বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু নিত্য দিনের ঘটনা। আমাদের দেশে জলে ডুবে শিশুর মৃত্যু মহামারি আকার ধারণ করেছে। পত্রিকা খুললেই বা টেলিভিশনে খবর দেখলেই জানতে পারা যায় সারাদেশে প্রতিদিন অন্তত ৩০–৩৫ জন শিশুর মৃত্যুর খবর। এটার জন্য প্রথমেই দায়ী করা যায় মা–বাবাকে। তারা ছেলেমেয়েদের যত্ম নেয় না, কোথায় যায় কী করে একেবারেই খেয়াল রাখে না। একটা কারণ যাদের বেশি ছেলে মেয়ে আছে তারা সবার রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে না। তার ওপর শিক্ষার অভাব ও দারিদ্রতা। অনেক সময় দেখা যায় মা–বাব দুজইে কাজে চলে গেছে। যার নিকট দিয়ে গেছে তাদের অবহেলা মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে পারে। প্রায় দেখবেন নানা বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পানিতে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গ্রামেগঞ্জে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। নদী মাতৃক দেশ আমাদের বাংলাদেশ, তার ওপর প্রায় বাড়ির সংলগ্ন পুকুর। ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশ গিজগিজ করে বাস করতে হয়। কার ছেলে কোথায় পানিতে পড়ল খরব রাখা মুশকিল। বর্ষাকালে ঘটনা বেশি হয় কারণ চারিদিকে থৈ, থৈ পানি, তার পরেও এই মৃত্যু জন্য দায়ী মা–বাবা ও নিকটতম আত্মীয় স্বজনেরা। তাই বলবো একদম শিশু অবস্থা থেকে সাঁতার শেখা খুবই জরুরি। এটা গণপ্রচার মাধ্যমে আসতে হবে।
পাড়ায়, মহল্লায়, জেলা, উপজেলায় মাইকে প্রচার করতে হবে। শিশুদের পুকুরে ডুবে মরার হাত থেকে বাঁচান। সবাই সচেতন হোন। দরকার হলে পোস্টারিং করতে হবে। প্রাথমিক স্কুল ও কিন্ডার গার্টেন স্কুল থেকে গুরুত্ব সহকারে সবাইকে ধারণা দিতে হবে। শিশুদের সাঁতার শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের পাঠ্য পুস্তকে প্রবন্ধ থাকতে হবে। নতুবা সুকুমার রায়ের “ষোল আনা মিছে ছড়া/ কবিতার মত বাবু মশায়ের অবস্থা হবে। সাঁতার শিখা প্রতিটা মানুষের জীবনে অনিবার্য হতে হবে। টেলিভিশনে দেখবেন বিদেশিরা সি–বীচে বা সুইমিংপুলে বেড়াতে গেলে এক, দেড় বছরের শিশুদের অল্প পানিতে ছেড়ে দেয়। তারা হাত পা নাড়তে নাড়তে একদিন নিজে নিজে সাঁতার শিখে যায়, স্বাবলম্বী হয়। সুকুমার রায়ের ‘ষোল আনাই মিছে’ কবিতায় বলেছেন– শখের বশে বাবু মশাই নৌকাতে উঠলেন, মাঝিকে জগতের বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলেন– যেমন: সূর্য কেন উঠে, চাঁদ কেন বড়–ছোট হয়, জোয়ার বাটা কীভাবে হয়, রাতদিন কীভাবে হয়।’ মাঝি বলে আমি মূর্খ মানুষ আমি কী এই গুলির জবাব দিতে পারি? তখন বাবু মশাই ভর্ৎসনা করে বৃদ্ধ মাঝিকে বলেন ‘বলব কি আর বলব তোরে কি–তা, / দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।’ এমন সময় নদীতে ভীষণ ঝর উঠলো। বাবু ভয়ে কাঁপতেছে। মাঝি জিজ্ঞেসা করলো। সাঁতার জানেন বাবু? বাবু বল্লেন না, “তখন মাঝি বলেন, “বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে। তোমার দেখি জীবনটা ষোল আনাই মিছে।” তাই অতি দুঃখের সাথে বলতে হয় আমরা এই কবিতা থেকে কিছুই শিখিনি। নইলে দেশে প্রতি বছর শিশু থেকে বৃদ্ধ, শিক্ষিত অশিক্ষিত সাঁতার না জানার কারণে মারা যায়। অথচ একটু সচেতন হলে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। চট্টগ্রামেরই একটা ডাক্তারের মেয়ে যে মেয়েটা কয়েকদিন পর উচ্চ শিক্ষার্থে অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা সে পশ্চিম বঙ্গের গঙ্গায় ডুবে মারা গেলো। সে নিশ্চই সাঁতার জানতো না। এই রকম কত সম্ভাবনাময় জীবন অকালে ঝরে যাচ্ছে শুধু সাঁতার না জানার কারণে। সাঁতার একবার শিখলে জীবনে ভুলে না। বর্ষাকালে দেশের একটা বৃহৎ অঞ্চল পানিতে ডুবে থাকে। নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ ছাড়া চলা যায় না। তাতে দুর্ঘটনায় বহুসংখ্যক মানুষ প্রাণ হারায় শুধু সাঁতার না জানার কারণে। প্রতি মাসেই ২/৩টা নৌকা, লঞ্জ, ট্রলার ডুবি হয়। কত মর্মান্তিক এই মৃত্যু। শুধু শিশু কেন প্রাপ্ত বয়স্করাও শুধু সাঁতার না জানার কারণে এই দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলে প্রতি বছর পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার মোট শিশু মৃত্যুর ৪৩ শতাংশ। সারা বিশ্বে পানিতে ডুবে যাওয়া মৃত্যুকে অন্যতম একটা মৃত্যুর কারণ স্বীকৃতি দিতে এবং সেটা প্রতিরোধযোগ্য তা তুলে ধরতে ২০০১ সালে সাধারণ পরিষদ ২৫ জুলাইকে “বিশ্ব পানিতে ডুবার প্রতিরোধ দিবস হিসাবে ঘোষণা করে।” একমাত্র সচেতনতাই পারে এই মহামারি থেকে শিশুদের রক্ষা করতে। সাঁতার শিখতে পয়সা খরচ হয় না। নতুন প্রজন্ম হয়তো জানে না আমাদের বাঙালির গর্ব প্রয়াত ব্রজেন দাশ ১৯৫৮ সালে ১৮ আগস্ট ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরিয়ে অতিক্রম করেছিলেন। এই কৃতিত্ব পুরো বাঙালি জাতির, পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার।পরিশেষে বলবো প্রতি ঘরে ঘরে জানতে হবে জলে ডুবে যাওয়া শিশুদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া, সরকারের উচিত প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিও লজিস্ট
বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম