প্রবাহ

ছারছীনা : শাহ মাওলানা মোহেব্বুল্লাহ (রহ.)

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩১ জুলাই, ২০২৪ at ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ

ছারছীনা বৃহত্তর বরিশালের বর্তমান পিরোজপুর জেলার প্রত্যন্ত অজপাড়া একটি গ্রাম। হযরত শাহ মাওলানা মুহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ (রহ.) তৎপিতা শাহ মাওলানা আবু জাফর মুহাম্মদ ছালেহ, তৎপিতা দরবারের মূল প্রতিষ্ঠাতা শাহ মাওলানা নেছারুদ্দীন (রহ.)’র খুলুসিয়তে ত্যাগে তরিকত ভিত্তিক প্রায় ১ বর্গ কি.মি বা তারও বেশি এরিয়া নিয়ে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে আজ ছারছীনা বাংলাদেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটা শব্দই পরিচিত আর তা হল “ছারছীনা”। হযরত শাহ মাওলানা নেছারুদ্দীন (রহ.) নিজ এলাকায় ১৯১২ সালের দিকে বাড়ির নিকটে গোলপাতার এক জীর্ণ কুঠিরে শুরু করেন পবিত্র কোরআন শিক্ষার তালিম।

হযরত শাহ মাওলানা নেছারুদ্দীন (রহ.) ১৮৭১ সালের দিকে জন্মগ্রহণ করেন। কৃতিত্বের সাথে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। অজপাড়া গাঁয়ে ধর্ম মতে জুমা প্রযোজ্য নয় বিধায় তথায় তখন জুমা হত না। তিনি প্রথম তথায় জুমা প্রতিষ্ঠা করেন। ৩০ বছর বয়সে ১৯০১ সালে তথা বাংলা ১৩০৮ সনে সপরিবারে হজ্বে গমন করেন। একনাগাড়ে ৩ বছর তথায় অবস্থান করেন ঘর ভাড়া করে। তথায় তার স্ত্রী পুত্র ইন্তেকাল করেন। দেশে এসে পুনঃ সাধী করেন। ফুরফুরার বিশ্বখ্যাত মুজাদ্দেদে জামান হযরত শাহ মাওলানা আবু বকর ছিদ্দিক (রহ.)’র নিকট মুরিদ হন পরবর্তীতে খেলাফত লাভ করেন। নিজের পীরের প্রতি অসাধারণ ভক্তি শ্রদ্ধা একালে অনুকরণীয় অনুসরণীয়।

শাহ মাওলানা আবু বকর ছিদ্দিক (রহ.) রসূলনোমা সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়ায়েসী (রহ.)’র ৩৫ খলিফার মধ্যে অন্যতম। হযরত সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী ফুরফুরা (রহ.)ও সুুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়ায়েসী (রহ.)’র অন্যতম খলিফা। ফুরফুরা তাঁরা উভয়ে আপন মামাতফুফাত ভাই। কলকাতায় মানিকতলায় শায়িত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়ায়েসী (রহ.)’র জন্মস্থান চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার মল্লিক সোবহান গ্রামে। অনেক আগে ফুরফুরা ভিত্তিক একাধিক গ্রন্থে জন্মস্থান আমিনা বাজার বা আমিরা বাজার লিখা হচ্ছে। তা কিন্ত ভুল। সুফি গোলাম সালমানী ফুরফুরার সরাসরি ছাত্র উপমহাদেশে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী তাঁর আত্মজীবনীতেও জন্মস্থান মল্লিক সোবহান উল্লেখ করে গেছেন।

ছারছীনায় জনগণের আর্থিক সহায়তায় মাদ্রাসা দ্রুততার সাথে এগিয়ে যেতে থাকে। সরকারী মঞ্জুরী নীতি বিধি মানতে ১৯২৭ সালে প্রথম ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা হয়। এতে বৃহত্তর বরিশালের কৃতী পুরুষ অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জাতীয় নেতা শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক সভাপতি এবং প্রতিষ্ঠাতা শাহ মাওলানা নেছারুদ্দীন (রহ.) সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। পর্যায়ক্রমে মাদ্রাসা এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯২০ সালে পাকা মসজিদ, ১৯৩১ সালে মাদ্রাসা পাকা দালানের দিকে এগিয়ে যায়। সেই সময় গ্রামাঞ্চলে কামিল তথা টাইটেল এর অনুমতি দেয়ার প্রশ্নই আসে না। বারে বারে প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে ১৯৩৮ সালে সরকারীভাবে টাইটেল তথা কামিল অনুমতি লাভ করে। ১৯৪২ সালে এসে ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গ অনুমতি লাভ করে। ১৯৪৪ সালে এসে সরকারীভাবে মঞ্জুরী পায়। মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতার রাতদিন প্রচেষ্টায় তরিকতের খেদমতের পাশাপাশি এ মাদ্রাসা দ্রুততার সাথে প্রসার লাভ করতে থাকে।

শাহ মাওলানা নেছারুদ্দীন (রহ.) জীবনে তিনবার হজ্বব্রত পালন করেন। সর্বশেষ বার ৮০ বছরের বৃদ্ধ বয়সে ১৯৫০ সালে তথা ১৩৫৬ বাংলায়। ১৪০১ জন হাজীকে অসংখ্য আবেদনকারী থেকে বাছাই করে নির্ধারণ করা হয় তাঁর হজ্বের সফর সাথী হিসেবে। তিনি জাহাজে চাঁনপুর ঘাটে আসেন। এখান থেকে বিশেষ ট্রেনে চট্টগ্রাম পৌছেন। চট্টগ্রামে অবস্থান করে ২৭ ভাদ্র মোজাফ্‌ফরী জাহাজে জেদ্দা রওনা হন। হজ্ব পালন করে দুর্বল হয়ে পড়েন। ফলে জেদ্দা হয়ে আকাশপথে পবিত্র মদিনা যান। তথায় যেয়ারতের উদ্দেশ্যে ১২ দিন অবস্থান করেন। অতঃপর বিমান যোগে ১৯৫০ সালের ১২ নভেম্বর করাচি হয়ে ঢাকা পৌঁছেন।

প্রায় ১ বছরের ব্যবধানে ১৯৫২ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ১৩৫৮ বাংলা ১৮ মাঘ ১৩৭১ হিজরির জমাদিউল আউয়াল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১০ টার দিকে ইন্তেকাল করেন। মাদ্রাসা মসজিদ চত্বরে সাদামাটাভাবে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

তাঁর বড় ছাহেবজাদা শাহ মাওলানা আবু জাফর মুহাম্মদ ছালেহ পিতার রেখে যাওয়া শরীয়ত তরিকতের বিশালত্বের হাল ধরেন। তিনি পিতার রেখে যাওয়া এই বিশাল শরীয়ত তরিকতের যাবতীয় কিছু সুচারুভাবে আনজাম দিতে থাকেন। মাদ্রাসা এর অবকাঠামো দ্রুততার সাথে বাড়াতে থাকেন। বাড়তে থাকে ছাত্র সংখ্যা। দুই ক্যাটাগরীতে পাঠ দানের পদ্ধতি চালু করেন। যা চট্টগ্রাম অঞ্চলে সরকারী বেসরকারী বলা হয়। বেসরকারী মাদ্রাসাকে চট্টগ্রামে কওমী মাদ্রাসা বলে। ছারছীনা ভিত্তিক মাদ্রাসাতে বেসরকারী মাদ্রাসাকে দ্বীনিয়া মাদ্রাসা বলে। তিনি ১৯৯০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকায় সম্বিলিত সামরিক হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার সকাল ৯ টায় ঢাকা জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সমাগমে প্রথম নামাজে জানাযা হয়। অতঃপর হেলিকাপ্টার যোগে তাঁকে ছারছীনা নিয়ে যাওয়া হয়। তথায়ও লাখ লাখ ভক্ত মুরিদানের সমাগমে জানাযা হয়। পিতার পাশে সমাহিত করা হয়।

তাঁর ইন্তেকাল পরবর্তী ছারছীনা কেন্দ্রীক শরীয়ত তরিকতের বিশাল কর্মকান্ড সমূহের হাল ধরেন তারই সুযোগ্য পুত্র শাহ মাওলানা মুহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ। তিনি পিতা দাদার রেখে যাওয়া শরীয়ত তরিকতের যাবতীয় কর্মকান্ড রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সুন্দর সুচারুরূপে পরিচালনা করে যাচ্ছিলেন।

দ্বিতীয় বার ছারছীনা গমন করলে তাঁর সাথে মোলাকাতের সৌভাগ্য হয়। তিনি শরীয়ত তরিকতের সফরে চট্টগ্রাম তাশরীফ আনলে তাঁর সাথে মোবাইলে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়।

ছারছীনা কঠোর শরীয়ত ভিত্তিক তরিকত; তরিকত ভিত্তিক সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছারছীনায় বছরে তিনবার ধর্মীয় মাহফিলের আয়োজন করা হয়। যেখানে উপস্থিত হয় লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তাদের রয়েছে সুন্নত মতে ভিন্নধর্মী লেবাজ। দেখলেই বুঝা যায় তিনি ছারছীনা সিলসিলাভুক্ত। ছারছীনা থেকে অনেক ধর্মীয়গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তারা পাক্ষিক তাবলীগসহ একাধিক ধর্মীয় ম্যাগাজিন প্রকাশ করে।

