বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক নিরলস গবেষকের জীবনাবসান

| শুক্রবার , ২৬ জুলাই, ২০২৪ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

খ্যাতিমান ভাষাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. মাহবুবুল হক আর নেই। তিনি গতরাতে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ঢাকায় সিএমএইচ হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি….রাজেউন)। তাঁর মহাপ্রয়াণে আমরা দৈনিক আজাদীর পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করছি।

. মাহবুবুল হক বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য অঙ্গনে এক অনন্য নাম। তাঁর পরিচিতি বিভিন্ন পরিসরে পরিব্যাপ্ত। লেখালেখি, সম্পাদনা, শিক্ষকতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর কৃতিত্ব ও প্রয়াস তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলা বানানের বিশেষজ্ঞ, মননশীল প্রাবন্ধিক ও পরিশ্রমী গবেষক হিসেবে তিনি দেশেবিদেশে সুধীজনের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছেন। কুমিল্লা সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন নেতৃস্থানীয় সংগঠক। বহুমাত্রিক মাহবুবুল হক একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নজরুল পদক, ফিলিপস পুরস্কার, মুক্তিযুদ্ধ পদক, মধুসূদন পদক, চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কার, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সাহিত্য পুরস্কার, রশীদ আল ফারুকী সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা অর্জন করেছেন।

. মাহবুবুল হক চট্টগ্রামে অবস্থান করেও জাতীয় মানের কাজই উপহার দিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায় যে অবদান রেখে চলেছেন, তার জন্য তিনি সম্মানিত হয়েছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির গবেষণায় যে কৃতিত্ব তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, তা এককথায় অসামান্য ও অতুলনীয়। চট্টগ্রামবাসী এজন্য তাঁর কাছে ঋণী। কীর্তিমান এই গবেষক গত ৩রা নভেম্বর ২০২৩ পূর্ণ করেছেন জীবনের ৭৫ বছর। এ উপলক্ষ্যে ৪ঠা নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষ থেকে আয়োজিত হয়েছিল ‘ড. মাহবুবুল হক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান’। এতে প্রকাশ করা হলো একটি সংবর্ধনাগ্রন্থ। বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন যশস্বী লেখকের লেখা সংকলনভুক্ত হয়েছে। লেখকরা মাহবুবুল হকের সৃষ্টিকর্ম ও জীবনের বিভিন্ন দিকে আলোকপাত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে নিঃসন্দেহে। ড. মাহবুবুল হক ছিলেন চিন্তা ও কর্মে অসাম্প্রদায়িক, মানবব্রতী ও আধুনিক।

প্রফেসর রীতা দত্ত এক লেখায় মূল্যায়ন করেছেন এভাবে : ‘বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃিতর ভুবনের একজন ঋদ্ধ মানুষ ড. মাহবুবুল হক। চলনে বলনে পোশাকে আশাকে চিন্তায় চেতনায় একজন পরিশীলিত রুচিবান ব্যক্তি। কৈশোরে ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃজনশীল কর্মকান্ডে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন যা পরবর্তী সময়ে বহুধা বিস্তৃত হয়েছে। এক গভীর জীবনবোধে তাড়িত হয়ে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছেন জীবনের ব্রত হিসাবে। বহু ছাত্রছাত্রী তৈরী করেছেন যাদের মধ্যে অনেকে শিক্ষকতায় এসেছেন এবং সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁর পাঠদান কেবল শ্রেণিকক্ষে নয়, যখন তিনি বক্তৃতা মঞ্চে বক্তব্য রাখতেন তখন সভাস্থলটি শ্রেণিকক্ষে পরিণত হতো। আমি নিজে তাঁর সাথে চট্টগ্রাম একাডেমি সহ বহু সংগঠনের আয়োজিত আলোচনা সভায় একই মঞ্চে বসার সুযোগ পেয়েছি, শুনেছি তাঁর সাবলীল বক্তব্য, দেখেছি তাঁর উপস্থাপনার সৌকর্য বহূ বিচিত্র বিষয়ে তাঁর পঠনের ব্যাপ্তি বিস্ময় জাগায়।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সাধনা করেছেন নিরলস। বাংলা বানানের কঠিন জটিল বিষয়কে সহজবোধ্য করেছেন, বাংলা ভাষার প্রমিত বানান রীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন যা আমাদের নিত্য পথ দেখিয়ে চলেছে। বাবার কর্মস্থল চট্টগ্রাম হওয়ার কারণে ফরিদপুর থেকে চট্টগ্রামে এসেছেন। চট্টগ্রামে কাটিয়েছেন সুদীর্ঘ সময়। বলতে গেলে পুরো জীবনটাই কাটিয়ে দিলেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম ভাষাভাষী না হওয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার জন্য তাঁর আছে গভীর মমত্ববোধ। তিনি লিখেছেন সহজ পন্না নামক বই।

দৈনিক আজাদীর সাথে ড. মাহবুবুল হকের সম্পর্ক ছিল গভীর ও আন্তরিকতাপূর্ণ। দৈনিক আজাদীর পঁয়ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ সংকলনের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তিনি স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘আমার সৌভাগ্য, সেটির সার্বিক পরিকল্পনা ও সম্পাদনার মূল দায়িত্ব মালেক ভাই ও অধ্যাপক খালেদ আমাকে দিয়েছিলেন। আমি আজাদীর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো দায়িত্বে ছিলাম না। কিন্তু মালেক ভাই ও অধ্যাপক খালেদ পুরোপুরি স্বাধীনভাবে আমাকে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। মাত্র মাস দুয়েকের মধ্যে বিশেষ সংখ্যাটি আমাদের সম্পাদনা করে প্রকাশ করতে হয়েছিল। সে জন্যে একটা পথমানচিত্র তৈরি করে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে আমরা অগ্রসর হই। এই পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল একাধিক বৈঠকে। অধ্যাপক খালেদকে মধ্যমণি করে মালেক ভাই, অরুণ দা, জহুর ভাই ও আমি সে রূপরেখা চূড়ান্ত করি। তারপর কাজে নেমে যাই। সেই কাজের অভিজ্ঞতা আমার জন্যে অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ও আনন্দের। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠকদের অবদানে এবং প্রশাসনের সহায়তায় হাজার বছরের চট্টগ্রামের ভৌগোলিক পরিচিতি, পুরাকীর্তি, ইতিহাস, প্রশাসনিক দিক, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য, খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ সংকলন প্রকাশ করা সম্ভব হয়।’

. মাহবুবুল হকের মৃত্যুতে আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যাঙ্গনে যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপুরণীয়। আমরা তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে