বৃদ্ধাশ্রম কালচার : যার জন্য আমরাই দায়ী

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ৩০ জুলাই, ২০২৪ at ১১:১১ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বছর ঈদের সময় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেশের বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে প্রতিবেদন সম্প্রচার করে। এর ধারাবাহিকতায় এই বছর প্রচারিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোকজনও আজকাল এসব বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করছেন। তাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট বুঝা যায় এদের অনেকেই অভিজাত শ্রেণির মানুষ। যাদের ঢাকা সহ বড় বড় শহরে বাড়ি গাড়িসহ যথেষ্ট আর্থিক সামর্থ্য ছিলো। কিন্তু সন্তানের চরম অবহেলা, রূঢ় আচরণ ও নিয়তির নির্মম পরিহাসের কারণে আজ তারা বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ বৃদ্ধাশ্রম। এখানে বসবাস করেন ৮৭ বছর বয়সি এক অসহায় বাবা, উচ্চ শিক্ষিত। চার সন্তানকে মানুষ করেছেন কিন্তু সে সন্তানরাই তাকে ভুলে গেছে। নাম প্রকাশ করতে চাননি। এমনকি সন্তানদের নাম, অবস্থানও জানাতে চান না। তিনি বলেন, সন্তানরা যদি নরকেও রাখে, ফেলে দেয়, তবু তাদের অমঙ্গল চাইব না। না খেয়ে মরে গেলেও অপবাদ দেব না। বদদোয়া করব না। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন আত্মহত্যা করতে, করেন নি। কারণ স্বাভাবিক মৃত্যু হলে কেউ জানবে না, ওনার প্রতি সন্তানরা কী জঘন্য আচরণ করেছে। তাছাড়া ওনার পরিচয়ও গণমাধ্যমে আসবে না। কিন্তু আত্মহত্যা করলে পরিচয় জানাজানি হবে। জেনে যাবে ওনার সন্তানদের পরিচয়। তখন সন্তানরা সমাজে ঘৃণার পাত্র হবেএটি উনি বাবা হিসাবে মেনে নিতে পারবেন না।

এই বৃদ্ধাশ্রমটিতে তার মতো আরো ১৪ জন বাবা এবং ১৬ জন মা রয়েছেন। তাদের প্রায় সবাই বিত্তশালী ও উচ্চ শিক্ষিত। কেউ ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সচিব কেউ বা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। আছেন বিত্তশালী ব্যক্তির স্ত্রীও। তেমনই এক মা বলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। স্বামীও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, পুলিশের ডিএসপি ছিলেন। ১৯৯২ সালে স্বামী মারা যান। দুই সন্তান থেকেও নেই। বাবার বিশাল সম্পদ, বরিশাল তালুকদার বাড়ির মেয়ে তিনি। রাজধানীর মিরপুর এলাকায় ৮ তলা বাড়ি। দুই ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি মেজো। ওই বাড়িতে ঠাঁই হয়নি তার। আক্ষেপ করে বলেন, ওই বাড়ির এক কোণায় কিংবা সন্তানদের বাসার এক পাশে যদি একটু জায়গা হতো, তাহলে সন্তান, ভাই, ভাইয়ের ছেলেমেয়ে, স্বজনদের দেখতে পেতেন। নিজেকে শূন্য মনে হতো না। বেঁচে থাকার ইচ্ছা থাকত যেমনটা এখন পান না।

রাজধানীর প্রবীণ হিতৈষী সংঘ বৃদ্ধাশ্রম ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে সারা দেশে অন্তত ১৪১৫টি বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। যেখানে টাকার বিনিময়ে বয়স্কদের রাখা হয়। এসব কেন্দ্রে একসময় যারা বিত্তবান ছিলেন, এখন নিঃস্বতাদের একটি বড় অংশ মাসিক টাকা দিয়ে থাকছেন।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে সরকারি পর্যায়ে কোনো বৃদ্ধাশ্রম নেই। রয়েছে ৮৫টি শিশু পরিবার। প্রতিটি শিশু পরিবারে ১০ জন করে বৃদ্ধবৃদ্ধা থাকতে পারেন। তবে ওনারা ৮টি বিভাগের ৮টি জেলায় ‘শান্তি নিবাস’ নামে বিশেষ ভবন নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। যেখানে প্রতিটি শান্তি নিবাসে ২৫ জন করে বৃদ্ধবৃদ্ধাকে বিনামূল্যে রাখা হবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের সবচেয়ে বড় বৃদ্ধাশ্রম হচ্ছেগাজীপুর বয়স্ক পুনর্বাসনবৃদ্ধাশ্রম কেন্দ্র। যেখানে বর্তমানে ১৭০ জন বৃদ্ধবৃদ্ধা রয়েছেন। এখানে বিত্তশালী নারীপুরুষও বিনামূল্যে থাকছেন। অনেকে নিজেকে সমাজ থেকে আড়াল করে নিয়েছেন। সন্তানপরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এসব মানুষ আজ বড়ই একা।

