বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা

রাশেদ রউফ | শুক্রবার , ২ আগস্ট, ২০২৪ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক জনসভায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার চূড়ান্ত নির্দেশনা দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বলেছেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারিতোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ এবং বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বস্তুত এটাই ছিল বীর বাঙালির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা। তারপরে যা কিছু, সব এর ধারাবাহিকতায় ঘটেছে।

বঙ্গবন্ধু ২৩ মার্চ ধানমণ্ডির নিজ বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। দেশজুড়ে উড়তে থাকে লালসবুজের পতাকা। এরমধ্যেই বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা চালানোর নির্দেশ দিয়ে পাকিস্তানি জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন।

২৬ মার্চ ১৯৭১। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমদের লেখায় আমরা পাই, সত্তরের নির্বাচনে যদি বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ না করতেন বা যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেতেন, তাহলে স্বাধীনতা ঘোষণা করার সুযোগ পেতেন না, কিংবা হয়তো পেতেন, তবে অনেক পরে। বঙ্গবন্ধুকে অনেকেই বলেছিলেন, ‘এলএফওর (লিগাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার) অধীনে সত্তরের নির্বাচনে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।’ তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এলএফও! এই নির্বাচনকে গণভোট হিসেবে আখ্যায়িত করে আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব এবং প্রমাণ করব কে এই দেশের নেতা। আর নির্বাচনের পর আমি এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব।’

ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার আগেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইপিআরের ওয়ারলেস বার্তায় প্রচার করা হয় বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষণা। আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের ইপিআর সদর দফতর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ইংরেজি ও বাংলায় ছাপিয়ে হ্যান্ডবিল আকারেও চট্টগ্রামে বিলি করা হয়।

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পর চট্টগ্রাম থেকে সমপ্রচার শুরু করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এর অন্যতম সংগঠক বেলাল মোহম্মদের ভাষায়, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সেই ঘোষণা প্রথম সমপ্রচার করা হয়। বেতারে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। এছাড়াও ২৬ মার্চ সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিংয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দুপুরের মধ্যে ঘোষণাটি বাংলায় অনুবাদ করে লিফলেট আকারে বিলি করা হয়েছে। এমনকি বেতারের কর্মীরাও নিজ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি সমপ্রচার করতে থাকে।

১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ্বের কমপক্ষে ২৫টি দেশের পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ২৬ মার্চ রাতে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি, এনডিপি ও পিটিআই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ প্রচার করে। ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়ার সংবাদে বলা হয় : ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন’। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সি (ডিআইএ)-এর স্পট রিপোর্টে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসএর খবরে বলা হয়, ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক।’ ব্রিটেনের অন্যতম পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের সংবাদে বলা হয়, ‘গ্রেফতার হওয়ার আগে মুজিব তার দেশের মানুষের উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।’

দ্য ডেইলি টাইমসএর সংবাদে বলা হয়েছে, বীরোচিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের জবাব দিয়েছেন বাঙালি জাতির সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেছেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’

ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে ব্রিটেনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ডেভিড লোশাক লিখেছেন, ‘…শব্দ খুব ক্ষীণ ছিল। খুব সম্ভবত, ঘোষণাটি আগেই রেকর্ড করা ছিল।’

১৯৭১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এডওয়ার্ড হিথ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এ বিষয়ে বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। ইউরোপের জেনারেলরা মনে করে যে, শেখ মুজিব জীবিত থাকুন বা না থাকুন, পাকিস্তানিরা আর বাঙালি জাতিকে সম্পূর্ণ পরাজিত করতে সমর্থ হবে না।’

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান দুপুর ২টা ১০ মিনিটে এবং ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’ তৃতীয় খণ্ডে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর, অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি, যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি বেতারকেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

জেনারেল নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি ছোঁড়া হল, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। ঘোষণায় বলা হয়, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিষিদ্ধের পর জামায়াতের মোকাবিলা ‘জঙ্গি সংগঠন’ হিসেবে : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধজামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