ঢাকা এসে আটকে আছি কদিন ধরে। কারো সাথে কোন যোগাযোগ নেই। নেই ইন্টারনেট সংযোগ। নিজেকে মনে হচ্ছে যেন দূর কোন দ্বীপবাসী। চট্টগ্রাম থেকে গত ১৮ জুলাই ঢাকা এসে আটকে আছি কোটা সংস্কারের দাবীতে শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে। সকালের ফ্লাইট নিয়েছিলাম এই ভেবে বাসা থেকে এয়ারপোর্ট অবধি দীর্ঘ সড়ক পথে সম্ভাব্য ঝামেলার (গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নি–সংযোগ ইত্যাদি) মুখে পড়তে হবে না। সকালের দিকে মিছিল–সমাবেশ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ সাধারণত কম হয়ে থাকে, জানালেন নিকটজনেরা। ফ্লাইট সকাল পৌনে ন’টা। ভাবলাম আগ বাড়িয়ে এয়ারপোর্ট যাওয়া নিরাপদ। সেখানে পৌছে অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ‘ভাবলাম’ বলছি বটে, তবে সে ভাবনা এলো অনেক রাতে, বিছানায় গিয়ে। তখন রাত সাড়ে বার। চালক আলমগীরকে হোয়াটস এ্যাপ বার্তা পাঠিয়ে দেবার ক্ষণিক বাদে সে উত্তর পাঠিয়ে জানালেন, ভোর সাড়ে পাঁচটায় সে আমার বাসার নিচে অপেক্ষা করবে। বাসা থেকে এয়ারপোর্ট পথটুকু আসতে কোন সমস্যা হলোনা।
সমস্যা কিছুটা হলো ঢাকা নেমে। এয়ারপোর্টে নির্দিষ্ট গাড়ি এলো না। ভাইপো ঋত্বিক আগেই জানিয়েছিল তার নিজের গাড়ি যাবে না। ভাঙচুরের ভয়ে। তবে ড্রাইভার আজিজ যাবে। সে কোন একটা ‘বাহন’ ম্যানেজ করে বাসায় নিয়ে আসবে। আমার সাথে বড় বৌদি, ঋত্বিকের মা। দাদা মারা গেছে কোভিড সময়ে। লাগেজ ব্যাল্টের সামনে অপেক্ষা করছি লাগেজের জন্য। এমন সময় আজিজের ফোন। ওকে অপেক্ষা করতে বলি। ট্রলি নিয়ে বাইরে এসে দেখি সে অপেক্ষা করছে। এক টেক্সি চালক এগিয়ে এসে গাড়ি লাগবে কিনা জানতে চাইলে, মনে মনে বলি এ যাত্রায় বুঝি বেঁচে গেলাম। ধরে নিয়েছিলাম কোন গাড়ি পাবো না, সিএনজি একমাত্র ভরসা। আজিজ এর সাথে দর কষাকষি করতে লাগলে, পাছে হাতছাড়া হয়ে যায় সেই আশংকায় তাকে বলি, ‘আমি কথা বলি।’ কেননা এখন দরাদরি কোন সুযোগ নেই। ঋত্বিকের বাসা উত্তরার চার নম্বর সেক্টরে, এয়ারপোর্ট থেকে খুব কাছে। কথা ছিল সেখানে কিছু খেয়ে মিরপুর হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দেব। সেখানে দুপুর একটায় জার্মানী থেকে আসা সহকর্মী ড. আবদুল হাইয়ের সাথে জরুরি মিটিং ঠিক হয়ে আছে। আমার ওদিকে যাওয়া হলো না। হাই এলো উত্তরা, ‘পাঠাও উবারের’ পিঠে সওয়ার হয়ে। ইতিমধ্যে ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। গোটা দেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সেদিন ‘কমপ্লিট শাটডাউনের’ ডাক দিয়েছিল। মীরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ছাত্রদের সাথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের মুখোমুখি সংঘর্ষ, গুলিতে ছাত্রসহ বেশ কয়েক আন্দোলনকারী নিহত ও আহত হবার ঘটনা, বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ সব মিলিয়ে এক ভীতিকর ও আতংকজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সংঘর্ষে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্যও আহত হন।
দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক বিষয় যেটি বড় হয়ে বুকে বাজে তা হলো কতগুলি কচি প্রাণ অকালে ঝরে গেল। কোন মৃত্যুই কাম্য নয়। আর এই ধরনের মৃত্যুতো নয়ই। আমার পরিচিত ২২ বছরের এক যুবক মাথায় গুলি খেয়ে তৎক্ষণাৎ মারা গেল। বাপ নেই, মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল জয়, তার নাম। তাকে একবার দেখেছিলাম ঋত্বিকের বাসায়। ঋত্বিকের স্ত্রীর আপন ফুফাতো ভাই। যাই হোক পরিস্থিতি খারাপের দিকে এগুতে থাকলে সরকার কিছুটা দেরীতে হলেও বিচক্ষণতার সাথে এগিয়ে আসে এবং আন্দোলনকারী ছাত্রদের দাবী মেনে নেবার আশ্বাস দেন। প্রস্তাব দেন আলোচনার।
আলোচনার কোন ‘বিকল্প’ নেই। সে পরিবারের মধ্যে হোক, স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে, কিংবা বাইরে, দেশী–রাজনীতি থেকে শুরু করে ভূ–রাজনীতি–সবক্ষেত্রে আলোচনার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু ততক্ষণে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ভর করে ইতিমধ্যে বিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দল, ধর্মান্ধ–গোষ্ঠী, ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে অগ্নি–সংযোগ, লুট, ধ্বংসযজ্ঞ ইত্যাদি সমাজ–বিরোধী কর্মকান্ড শুরু করে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজধানীতে সেতু ভবনের সামনে পার্ক করা ৫৩টি গাড়িতে পেট্রোল ঢেলে পোড়ানো, ভবনে আগুন লাগানো, ভবনে প্রবেশ করে কম্পিউটার থেকে শুরু করে অফিসের প্রয়োজনীয় ফাইল, আসবাবপত্রে আগুন লাগানো ও লুট, মেট্রোরেল পুড়িয়ে দেয়া, বাংলাদেশ টেলিভিশন কেন্দ্র আক্রমণ ও অগ্নি–সংযোগ–মোট কথা এক অরাজক ও ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়।
