দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন, ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক সাফল্যে বাংলাদেশ সরকারের অভূতপূর্ব অর্জন ইতিমধ্যেই সর্বত্রই সমাদৃত। ভূ–রাজনীতির আঞ্চলিক পর্যায়ে দেশের জন্য চীন ও ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত ও চীন সরকারের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ঐতিহাসিক–রাজনৈতিক–সংস্কৃতি–ধর্মীয় কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অধিক শক্তিশালী হলেও ভারত–চীন উভয় দেশের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে অর্থনৈতিক–বাণিজ্যিক–সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে একযোগে কাজ করার ক্ষেত্রে চীনের দৃঢ় আগ্রহ–অনুপ্রেরণা অতিশয় দৃশ্যমান। বাংলাদেশ সরকারও চীনকে দেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, র্কণফুলী টানেল–পদ্মাসেতু নির্মাণ, ঢাকা–আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিদ্যুৎ–জ্বালানি খাত ও কোভিডকালীন সিনোফার্ম ভ্যাক্সিন সহায়তাসহ চীন সর্বদাই বাংলাদেশের পাশে থেকেছে।
২০১৬ সালে দুই দেশের মধ্যে হওয়া সমঝোতা স্মারকের আওতায় বিনিয়োগের প্রস্তাবনা ছিল ২৬ বিলিয়ন ডলার। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। আরও সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। ২০২৬ সালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোয় বিনিয়োগ আসতে পারে আরও সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার। কর্ণফুলী টানেল সংলগ্ন চীনা অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চলে আগামী দিনে বৃহৎ আকারের চীনা বিনিয়োগের আশা প্রকাশ করা হচ্ছে। ১২ মে ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে চীন বাংলাদেশকে যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তার ৯৫ শতাংশই এসেছে গত ১২ বছরে। ৮৫ শতাংশই এসেছে গত ৬ বছরে। ২০১৯–২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২–২৩ অর্থবছরে দ্বিগুণ হয়েছে দেশটির ঋণ ছাড়। উক্ত হিসাব মতে ২০১৩ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চালুর পর থেকেই চীন বড় আকারের ঋণ দেওয়া শুরু করে। চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশে চীনের ভাবমূর্তির ওপর চীন অ্যাম্বাসি কর্তৃক পরিচালিত গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ চীন সম্পর্কে ইতিবাচক। ৯০ শতাংশ বাংলাদেশী চীন–বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে সন্তুষ্ট।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল । বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭২ সালে প্রথম স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ–ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ–ভারতের সম্পর্ক সুদৃঢ় এবং সহযোগিতার নবদিগন্ত উম্মোচিত হয়। উক্ত সফরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদী বন্ধুত্ব–শান্তি–সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ১৯৭৪ সালে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল ও সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় কিছু অতিরিক্ত ভূমি ছেড়ে দেয়ার জন্য তিনি ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ও শক্তিশালী ভূমিকার জন্য ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ফারক্কা বাঁধসংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করে।
১৯৯৬–২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশ–ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয় দীর্ঘসময় ধরে অমীমাংসিত গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট সরকারের জয়লাভের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে নবতর অধ্যায় রচিত হয়। উক্ত সরকারের আমলে দ্বিপক্ষীয়–আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বহু বিষয়ে মতৈক্য পোষণের প্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবিরোধী এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত সহযোগিতার ক্ষেত্রে উভয় দেশ একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। ঐ সময়ে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখন্ডের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য ট্রানজিট সুবিধা, ভারতকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা, সীমান্ত সমস্যা সমাধানে সম্মত, বাংলাদেশ কর্তৃক ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি এবং ভারত কর্তৃক এক মিলিয়ন ডলার ঋণদান বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের মেলবন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়।
২০১৪ সালে শ্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রতিবেশী কূটনীতির রোল মডেল হিসেবে প্রতিভাত। টানা তৃতীয় বারের মত জনাব নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সরকার গঠন বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। উভয় দেশের সরকারের ধারাবাহিকতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন পর্ব সূচনার অনুপম সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অতিসম্প্রতি ভারতের নবগঠিত সরকারের সাথে দেশের নানামুখী সমঝোতা স্মারক আশাজাগানিয়া অনুপ্রেরণায় উদ্ভাসিত। সরকার গঠনের পরপরই বাংলাদেশ সরকার প্রধানের ভারত সফর ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য সফরে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত সমস্যার দ্বার উন্মোচন আশাব্যঞ্জক।
