বহমান সময়

এ জার্নি বাই ট্রেন

ফজলুল হক | সোমবার , ২৯ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

একবার দেশের বাহিরে আমি ট্রেনে জার্নি করছিলাম। একটি বড় আকারের কম্পার্টমেন্টে আমার সিট পড়েছিল। সেখানে অনেক যাত্রী ছিলেন। আমার সামনে মুখোমুখি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসে ছিলেন। তার গন্তব্যস্থলও আমার মতো দীর্ঘ যাত্রার ছিল। পরিপাটি জামাকাপড় পড়া,দামি স্যান্ডেল পায়ে। সুন্দর ফ্রেমের চশমার ভেতরে দীপ্ত দুই চোখে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি হেসে খুব মৃদু স্বরে জানালেন যে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। আমার পাশে আরো যাত্রী ছিলো। ট্রেন ছাড়ার পর প্রত্যেকে একে অপরের সাথে পরিচিত হতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সেখানে বিভিন্ন দেশের নারী ও পুরুষ যাত্রীরা একে অপরকে হ্যালো বলছিল। আমার পাশে একজন নারী যাত্রী নিজের পরিচয় জানিয়ে বললেন তিনি একজন চিকিৎসক। একজন লেখিকা ছিলেন,আরেকজন মডেল এবং ফিল্মমেকারও ছিলেন সেখানে। একজন কম বয়সী নার্স এসে আমাদের সকলের সাথে হাত মেলালো। এই সময় লম্বা বেশ সুন্দর চেহারার একজন যুবক এসে আমাকে তার পরিচয় দিয়ে বললেন তিনি সেই দেশের বিভিন্ন সংস্থায় লিডারশিপ ট্রেনিং প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের একজন ট্রেইনার। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়িক সংস্থা তাদের কর্মীদের দক্ষ করার উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ঐ ট্রেনিং সংস্থাকে ডাকে তখন এই ভদ্রলোক তার টিম নিয়ে অনলাইনে অথবা অফ লাইনে সংস্থার কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।

কিছুক্ষণ সময় দ্রুত গতির এই ট্রেন চলার পর যাত্রীরা জানালা দিয়ে পাশের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ট্রেন যাত্রা খুবই ভালো হলেও দীর্ঘ যাত্রায় মানুষ বোর হতে পারে। আমার সামনের যাত্রীর সাথে আমার আরো আলাপ আলোচনা হলো এবং আমি জানতে পারলাম যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক অধ্যাপক এবং এক সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি খুবই নিচু স্বরে খুবই কম কথাবার্তা বলেন। কিন্তু বেশ সপ্রতিভ এবং জ্ঞানী তার কথা থেকে সেটা আমি বুঝতে পারলাম। তিনি বললেন আমাদের এই যাত্রায় অনেক সময় কাটাতে হবে। দীর্ঘ সময় বসে থাকা খুবই বিরক্তিকর এবং হাতেপায়ে খিল ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা হতে পারে। সুতরাং আমাদের নিজেদেরকে যাত্রা পথে কিছুটা ব্যস্ত রাখার একটা উপায় খুঁজে বের করা যেতে পারে। ট্রেইনারযুবকটি এগিয়ে এসে বলল আমি আপনাদের একটি রেসিপি জানাতে পারি। আসুন আমরা একটি কমপিটিশনের ব্যবস্থা করি।

এখানে আমরা যারা যাত্রী আছি তাদের মধ্যে যারা তাদের জীবনের কোনো গল্প বলতে চান পনেরো মিনিট সময় নিয়ে তিনি তার গল্প শোনাতে পারেন। এভাবে অংশ গ্রহণকারীদের গল্প শুনে আমাদের উপাচার্য স্যার সিদ্ধান্ত দেবেন কোন গল্পটি বেস্ট হয়েছে। তাকে একশত ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। ট্রেইনার তার নিজের পকেট থেকে একশত ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। উপাচার্য বললেন ঠিক আছে পুরস্কারের পরিমাণ হবে দুইশত ডলার বাকি একশত ডলার আমি দিব। তখন আমাদের সহযাত্রী ডাক্তার তিনি আরো একশত ডলার দিলেন। এইভাবে পুরষ্কারের অর্থ পাঁচশত ডলার দাঁড়াল। যারা গল্প বলতে চান তাদের নাম একটি নোটবুকে উপাচার্য লিখে নিলেন।এইবার গল্প বলার প্রতিযোগিতা শুরু হল। যিনি প্রথম অংশগ্রহণকারী তিনি বললেন তিনি হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন।একটি বহুতল ভবনের কয়েকটি ফ্লোর জুড়ে এই হোস্টেলে ছাত্ররা থাকত। প্রত্যেক ফ্লোরে চারটি ব্লক এবং এক একটি ব্লকে পনেরো জন ছাত্র থাকতেন। তারা লেখাপড়ার পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন রকমের সাংস্কৃতিক এবং আনন্দদায়ক কর্মকাণ্ড করতেন। কেউ কবিতা পাঠ করত, কেউ ধর্ম চর্চা করত। কেউ গান করত তাদের এইসব কাজকর্মের জন্য একটি কমিউনিটি কক্ষ ছিল।

