দূরের দুরবিনে

একজন বিশ্বনন্দিত শিল্পীর প্রতিচ্ছবি

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ২৮ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

সিডনি ঘুরে গেলেন তবলা সম্রাট জাকির হুসাইন। তিনি মাঝে মাঝেই আসেন এ দেশে। এবং যখন আসেন তখন ই উপচে পড়া দর্শক শ্রোতা ভিড় জমান। কেন জমান? কেন এই আগ্রহ? তবলা তো খুব সহজ সাধারণ একটি বাদ্য যন্ত্র। বাঙালি সমাজে অতি পরিচিত এই তবলা। এমন কোন বাঙালি পাওয়া যাবে না যিনি তবলার সাথে পরিচিত নন।

তবলা কেমন বাদ্যযন্ত্র? খুব সহজে বসানো যায় খুব সহজে বহন করা যায় এবং ছোট্ট জায়গা নিয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা এক বাদ্যযন্ত্র। তবলার ডান হাতে বাজাবার অংশটির নাম ডাহিনা (ডাইনা, ডাঁয়া) বা তবলা এবং বাঁ হাতে বাজাবার অংশটির নাম বাঁয়া বা ডুগি। তবলার বিশেষত্ব এর জটিল অঙ্গুলিক্ষেপনজাত উন্নত বোল আর তবলা বাদক শিল্পীকে বলা হয় তবলিয়া। তবলচি শব্দটি আগে একই অর্থে প্রচলিত ছিল, কিন্তু বাইজীগান বা খেমটানাচের সঙ্গতকারীদের জন্য বেশি ব্যবহৃত হওয়ায় অনেকে একে অশ্রদ্ধাজনক বলে মনে করেন, তাই তবলচির বদলে তবলিয়া শব্দটির চল হয়।

তবলা নামটি এলো কোথা থেকে? জনশ্রুতিতে, তবলার জন্ম সম্বন্ধে নানা মতবাদ আছে। একটি হল আমীর খসরু সম্বন্ধে।। মৃদঙ্গ জাতীয় কোন দুইদিক চামড়ায় ছাওয়া যন্ত্র ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়, কিন্ত তার পরেও তা থেকে সুন্দর অওয়াজ বের হয়। শুনে মুগ্ধ খসরু বলেছিলেন তব ভি বোলা। তখন থেকে সম্ভবত: তবলা শব্দটি তব ভি বোলাথেকে এসে থাকতে পারে।

যেখান থেকেই আসুক না কেন তবলা আমাদের অতি পরিচিত। এখন দেশে গান বাজনার কঠিন সময় চলছে। বিশেষতঃ গত এক দশকে বাংলাদেশে গান বাজনা বিষয়ে নানা ধরনের প্রতিকুলতা কাজ করছে। মাঝে মাঝে আমতা তার হদিস পাই। মহান লালন ফকির এবং তাঁর গান এতোবছর ধরে সগৌরবে চলে আসছিল। হঠাৎ না কি সে বাণী স্পর্শকাতর বলে মনে হচ্ছে কারো কারো। বাংলা গানের দেশ। বাঙালি গান পাগল জাতি। জন্ম থেকে মৃত্যু, বিবাহ থেকে নামকরণ সব অনুষ্ঠানে গান চাই আমাদের। আমাদের দেশ ও সংস্কৃতি গান নির্ভর। দুনিয়ার আর কোন দেশের মানুষ জাতীয় সঙ্গীত গাইবার কালে এমন কেঁদে আকুল হয়? গান যে আমাদের নদীর স্রোত থেকে পাখির কন্ঠে । রবীন্দ্রনাথ কী দারুণ করে বলেছেন:

পাখিরে দিয়েছ গান, গায় সেই গান,

তার বেশি করে না সে দান।

আমারে দিয়েছ স্বর, আমি তার বেশি করি দান,

আমি গাই গান।

মানুষ গান গায়। আর গানের সাথে অমোঘ নিয়মে থাকে তবলা। বাঙালির গানে তবলা অতি পরিচিত আর অনিবার্য । যতকাল না পাশ্চাত্যের গান বাজনা এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল আমরা হারমোনিয়াম তবলাতেই মজে ছিলাম। আজকাল তবলার প্রচলন কিছুটা কমে এসেছে। কান নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ইলেকট্রনিক তবলা মানে শব্দ দূষণ। তারপর ও তার বাজার বাড়ছে । কিন্তু যিনি মূল শিল্পী তাঁর কাছে পরম আদরের সেই ছোট ভাই আর বড় ভাই দুই তবলা। ডানা আর বাঁয়া । ভারতীয় উপমহাদেশে তবলার এক নতুন ঘরানা তৈরি করে দিয়ে গেছেন জাকির হুসাইনের বিখ্যাত পিতা আল্লা রাখা। ভারতীয় সংগীতের বিস্ময়পুরুষ ওস্তাদ আল্লা রাখা। অনেক ওস্তাদের মতো তিনি পারিবারিক সিলসিলায় বেড়ে ওঠেননি, সিলসিলা তৈরি করেছেন। জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৫ সালে পাঞ্জাবের গুরুদাসপুরের রতনগড় গ্রামে কৃষক পরিবারে। সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করার পরও হয়ে উঠেছেন সংগীতের ওস্তাদ।

উইকিপিডিয়া লিখছে:

তিনি যে অত্যুচ্চ আসন তৈরি করেছিলেন, তা এগিয়ে নিয়েছেন প্রধান শিষ্য ও সন্তান ওস্তাদ জাকির হোসেন। ওস্তাদ জাকির হুসেন মাত্র ১২ বছর বয়সেই পিতার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পণ্ডিত রবি সংকরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে যান। জীবনে অজস্র আসরে নেতৃত্ব দেন। গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, সংগীত নাটক একাডেমি ও কালিদাস সম্মাননা পান। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে পূর্ণকালীন অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৯ সালে তিনি বার্কলে কলেজ অব মিউজিক ও ইন্দিরা কলা সংগীত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাণিজ্যিক জলসায় পরিবেশন করেন না। ২০২৩ সালে তিনি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পদ্মবিভূষণ খেতাব পান। তার তবলা বাদন বর্তমানেও মুগ্ধ করে রেখেছে কোটি মানুষকে। ‘অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ’ কিংবা ‘লিটল বোদ্ধা’র মতো বিখ্যাত চলচ্চিত্রে রয়েছে তার তবলার সরব স্বাক্ষর। ধ্রুপদি সংগীতের প্রসঙ্গ এলেই উঠে আসে জাকির হুসেনের নাম।

এই তথ্যগুলো জানার পর বা পড়ার পর আমার মনে হয়েছে জাকির হুসাইন কেন এতো মনোরম? তার আগে বলি, বিগত এক রোববারে আমি জাকির হুসাইনকে দেখতে গিয়েছিলাম। জাকির হুসাইনের তবলা বাদনের টিকেট পাওয়া সহজ কিছু না। আগে দু একবার ব্যর্থ হবার পর এবার ভাগ্যক্রমে টিকেট মিলে গেছিল। শীতের হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডা আর কনকনে বাতাস। জাকির হুসাইন বা তাঁর মতো নামী সর্বত্রগামী সেলিব্রেটিদের অনুষ্ঠান হয় সিডনি অপেরা হাউসে। এই অপেরা হাউসটি বাইরে পদ্মপাতার মতো দেখতে। মনে হয় ছোট একটি স্থাপনা। যখন আপনি ভেতরে ঢুকবেন তখন থেকেই টের পাবেন এর কতগুলো হল আর কি কি সুযোগ সুবিধা আছে এতে। কম করে হলেও একডজন খাবারের দামী রেস্তোরাঁ পানশালা থেকে আরো অনেক কিছু ভর্তি এই অপেরা হাউসের মূল মঞ্চে অনুষ্ঠান ব্যয়বহুল। দু হাজারের বেশী আসনের হলটি ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। ঠিক ছয়টা দশ মিনিটে জাকির হুসাইন এলেন। সাথে দুই দক্ষিণ ভারতীয় মন্ত্রী। দুই নারীর একজন বাজালেন ভায়োলিন অন্যজন বীণা। বেহালা ও বীণা বাজিয়ে কালা রামনাথ ও জয়ন্তী কুমারেশ, এই দুই ঝানু সাউথ ইন্ডিয়ান রমণীর বাদ্যযন্ত্রকে শাসন করে গেল জাকির হুসাইনের তবলা। তবলায় এতো কিছু হয়, হতে পারে তাঁকে না দেখলে বোঝা অসম্ভব। তিনি তবলা বাজান বলে মনে হলো না, মনে হলো তবলা তাঁর শিশু। তার চাটিতে তাঁর যত্নে তাঁর শাসনে সে কথা বলে।

সবচাইতে চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো নিজ দেশ সংস্কৃতি আর আচারের প্রতি শিল্পীর শ্রদ্ধাবোধ। অবলীলায় দু হাত জোড় করে অনুষ্ঠানে প্রবেশ করা জাকির হুসাইন তবলা বাজালেন একনাগাড়ে দু ঘন্টা। একজন ৭৩ বছরের মানুষ কোন বিরতি ছাড়া এমন দু ঘন্টার তবলা বাদন করতে পারেন এটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। জাকির হুসাইন মনে প্রাণে একজন ভারতীয়। এটা তাঁর আচরণ ও কথাতেই স্পষ্ট। যে কোন মানুষ যদি তাঁর দেশ জাতি ও সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বাসী ও শ্রদ্ধাশীল না হন তো তাঁর শিল্প ও খোলতাই হয় না। অনুষ্ঠান শেষে মাথা ঝুঁকিয়ে দর্শক শ্রোতাদের প্রণাম করার ভেতরেও ছিল অপার আন্তরিকতা।

মনে হচ্ছিল পুণ্য অর্জন করেছি। একজন মানুষ সাদামাটা তবলার মতো বাদ্যযন্ত্রে বিশ্ব মোহিত করে আমাদের উপমহাদেশের জন্য গৌরব বয়ে আনেন তাঁকে দেখলে তাঁর বাজনা শুনলে মন পুলকিত ও পবিত্র হবে এটাই তো স্বাভাবিক। জাকির হুসাইন শুধু একজন তবলা বাজিয়ে নন তিনি নিজেই এক ইতিহাস। সিডনি তাঁকে পেয়ে ধন্য হয় বারবার।

লেখক : কবি, প্রাবিন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধতিনটি হাইস্পিড ট্রেনের সূচি বাতিল