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ, স্বাস্থ্যকর জীবন–যাপন ও আচার–আচরণের জায়গা দখলে না নেয়।
টিভি, ভিডিও গেমস, ইন্টারনেট সরঞ্জামে সন্তানের শোবার ঘর যেন ‘মিডিয়া সেন্টারে’ পর্যবসিত না করা হয়। পরিবারে মিডিয়ামুক্ত সময় নির্ধারণ, যেমন– আহার গ্রহণকালিন, গাড়ি চালানো অবস্থায় এবং সেইসাথে বাড়িতে মিডিয়া মুক্ত অবস্থান, যেমন– শোবার ঘর।
অনলাইন নিরাপত্তা ও অনলাইন–অফলাইনে অন্যদের সাথে সম্মানের সাথে আচরণ শিক্ষা। অভিভাবক যেন নিজেই ‘আদর্শ মডেল’ হিসেবে ঘরে–বাইরে ভূমিকা পালনে অবতীর্ণ হন।
লেখক : প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।