একজন মুসলিম ছাত্র যার নাম ছিল মানসুর। তিনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ছিলেনএবং সবসময় তারধর্মীয় কাজকর্ম নামাজ, রোজা, কুরআন তেলাওয়াত সুচারুভাবে সম্পন্ন করতেন। আরেক জন প্রাচ্যদেশীয় ছাত্র ছিলো নাম যাই না কেন তাকে সবাই টম নামে ডাকত এবং একটু ভারিক্কীচালের হওয়ার কারণে তাকে আঙ্কেল টম নামে বলা হতো। এই টম খুবই স্বল্পভাষী ছিল। মুখে স্মৃতহাসি থাকত, কথাবার্তা একেবারেই কম বলত যা প্রয়োজন তাঁর বেশি একটি শব্দও তার মুখ থেকে কখনো কেউ শোনেনি। আরেকজন ছাত্র অন্য একটি দেশের তার নামও অনেকের মনে থাকত না। ধর্ম নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির যারা মানুষ আছেন অনেকে তাদেরকে দুইভাগে বিভক্ত করেন। কিছু ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ আছেন যারা নিজের ধর্ম নিজে পালন করত এবং অন্যের ধর্মকে সম্মানের সাথে দেখত। তারা সকল ধর্মের সহঅবস্থানের পক্ষপাতি। তারা বলে ধর্ম যার যার উৎসব সবার।

সকল ধর্মের উৎসবে তারা অংশগ্রহণ করে এবং সকল ধর্ম যাতে পাশাপাশি থেকে স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মবিশ্বাস পালন করতে পারে, আচার অনুষ্ঠান পালন করতে পারে, ধর্ম নিরপেক্ষ লোকেরা সেই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতেন। যারা নিজ ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মকে সহ্য করতে পারে না তাদেরকে ধর্মান্ধ বলা হয়।কিন্তু যারা সকল ধর্মকে সম্মানের সাথে দেখে তাদেরকে ধর্ম নিরপেক্ষ বলা হলেও তাদের চিন্তাধারাকে অনেকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন। আরেক ধরনের ধর্ম নিরপেক্ষ লোক আছেন যারা কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে যে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই বাস্তবতারও কোনো সম্পর্ক নেই, ধর্ম হচ্ছে এক ধরনের নেশা বা আফিনের মতো চিন্তা যা মানুষকে বিভোর করে রাখে। মানুষ তখনই ধার্মিক হয় যখন তারা ভবিষ্যতের বা পরকালের সুন্দর স্বপ্নে বিভোর থাকে। এই সমস্ত ধর্ম নিরপেক্ষ লোকেরা ধর্ম বিশ্বাসে অটল লোকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। আগলি সে ধরনের একজন ধর্মনিরপেক্ষ লোক ছিলেন বলে মনে করা হতো। তিনি কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে কিনা সেটি আসলে কারো জানা ছিল না। মাঝে মাঝে এই হোস্টেলের যারা বসবাসকারী তারা সকল বন্ধুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে আসত এবং সবাই মিলে সেটা খেত। তেমনি এক দুপুরে মানসুর নামের ছাত্রটি বড় থলি বোঝাই করে সকলের জন্য পাইনাপেল, গ্রেইপস, আপেল এবং আরো কিছু ধরনের বাদাম কিসমিস বোঝাই করে নিয়ে আসেএবং কমিউনিটি হলের টেবিলে সেগুলো রেখে অন্যান্যদের খবর পৌছাতে বের হয়। আগলি নামের সেই ছাত্রটি কমিউনিটি হলে প্রবেশ করে এবং দেখতে পায় যে সেখানে বিভিন্ন রকমের ফল ও বাদাম রাখা আছে। কিছুক্ষণ পর সবাই আসবে তারা সেটি উপভোগ করবে এবং খাবে।

