একসময়ে কিন্ডার গার্টেন বা প্রাইমারি স্কুলের ছেলে মেয়েদের মা–বাবা স্কুলে পৌঁছে দিতো। ছুটির পর আবার নিয়ে যেতো। গ্রামের ছেলে মেয়েরা শিশুকাল থেকে নিজেরা স্কুলে যাওয়া আসা করতো। তাদের সাথে কাউকে যেতে হতো না। কিন্তু শহরে নার্সারী থেকে পথম শ্রেণির শিশুরা কারো না কারো সাথে স্কুলে যাওয়া আসা করতো। সবাই মনে করতো এতো ছোট ছেলে মেয়ে কিভাবে একা স্কুলে যাবে। অথচ এরা ক্লাস সিক্সে ভর্ত্তি হলে নিজে নিজে স্কুলে চলে যেতে পারতো। আবার ছুটির পর ফিরে আসতো। এতে মা–বাবার আশংকা থেকে যেতো। পথে কোথায় কি হয়ে যায়। কেউ কেউ সিক্সের ছেলে মেয়েদের স্কুলে আনা নেয়া করতো। আবার দেখা গেলো ক্লাস সেভেনের কিছু কিছু ছেলে মেয়ে মা–বাবর সাথে স্কুলে আসা যাওয়া করে। পরের বছর এসব ছেলে মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উঠলেও বাবা–মা একা ছাড়ে না। এভাবে অন্য গার্ডিয়ানেরাও ছেলে মেয়েদের একা ছাড়তে চায় না। প্রায় ছেলে মেয়ের সাথে কেউ না কেউ স্কুলে আসা যাওয়া করতে থাকে। আগে কখনো হাই স্কুলের ছেলে মেয়েদের গার্ডিয়ানদের আনা নেয়া করতে হয়নি।
প্রাইমারি থেকে হাইস্কুল পর্যন্ত পড়া ছেলে মেয়েদের স্কুলে আনা নেয়া করার নিয়ম হয়ে গিয়েছে। ক্লাস নাইন টেনেরও খুব কম ছেলে মেয়ে আছে যারা নিজে নিজে স্কুলে যাওয়া আসা করে। গার্ডিয়ানেরা সন্তানদের একা ছাড়াটা কোনভাবে নিরাপদ মনে করে না। প্রতিদিন কত খবর আসে। কত অঘটনের খবর। তাদের এ দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তারা আশংকা মুক্ত হতে পারে না। ছেলে মেয়েরা এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হলেও আর একা ছাড়তে পারে না। এসএসসি একটা বড় পাবলিক পরীক্ষা। এ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ছাত্র–ছাত্রীর ভেতর অনেক পরিবর্তন আসে। কলেজে ভর্তি হলে ছেলে–মেয়েরা নিজেদের কিছুটা বড় ভাবে। কিন্তু মা–বাবার কাছে এরা অনেক ছোট থেকে যায়। কলেজেও এদের একা ছাড়তে চায় না। অনেক গার্ডিয়ান সাথে সাথে যাওয়া আসা করে। এমনকি কোচিং সেন্টারেও অনেক মা গিয়ে বসে থাকে। তাদের ধারণা ছেলে মেয়েকে একা ছাড়লে যে কোন বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। কোন না কোন সমস্যায় জড়িয়ে যেতে পারে।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ছেলে মেয়েরা অনেক স্বাধীনতা পায়। চলাফেরায় কথাবার্তায় অনেকের এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মা–বাবা আগের মতো সবসময় খবরদারিতে থাকে না। আবার ছেড়েও দেয় না। কোথায় যায়, কি করে, কার সাথে মিশে এসবের খবর রাখে। আসলে খবর রাখতে হয়। ছেলে মেয়েরা এখনো অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কোন ব্যাপারে যদি ভুল সিদ্বান্ত নিয়ে ফেলে। একবার ভুলের ভেতর ঢুকে গেলে সহজে বের হয়ে আসতে পারে না। বের হয়ে আসতে অনেক সময় চলে যায়। ইন্টারমিডিয়েটের সময়টা ছাত্র–ছাত্রীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসময়টাতে ঠিকমতো লেখাপড়া না করলে পিঁছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছা যায় না। কোন কারণে একবার ধাক্কা খেলে আর সহজে উঠা যায় না। প্রতিযোগিতায় নিজেকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য বাবা–মা এসময়টাতে ছেলে মেয়েকে ছেড়ে দিতে চায় না। দশ বছর ধরে যে ছেলে বা মেয়েকে স্কুলে নিয়ে গেলো তাকে আরো দুই বছর কলেজে নিয়ে যায়।