সফরে বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে আরও সুসংহত করতে ৭টি নতুন এবং ৩টি নবায়নসহ ১০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়। দুপক্ষের মধ্যে চুক্তিগুলো হলো– ‘বাংলাদেশ–ভারত ডিজিটাল পার্টনারশিপ’ এবং ‘বাংলাদেশ–ভারত গ্রিন পার্টনারশিপ’। সমঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে– মেরিটাইম কোঅপারেশন, মহাকাশ সহযোগিতা, রেলওয়ে কানেক্টিভিটি, ওশেনোগ্রাফি এবং মিলিটারি শিক্ষা সহযোগিতা। এছাড়াও পুনর্নবায়ন করা ৩টি সমঝোতা স্মারকগুলো হচ্ছে– স্বাস্থ্য ও ওষুধ সহযোগিতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপন এবং মৎস খাতে সহযোগিতা ইত্যাদি। যেটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা হলো গঙ্গা চুক্তি নবায়ন এবং তিস্তার পানি বন্টন ইস্যু। উভয় ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার সমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি–সমঝোতার মেলবন্ধনের জোরালো আহ্বান ইতিবাচক বার্তা বহন করছে। একদিকে ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তি নবায়নের বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত। অন্যদিকে তিস্তার সমস্যা সমাধানে পানি বন্টন সংক্রান্ত কারিগরি কমিটি পাঠানো ইতিবাচক কৌতুহল তৈরি করেছে। কিন্তু অজানা কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিরূপ অবস্থান অত্যন্ত নিন্দনীয়। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সম্পাদিত সমঝোতার বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অভিপ্রায় নেহায়েত অযৌক্তিক। খোদ পশ্চিম বাংলার জনগণ ক্ষোভ প্রকাশ শুরু করেছে। এতে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে টানাপোড়নের অবস্থাও সৃষ্টি হতে পারে বলে বিজ্ঞজনের ধারণা।
ভারত সফরের দুই সপ্তাহের পর আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর চীন যাত্রা প্রায় চূড়ান্ত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, এই সফরে দুই পক্ষের মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়টি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– চীনের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ (জিডিআই), বাণিজ্য সহায়তা, বিনিয়োগ সুরক্ষা, ডিজিটাল–সুনীল অর্থনীতি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সমীক্ষার ঘোষণা এবং একাধিক মৈত্রী সেতু নির্মাণ–সংস্কার ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন বেইজিং সফরের সামগ্রিকভাবে প্রাধান্য পাবে অর্থনৈতিক সহযোগিতার নানা বিষয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য চীনের ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ। যার মধ্যে বাণিজ্য সহায়তার আওতায় ৫০০ কোটি ডলার এবং বাজেট সহায়তার জন্য ২০০ কোটি ডলার। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে শুরু হওয়া টাকা–রুপিতে লেনদেনের ধারাবাহিকতায় আসতে পারে টাকা–ইউয়ানে লেনদেনের সিদ্ধান্ত ।
২৫ জুন ২০২৪ সংবাদ সম্মেলনে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রাসঙ্গিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতার দেওয়া ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’ নীতি মেনে চলে যাচ্ছি, এগিয়ে যাচ্ছি। কখনও প্রশ্ন আসেনি কোথায় ব্যালেন্স কম হলো? এটা আসেনি। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার যে সুযোগটা দিচ্ছে, সেটা হচ্ছে উন্নয়ন করার সুযোগ। আমার কাছে এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মানুষের কল্যাণে, দেশের উন্নয়নে কার সঙ্গে কতটুকু বন্ধুত্ব দরকার সেটা করে যাচ্ছি। ভারত আমাদের চরম দুঃসময়ের বন্ধু। আবার চীন যেভাবে নিজেদের উন্নত করেছে, সেখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সেগুলো সামনে রেখে সম্পর্ক বজায় রেখে যাচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, ‘এদিকে ঝুঁকলাম নাকি ওদিকে ঝুঁকলাম; এই ঝোঁকা–ঝুঁকির ব্যাপারে আমরা নেই। আমার কিন্তু সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নেই। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে, এমনকি বিদেশেও অনেকেই বলে– আপনি কীভাবে ব্যালেন্স করেন? আমি বলি– ব্যালেন্স কোনো কথা না। তাদের দুই দেশের মধ্যে কী সম্পর্ক, সেটা তাদের ব্যাপার। আমি সেখানে নাক গলাই না। আমি সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’ সার্বিক পর্যালোচনায় এটুকু বলা যায়, চীন ও ভারতের সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলোতে কিছু অসামঞ্জস্য বিরোধ বিরাজমান থাকলেও; উভয় দেশের সাথে সংযোগ স্থাপনে সরকারের মেধা ও প্রজ্ঞা বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় পর্যায়ে পৌছেছে। এক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে বাংলাদেশ অভিনব অবস্থানে অধিষ্ঠিত। দুঃখজনক হলেও সত্য, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর একপেশে নীতির কারণে ইতিমধ্যে নানা ধরনের বিভ্রান্তিমূলক আশংকা তৈরি হয়েছে। সকল নেতিবাচক–অমূলক বিষয়সমূহ পরিহারে ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক সুদৃঢ় করে চীনের সাথেও নিগূঢ় সম্পর্ক উন্নয়ন প্রত্যাশিত।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।