আগলি একটু সমাজসেবা মূলক কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে একটি ছুরি পরিষ্কার করে ধুয়ে আনারসগুলো কাটতে শুরু করে। বেশ কয়েকটি কেটে একটি বাটির মধ্যে পিচ পিচ করে রাখে। তার পরে সে আপেল ছিলতে শুরু করে এবং সব ফলগুলো সে পরিপাটি করে খাবারের উপযোগী করার জন্য কাজ করতে থাকে। যখন মানসুর এই ফ্লোরের ছাত্রদের কাছে খবর দিয়ে আসে যে তোমরা কমিউনিটি হলে এসো তোমাদের জন্য ফল এবং বাদাম অপেক্ষা করছে বলে মানছুর যখন তার কক্ষে আসলো তখন আঙ্কেল টম নামের ছেলেটি খুব মধুর একটি হাসি মুখে লাগিয়ে মানসুরের কাছে গেল। এবং অত্যন্ত নিচু স্বরে বলল মানসুর তুমি তো একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। মানছুর বলল হ্যা তুমি তো আল্লাহকে বিশ্বাস কর, আমরাও করি আমাদেরও ইশ্বর আছে। সুতরাং যারা অবিশ্বাসী বা যারা ডিসবিলিবার তারা তোমার আমার সমকক্ষ হতে পারে? মানসুর বলল কখনো না; তারা সবসময় আল্লাহর কাছে অপছন্দের মানুষ। তাদের গুণাহ ক্ষমা না হওয়া পর্যন্ত তারা আমাদের সমকক্ষ হতে পারে না। টম বলল আমিও আমাদের ধর্মে বিশ্বাস করি এবং ঈশ্বরের প্রতি অনুগত থেকে এই পার্থিব জীবনকে সফলভাবে শেষ করে প্যারাডাইসের অপেক্ষা করতে থাকি। মানুসুর বলল সেই দিক থেকে তোমার সাথে আমার তেমন কোনো বিরোধ থাকতে পারে না।

আমি মনে করি এই পৃথিবী একটি সামান্য সময়ের জন্য আমাদের আবাসস্থল। এখানে আমরা একজন মুশাফিরের মতো কিছুদিন অবস্থান করি। আমরা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি তাহলে আমাদের পরবর্তী জীবন হবে আনন্দের। মানুষের জন্য অফুরন্ত আনন্দ অপেক্ষা করছে। যাকে আমরা বেহেশত বলি। টম বলল মানসুর তুমি কমিউনিটি হলের দিকে তাকাও। দেখ টেবিলের উপরে টুকরা টুকরা করে পাইনাপল কাটা হচ্ছে। আপেল ছিলে রাখা হচ্ছে। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ।মানসুর বলল দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তোমার আনা এই ফল বাদাম যিনি স্পর্শ করে খাবার উপযোগী করছে তিনি একজন সেকুলার মানুষ আমাদের দৃষ্টিতে ডিসবিলিবার। তার হাতে স্পর্শ করা এই খবার আমাদের কাছে আমাদের মতো ধর্মবিশ্বাসী মানুষের কাছে কি গ্রহণযোগ্য হতে পারে? মানসুর বলল না হতে পারে না। মানসুরের চোখ আস্তে আস্তে চক চক করতে শুরু করল। তার হাত পা নিশ পিশ করছে সে তার বিছানার নিচের থেকে একটি লাঠি বের করল এবং ড্রয়ের থেকে একটি ছুরি বের করল। সেই কমিউনিটি হলে প্রবেশ করল। তার উগ্রমূর্তি দেখে আগলি নামের ওই ছেলেটি দৌড়ে পালিয়ে গেল। মানসুর সেই বাদাম এবং ফল উপর থেকে নিচে ফেলে দিল। নিচে হইচই শোনা গেল কি হচ্ছে?

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএম এ মামুন : শিক্ষকতার কিংবদন্তী, সীতাকুণ্ড আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা
পরবর্তী নিবন্ধহাইদগাঁও ইউপি চেয়ারম্যানের মাতার ইন্তেকাল