আসলে সমাজে বৃদ্ধাশ্রম কালচারের কারণে বিত্তশালীদের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সন্তান মাবাবাকে আলাদা করে দিচ্ছে কিংবা পরিবার থেকে বের করে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ পরিবারে থেকেও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। ঘর বা বাসার কোনো এক কোণায় মাবাবাকে রেখে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখন ঘরেবাইরে প্রচুর বৃদ্ধাশ্রম চোখে পড়ছে। অনেকের একাধিক বাড়িফ্ল্যাট রয়েছে। ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষিত, চাকরি বা ব্যবসাবাণিজ্যের কারণে বিদেশে রয়েছেন। বছরের পর বছর মাবাবাকে দেখতে আসেন না। এদের একটি বড় অংশ বিত্তের মধ্যে থেকেও একা জীবনযাপন করছেন। যাদের অনেকেই মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এদের কেউ কেউ আবার দেশে থাকা মাবাবাকে বয়স্ক বা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাচ্ছেন।

এই বিষয়ে মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত হলো, দীর্ঘদিন ধরে চার দেওয়ালের মধ্যে কাটানোর প্রভাব পড়তে পারে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য তাদেরকে অন্যের সাথে মেলামেশা করাটা জরুরি। অন্যদিকে দীর্ঘদিন নিঃসঙ্গ থাকলে স্মৃতিশক্তিতে প্রভাব পড়তে পারে। এটি শুধু বৃদ্ধাশ্রমে নয়। নিজ গৃহে, গৃহের অন্দরমহলেও হতে পারে। কারণ সমাজের মানুষ এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সামগ্রিকভাবে বাঁচতে চায় না। একা চলতে বেশি পছন্দ করে। তাঁরা বলেন, সম্পদ নিয়ে সাধারণ মানুষ নয় বরঞ্চ বিত্তশালীরাই মাবাবা, সন্তান থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আবার বাবা মারা সন্তানদের পড়াশোনা করাতে নিজের অর্জিত টাকাপয়সা, সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে পাঠাচ্ছেন ইয়ং বয়সে। ফলে পড়াশোনা শেষ করে তারা আর দেশে আসছেন না। এটা বাবা মা নিজেরা জেনেশুনেই করছেন। সমাজে নিজেকে বড় করে তুলতে বিদেশে সন্তানদের পাঠিয়ে স্বস্তির ঢেকুর তুলেন। যা পরবর্তীতে তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কখনো এটা ভাবেন না যে, নিজের সন্তান যদি বৃদ্ধ অবস্থায় ওনার কাছে না থাকে, তাহলে কার এমন দরকার পড়েছে যে বৃদ্ধ অবস্থায় ওনার কাছে থেকে ওনার খেদমত বা দেখভাল করার?

মাঝে মধ্যে ভাবি আমাদের সমাজটা কেন এতো নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে? কেন সন্তানেরা বাবা মাকে যথাযথ সম্মানের সাথে নিজের কাছে রাখতে পারছে না? একা থাকলেই যে মানুষ নিঃস্ব হতাশ হবেন, তা কিন্তু নয়। মানুষকে সমাজে বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত থেকে বাঁচতে হয়। সমাজের মানুষের সঙ্গে চলতে হয়। নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়। এক্ষেত্রে সমাজের ভূমিকাও রয়েছে। তাই বয়স্ক মানুষের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে সময় দিতে হবে। ভালো কাজ সবাই মিলেমিশে করতে হবে। সমাজে অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, হতাশা থেকে আত্মহত্যা কিংবা নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া একেবারেই ঠিক নয়। তবে মাবাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব হতে হবে সবচেয়ে বেশি।

আসলে এই বৃদ্ধাশ্রম কালচারের জন্য আমরাই দায়ী। আমাদের মধ্যে অনেকেই ইতিপূর্বে আমাদের পিতা মাতার সহিতও একই ধরনের আচরণ করেছি। যার প্রতিফল এখন আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে অতি আধুনিক হতে গিয়ে আমরা সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা দিই নাই, এতে বাবা মার প্রতি যথাযথ সম্মান, শ্রদ্ধা, দায়িত্ব ও কদর তারা বুঝতে ও জানতে পারেনি। সন্তানকে বাইরের কারো সাথে মিশতে দিইনি ও আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে রেখেছি। সন্তানের মাথায় একা চলা ও শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবাএটি ঢুকিয়ে দিয়েছি। এতে তারা স্বার্থপর হয়ে বেড়ে উঠেছে। নিজের অবস্থান উঁচুতে আছেএটি দেখাতে ও বুঝাতে সন্তানকে অহেতুক বিদেশে পাঠিয়ে লেখাপড়া করিয়েছি, এর ফলে তারা বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেছে। সন্তানকে বিয়ে করানোর সময় নিজে থেকে বেশি অর্থবান ও উচ্চ সামাজিক অবস্থার পাত্রীকে বিয়ে করিয়েছি। ফলে ছেলের স্ত্রী শ্বশুর শাশুড়িকে ঠিকভাবে সম্মান ও মর্যাদা দান করছে না, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে ও সহ্য করে না। অনেকে ঠিকভাবে শ্বশুর শাশুড়ির সাথে কথাও বলে না, পাত্তাও দেয় না। আবার অনেক শ্বশুর শাশুড়ি ছেলের বৌকেও সহ্য করতে পারে না। ছেলে ও ছেলের বৌয়ের উপর অযথা কর্তৃত্ব খাটাতে চেষ্টা করে। যার ফলশ্রুতিতে বাবা মার স্থান হয় শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাকিল : চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়
পরবর্তী নিবন্ধনগরের শব্দ দূষণ এবং এর প্রভাব