সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল মিলনায়তনে আয়োজিত এক সেমিনারে বলা হয়েছে, দেশে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে ১১৪ জন ক্যানসারে আক্রান্ত। এর মধ্যে পুরুষ প্রতি লাখে ১২০ এবং নারী ১০৮ জন। এ অবস্থায় দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ক্যানসার রোগীদের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত জরুরি। ক্যানসারের ঝুঁকির কারণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচির ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। সেমিনারে জানানো হয়, বর্তমান বিশ্বে মৃত্যুর একটি কারণ হচ্ছে ক্যানসার। ক্যনসার গবেষণায় আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাক্যানের রিপোর্টে ২০২২ সালে বাংলাদেশে ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৫৬। ওই সময় মারা যান ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জন। তবে জনসংখ্যাভিত্তিক নিবন্ধনের অভাবে বাংলাদেশে ক্যানসারের সঠিক পরিস্থিতি জানার ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
দেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর প্রকৃত সংখ্যা কত, তা জানা না গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা তথ্য অনেকের জানা আছে। ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে দ্য গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরি ক্যানসার বিষয়ে এই তথ্যটি প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, দেশে প্রতিবছর দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। আর ক্যানসারে প্রতিবছর মারা যায় ১ লাখ ৮ হাজারের বেশি মানুষ। নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় জনস্বাস্থ্যবিদরা এই তথ্যই ব্যবহার করছেন।
এবার এই তথ্যের সঙ্গে যুক্ত হলো সেমিনারের অভিমত। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ‘দেশের ক্যানসার রোগীর তুলনায় চিকিৎসার আয়োজন অনেক সীমিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার কেন্দ্র বা হাসপাতাল থাকা প্রয়োজন। এসব কেন্দ্রে ক্যানসার শনাক্তসহ ক্যানসার চিকিৎসার তিন ধরনের (কেমোথেরাপি, সার্জারি ও বিকিরণ চিকিৎসা) পদ্ধতি থাকতে হবে। দেশে মানুষ ১৭ কোটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী ১৭০টি ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি সূত্র বলছে, দেশে ক্যানসার কেন্দ্র আছে ৩৩টি। এর মধ্যে বিকিরণ যন্ত্র আছে ১৯টিতে। ক্যানসার চিকিৎসকদের একটি সংগঠন জানিয়েছে, ক্যানসারের চিকিৎসায় দেশে কমপক্ষে ২২০টি বিকিরণ যন্ত্র দরকার। সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে আছে ৫৭টি যন্ত্র। এর মধ্যে চালু আছে ৪৩টি। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখন বেশি মানুষকে বিকিরণ চিকিৎসা দিচ্ছে।’
বলা হয়ে থাকে, বর্তমানে ৪০ শতাংশ ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়। ক্যানসার চিকিৎসা একটি সমন্বিত চিকিৎসাপদ্ধতি। এটি জটিল, দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। কেবল কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি বা অস্ত্রোপচার নয়, বরং সব কটি চিকিৎসা সমন্বিতভাবে প্রয়োগ করতে হয়। এর বাইরে অন্যান্য সাধারণ চিকিৎসাও প্রয়োজন হয়। তাই সমন্বিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা পরিচালিত একটি টিম গঠন করে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হলে ক্যানসার চিকিৎসার সুফল পাওয়া সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের প্রয়োজনীয় ওষুধের ৯০ শতাংশের বেশি ওষুধ দেশীয় কোম্পানি থেকে পাচ্ছি। ফলে ক্যানসার চিকিৎসার খরচ কমে এসেছে অনেক গুণ। ক্যানসার কেমোথেরাপি বা ইমিউনো থেরাপির জন্য প্রয়োজনীয় ল্যাব আমাদের নেই। ওষুধের যথাযথ প্রয়োগের জন্য ল্যাব সুবিধা প্রয়োজন। মলিকুলার টেস্টগুলো না জানলে যথাযথ ওষুধ দেওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চিকিৎসাপদ্ধতি। বর্তমানে রোগীদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের রেডিওথেরাপি প্রয়োজন হয়। ক্যানসার নিরাময়, সহায়ক চিকিৎসা, প্যালিয়েটিভের জন্য রেডিওথেরাপি প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় মিলে এ সুবিধা আছে যৎসামান্যই। বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়া খুবই জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নত বিশ্বে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সেসব দেশে অধিকাংশ রোগীর ক্যানসার পূর্ব অবস্থায় বা প্রথম স্টেজেই রোগ নির্ণয় হয়। ফলে উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময় হয়; নিরাময়ের হার অনেক বেশি। অন্যদিকে আমাদের কাছে রোগীদের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ আসেন তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে।
এখনো ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও ওষুধের দাম পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় বেশি। রোগীরা উন্নত পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় করতে গিয়ে সিংহভাগ টাকা ব্যয় করে ফেলেন। পরে দেখা যায়, চিকিৎসার জন্য ব্যয় করার টাকা অবশিষ্ট থাকে না। কর মওকুফ করে দেওয়ায় ভারতে ওষুধের দাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে গেছে। আমাদের চিকিৎসা ব্যয় বেশি। ব্যয়বহুল এ রোগের চিকিৎসায় সরকারি পর্যায়ে আরো জোরালো পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।