বুঝতে আর বাকী নেই শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন ‘হাইজ্যাকড’ হয়ে গেছে। এতে কোন ছাত্র নেই। কোনো ছাত্র বিটিভি ভবন আক্রমণ করে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে না। কোন শিক্ষার্থী মেট্রো রেল পুড়িয়ে দিতে পারে না। দিনের মত স্পষ্ট যে একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে চায়। তারাই এই ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িত। একটি গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য এমনটি করছে। কেউ কেউ বলেন, বাইরে থেকে ‘কলকাঠি’ নাড়ানো হচ্ছে যার লক্ষ্য সরকারকে গদীচ্যুত করা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নেতারা ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, এই সমস্ত অপকর্মের সাথে তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক, সারজিস আলম জানান, “বিটিভি ভবনে আগুনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ভবনে নাশকতার কাজে ছাত্র আন্দোলনের কেউ জড়িত নয়।” তিনি বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনে যে কোন রাজনৈতিক দল সমর্থন জানাতে পারে। কিন্তু সমর্থন জানানোর নামে ‘রাজনৈতিক স্বার্থ’ হাসিল করতে কোন দলের কোন ধরনের নাশকতা সমর্থন করে না ছাত্ররা।”
ইতিমধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকার ‘কার্ফ্যু’ জারি করতে বাধ্য হয়। এর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে থাকে। সরকারও আন্দোলনকারীদের দাবী মানার ক্ষেত্রে তাদের ‘হার্ড–লাইন’ থেকে সরে এসে সমঝোতার পথে এগিয়ে আসেন, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে জানান।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেমে গেছে বলা চলে। তবে এখন দেখা দরকার কোন গোষ্ঠী বা কারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। চট্টগাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী এমপির সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় এক প্রতিবাদ সভায় বক্তারা বলেন, “চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছদ্মবেশে বিএনপি–জামাতিরা ঢুকে পড়েছে।” কোন আন্দোলনে অন্য কেউ সমর্থন দিলে বা সংহতি প্রকাশ করলে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সমর্থনের নামে, সংহতির নামে শিক্ষার্থীদের কাঁধে বন্দুক রেখে যারা দেশে এই সীমাহীন ও নজিরবিহীন নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুঠ ও ধ্বংস করেছে তাদের উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার বলে এক ফোনালাপে মন্তব্য করেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যখন সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে তখন এই ঘৃণিত ও ব্যর্থ অপশক্তি দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে সচেষ্ট। এদের রুখে দাঁড়াতে হবে।” অনুরূপ মন্তব্য করেন চট্টগ্রামের পতেংগা এলাকার নেতৃস্থানীয় সমাজকর্মী ও ব্যবসায়ী ওয়াহিদ হাসান। তিনি বলেন, “সন্ত্রাস সে যেই পক্ষ থেকে আসুক না কেন ঠেকাতে হবে। গত কদিন গোটা বাংলাদেশে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে তা জনগণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে–কিছুতেই কাম্য নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পরিশেষে বলতে হয় সবকিছু থেমে যাবে। থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল–উত্তেজনা, প্রত্যাশা এই সরকারসহ সব–পক্ষ সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য্য প্রদর্শন করবে। আশা করবো যারা এই ধরনের ধ্বংসযজ্ঞে জড়িত এবং তাদের পেছনে যারা আড়ালে থেকে সকল ধরনের ইন্ধন যোগান, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সেটি যত তাড়াতাড়ি হয় ভালো দেশ ও দশের জন্য।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট