কল্পনা করা যায়, আজ থেকে প্রায় দেড়শত বছর আগেই একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন বেগম রোকেয়া। সম্প্রতি প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, আমাদের নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার গ্রন্থ ‘সুলতানার স্বপ্ন’
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘বিশ্বস্মৃতি বা ওয়ার্ল্ড মেমোরি’র তালিকায় স্থান পেয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলান বাটোরে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড কমিটি ফর এশিয়া এন্ড প্যাসিফিক (মৌক্যাপ) এর দশম সভায় এই ঘোষণাটি দেয়া হয়। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত এক আনন্দের সংবাদ, সেই সাথে বিশ্ববাসীর জন্যও বটে। সম্প্রতি দেশের একটি জনপ্রিয় দৈনিকে উন্নয়ন কর্মী লায়লা খন্দকারের একটি প্রবন্ধ পড়ে আমি অভিভূত হই। প্রবন্ধটিতে তিনি তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেন। তিনি পেশাগত কাজে লন্ডনে ছিলেন ২০১৯ সালে। তো তিনি সেখানে নারী দিবসের একটি অনুষ্ঠানে অংশগহণ করেছিলেন। অনুষ্ঠানে তাঁর সহকর্মীরা শিল্পী কাহলো ফ্রিদা থেকে শুরু করে কিশোরী জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ অনেককে নিয়েই বক্তব্য রেখেছিলেন। লায়লা খন্দকার সেদিন বেগম রোকেয়ার সাহিত্য, জীবন ও কর্ম নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, নারী জাগরণের এই অগ্রদূতের নাম তাঁরা এর আগে আর কোনদিন শোনেননি। ফলে, তাঁর সম্পর্কে সেদিন তারা আরো জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন এবং শুনে তাঁরা রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
আনুমানিক এক শতক বছর আগে বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের যে চিত্র অংকন করেছেন সেটি আমাদের মতো তাদের কাছেও বিস্ময়কর ঠেকে। সেই সময়ে কিভাবে একজন মুসলমান নারী লেখক বেগম রোকেয়া একটি নারী রাজ্য কল্পনা করেছিলেন, যে রাজ্য পরিচালিত কেবল নারী শক্তি দ্বারা। পুরুষ এই রাজ্যে কেবল নারীদের আজ্ঞাবহ মানব। তিনি এখানে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক এক শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। এছাড়াও তিনি কৃষি কাজ করতে ও উন্নত পরিবেশ ব্যবস্থাপনার কথা বলেছিলেন। তিনি তাঁর কল্পিত নারী রাজ্যে দ্রুত চলাচলের সুবিধার্থে উড়ন্ত শকটের কথাও বলেছিলেন। অথচ সেই সময়ে কিন্তু হাওয়াই জাহাজ চলাচলেরও সূচনা হয়নি। এই বৈজ্ঞানিক চিত্রকল্প সে সময়ে রীতিমতো এক অপার বিস্ময়ের মতো ঘটনা। মূলতঃ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের পক্ষ থেকে বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানাস ড্রিম’ এর জন্য মৌক্যাপের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। সে আবেদনের প্রেক্ষিতে উলান বাটোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানাস ড্রিম’ পায় এই বিরল মর্যাদা ও সম্মান।
শত বছর আগে বেগম রোকেয়ার লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গ্রন্থটি ছিল মূলতঃ এক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। তিনি এই গ্রন্থে এমন এক নারী রাজ্য কল্পনা করেছিলেন, যেখানে নারীরাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। নারীর কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নয়, নারীদের জন্য উন্নত বিজ্ঞানসম্মত এবং আধুনিক এক সমাজব্যবস্থার চিত্র এই গ্রন্থেও পরতে পরতে বিধৃত ছিল। তাহলে প্রশ্ন জাগে, তাঁর সমকালীন সমাজে তিনি কি পরিমাণ বঞ্চনা, –গঞ্জনা আর অসম্মান তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা থেকে। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কঠোর পর্দা প্রথার দোহাই দিয়ে কি নির্যাতনই না চলতো তাঁর সমকালীন সমাজে নারীদের ওপর। তবে তিনি যে সমাজব্যবস্থা এবং যে নারীর ক্ষমতায়ন এর স্বপ্ন দেখেছিলেন, শত বছর পরেও কি আমরা পাচ্ছি সেই অধিকার আর মর্যাদা? আশার বিষয় হলো, শত বছর আগে লেখা বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন ’ সম্পর্কে এতদিন পরে হলেও বিশ্ববাসী জানতে পারছে। এজন্য মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর এবং মৌক্যাপকে জানাই অভিবাদন এবং সাধুবাদ। বিশ্বদরবারে ‘সুলতানাস ড্রিম’ সমাদৃত হোক এই প্রত্যাশা রইলো।