এভাবে অনেক ছেলে মেয়েরা স্কুল কলেজে মা–বাবার সাথে আসা যাওয়া করে। আবার কোচিং সেন্টারে মাকে ছাড়া যায় না। তারা পরীক্ষায় অনেক ভালো ফলাফল করে। এইচএসসি পাশ করে ভালো কোন জায়গায় ভর্তিও পেয়ে যায়। এমনকি কাঙ্ক্ষিত মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংএ ভর্তি হতে পারে। মা–বাবারাও মনে করে তাদের দীর্ঘ দিনের কষ্ট স্বার্থক হয়েছে। ছেলে মেয়েরা নিজেদের স্বপ্ন পূরণের সাথে মা–বাবারও স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে। তারপরও মা–বাবার মনে স্বস্তি থাকে না। ছেলে মেয়েকে আগে কখনো একা ছাড়েনি। ভর্তি পরীক্ষার সময় মা বা বাবা সাথে গিয়ে বসে থাকে। পরীক্ষা শেষে সাথে করে নিয়ে আসে। এদের এখনো ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতে হয়। কলেজে ক্লাস করতে যেতে দেরি করে ফেলে, কোচিং সেন্টারেও। এমনকি পরীক্ষার সময়ও বার বার তাগাদা দিয়ে বের করতে হয়। সময়মত বের হতে চায় না। পথে বেশি সময় লাগতে পারে, যানজটে পড়তে পারে এসবের হিসাব করতে চায় না। নিজে নিজে এখনো কিছু করতে পারে না। অন্যের সাথে সহজে মিশতে পারে না। নতুন জায়গায় গিয়ে কি করে নিজেকে খাপ খাওয়াবে এসব নিয়ে অভিভাবকের চিন্তার শেষ নেই।
এসব ছেলে মেয়েরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও আর স্বাবলম্বী হতে পারে না। মা–বাবার ওপর অনেংকাংশে নির্ভরশীল থেকে যায়। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে মাকে সবকিছু ঠিক করে দিতে হয়। খাওয়া দাওয়া ঘুম এসব নিয়ে মাকে মাথা ঘামাতে হয়। লেখাপড়ার তাগাদা দিতে হয়। এরা নিজদের মধ্য থাকতে চায়। সহপাঠির সাথেও খুব একটা মিশে না। বন্ধু–বান্ধব বলে তেমন কেউ থাকে না। দু’একজনের সাথে পড়ালেখা নিয়ে মাঝে মধ্যে কথাবার্তা বলে। এদের মাঝে অনেকে আছে যারা কলেজে পড়ার সময় তেমন একটা ক্লাস করেনি। কোচিং সেন্টারের প্রতি বেশি মনযোগি থেকেছে। বাসায়ও লেখাপড়া করেছে। ফলাফলও ভালো করেছে। কিন্তু তাদের ফ্রেন্ড সার্কেল গড়ে উঠেনি। সহপাঠিদের নিয়ে যে আনন্দে মেতে থাকা, হৈহুল্লোড় করা এমন কিছুর ভেতর দিয়ে যায়নি। ফলে তাদের জগৎটা একেবারে সীমিত হয়ে গিয়েছে। বাবা–মা ভাই বোন আর লেখাপড়া ছাড়া অন্যকিছুর সাথে তেমন পরিচয় ঘটেনি। স্কুল কলেজে পড়ার সময় সবার সাথে মেশার যে সুযোগ থাকে, সেই সুযোগটা তাদের কাছে আসেনি। তাদের মানসিক বিকাশটাও আর সেভাবে হয়নি।
স্কুল ও কলেজে ক্লাসের গুরুত্ব অনেক। ক্লাসে শিক্ষকদের উপস্থিত থাকতে হয়। ছাত্র–ছাত্রীদেরও ক্লাস করতে হয়। শ্রেণিকক্ষে ছাত্র–ছাত্রীদের মনোযোগ নিয়ে অনেক কথা আছে। কোচিংএ ক্লাসে তারা যতটুকু মনোযোগী থাকে শ্রেণিকক্ষে সেরকম থাকে না। কিন্তু পরীক্ষায় খারাপ করলে অভিভাবককে স্কুলে ডাকা হয়। তারা কেন মনোযোগী থাকে না তা শিক্ষকেরা কখনো ভেবে দেখে না। শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার দায়িত্ব স্কুল নেয় না। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার দায়িত্ব মা–বাবার। বাসায় ঠিকমতো না পড়লে পরীক্ষা খারাপ হয়। অথচ ক্লাসে যে ঠিকমতো লেখাপড়া হয় না সেদিকে যেতে চায় না। শিক্ষকেরা প্রায় সময় বলে থাকে ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠালে হবে না। তাদের বাসায় ভাল করে পড়াতে হবে। আবার স্কুলগুলো যখন এসএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে এর পুরা কৃতিত্ব নিতে চায় স্কুল শিক্ষকেরা। ছাত্র–ছাত্রীর ভালো ফলাফলের উপর স্কুলের অনেক কিছু নির্ভর করে। স্কুল কি সামনের দিকে এগিয়ে গেলো, না গতবারের চেয়ে পিঁছিয়ে গেলো পড়লো তা দেখা হয়। সরকারি স্কুলগুলোর ভাল ফলাফলের কৃতিত্ব শিক্ষার্থীর আর তাদের মা–বাবার। স্কুলের ভূমিকা অনেকটা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