শিরক বিদআতমুক্ত তরিকত ভিত্তিক শরীয়তে বিশাল প্রতিষ্ঠান তথায় গিয়ে স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হবে। বৃহত্তর বরিশাল মানে আঁকাবাঁকা অসংখ্য নদী কেন্দ্রিক। তেমনিও সন্ধ্যা নদীর তীরে এ ছারছীনা। গত ৬ জুলাই মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২ টার দিকে শাহ মাওলানা মুহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ (রহ.) ইন্তেকাল করেন। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার ছারছীনায় লাখ লাখ সমাগমে জানাযার পর তাঁকে মাদ্রাসা মসজিদ কম্পাউন্ডে দাদা বাবার নিকট সমাহিত করা হয়।

আমাদের দেশের যে কোন প্রতিষ্ঠান বিশালত্ব লাভ করতে হয়ত সরকারের অর্থায়ন বা আরব রাষ্ট্র থেকে আর্থিক সহায়তায়। ছারছীনা তার ব্যতিক্রম। প্রায় ১ বর্গ কি.মি বা তারও বেশি এরিয়া নিয়ে তরিকত ভিত্তিক বিশাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৫০ ফুট বা কম বেশি লম্বা চারতলা বিশিষ্ট ৮/৯ টি দালান, /৩ তলা বিশিষ্ট আরও কতেক দালানের সমন্বয়ে এই ছারছীনা ইসলামী জংশন। ইহা সরকারী বেসরকারী দুইভাগে বিভক্ত।

তারা নারীর পর্দার ব্যাপারে অত্যধিক কঠোর। ব্রিটিশ আমলে শেরে বাংলার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর জাহাজে করে এখানে আসেন। বানিয়ে মাদ্রাসা তথা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অনুমতি দেননি ব্রিটিশের প্রতাবশালী গভর্নরের স্ত্রীকে পীর ছাহেবের সাথে সাক্ষাত করতে। গর্ভণর সাক্ষাত করে আসেন। আজও দেশের কোন নারী নেত্রী এখানে পদার্পণ করেননি বলে জানতে পারি।

আজ থেকে ১০/১২ বছর আগে রমজান পরবর্তী ঈদুল ফিতরের ২/৩ দিন পর পুনঃ ছারছীনা গমন করা হয়। শরীয়তপুর হয়ে তথায় পৌছি বেলা ১১ টার পরপর। চট্টগ্রাম কমিটির সভাপতি পীর ছাহেবকে টেলিফোনে সংবাদ দেন আমরা তথায় যাচ্ছি। ঐ সময় সম্প্রতি ইন্তেকাল হওয়া হযরত শাহ মাওলানা মুহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ (রহ.) ছিলেন। মাদ্রাসা বন্ধ থাকলেও তথায় তরিকতের অনেক লোকজনের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করি। নিজে সাদামাটা জীবন যাপন করলেও মেহমানখানা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ফল ফলার আতিথেয়তার পর তার সুযোগ্য সন্তান হযরত শাহ মাওলানা আবু নছর নেছারুদ্দীন হোসাইন দীর্ঘ সময় দিয়ে আমাদেরকে মাদ্রাসা কমপ্লেক্স ঘুরে দেখান। প্রকান্ড মসজিদে যোহরের নামাজ অতঃপর যেয়ারত। এরই মধ্যে মেহমান খানায় রাজসিক খাবারের আয়োজন। মরহুম (তখনকার সময়ে) ৬ রোজা থাকলেও মেহমানের সাথে বসে আছেন, খাবারের আয়োজন চেয়ার টেবিলে না হয়ে ফ্লোরে করা হয়েছে। বিভিন্ন মাছের আয়োজন, সাথে একাধিক আইটেমের গোস্ত খাওয়া পরবর্তী মিষ্টান্ন রাখা হয়েছে। তাকে কেন জানি নিরহংকারী মনে হল। অহংকার করা হারাম ব্যক্তিত্ব রক্ষা করা সুন্নত। চট্টগ্রাম অঞ্চলেও ছারছীনার পক্ষ থেকে বড় বড় মাহফিলের আয়োজন করা হয়। রমজানে জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের নিচতলায় ২/৩ হাজার লোকের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয় ছারছীনার তরিকতের পক্ষ থেকে। পীর ছাহেব চট্টগ্রামে ১/২ দিনের জন্য তাশরীফ আনলে ব্যস্ততম সময় পার করবেন স্বাভাবিক। তারপরও আমার সাথে মোবাইল করে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

বস্তুতঃ হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রহ.)’র দেশ বিদেশে প্রায় ৭ শতের কম বেশি খলিফার মধ্যে ছারছীনা হযরত শাহ মাওলানা নেছারুদ্দীন (রহ.) কে অন্যতম মনে করা হয়ে থাকে। তাঁর খুলুসিয়ত প্রচেষ্টায় শিরক বিদআতমুক্ত তরিকত ভিত্তিক শরীয়তের দেশব্যাপী বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠান। তিনি এবং তাঁর বুজুর্গ সন্তানের কারণে অজপাড়া গাঁয়ে ছারছীনা আজ দেশ পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিচিত।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধমাওলানা মো. আবু তাহের নিজামী