অভিভাবকেরা ছেলে মেয়েদের একা না ছাড়ার পেছনে কারণ অনেক। সবচেয়ে বড় কারণ নিরাপত্তাহীনতা। রাস্তা ঘাট উন্নত হলেও আসা যাওয়া নির্বিঘ্ন হয়নি। পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। কখনো কখনো ঝামেলায় পড়তে হয়। মেয়ে হলেতো কথাই নেই। নানা রকম উৎপাত লেগে থাকে। ছেলেরাও বখাটের খপ্পরে পড়ে যেতে পারে। স্কুলের সময় কিছু কিছু ছেলে মেয়েকে পার্কে বা বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায। স্কুল ফাঁকি দেয়ার প্রবণতাও কারো কারো আছে। এজন্য বাবা–মা ছেলে মেয়ে একটা নির্দিষ্ট স্তরে না পৌঁছা পর্যন্ত লেগে থাকে। এদের পেছনে সবচেয়ে বেশি সময় দেয়। এভাবে লেগে থাকায় ছেলে মেয়েরা আর নিজে থেকে কিছু করতে পারে না। এমনকি তাদের ভাবনার জগৎটাও একবারে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। লেখাপড়া খাওয়া দাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। কেউ কেউ আবার মোবাইলে সময় কাটায়। এসব ছেলে মেয়ে শুধু বন্ধু–বান্ধব বা সহপাঠির সাথে নয় আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী কারো সাথে সহজে মিশতে পারে না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শেখানো মুখ্য হলেও ছেলে মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ স্কুল কলেজে হয়ে থাকে। খেলাধুলা ছাড়া শারীরিক গঠন পরিপূর্ণ হয় না। কিশোর বয়সে খেলাধুলার কোন বিকল্প নেই। খেলাধুলা শুধু শারীরিক গঠন নয় মানসিক বিকাশেও সহায়তা করে। আবার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছেলে মেয়েদের মন মানসিকতাকে সুস্থ ধারায় প্রবাহিত করে। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এখন অল্প কিছু সংখ্যক ছাত্র–ছাত্রী এসবের সাথে যুক্ত হলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অনেক দূরে থাকে। অভিভাবকেরাও এসব বিষয়কে মোটেই গুরুত্ব দিতে চায় না। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা একমাত্র লক্ষ্য।
শিক্ষাক্রমে মানবিক শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার ঘাটতি রয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রে মানবিকতা ও নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটেছে। এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নেই বললে চলে। শিক্ষকেরাও এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। ফলে ছাত্র শিক্ষকের যে সম্পর্ক আগে দেখা যেতো তা এখন আর নেই। ছেলেমেয়েরা আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠে। দেশে ও সমাজের কোন কিছু ভাবতে পারে না। নিজেদের মতো করে চলে, সবকিছু নিজেদের মতো করে ভাবে। লেখাপড়া শিখেও সুনাগরিক হিসাবে গড়ে উঠে না। অন্য দশ জনের সাথে মিলেমিশে চলার মানসিকতা আর তৈরি হয় না। নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে পারে না। কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন সর্বত্র এর প্রভাব থেকে যায়। এজন্য ছেলে মেয়েদের ছোটবেলা থেকে স্বাবলম্বী হয়ে গড়ে তোলার ব্যাপারে বাবা মা শিক্ষক সবার সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী