বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, খ্যাতিমান ভাষাবিজ্ঞানী, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক ও গবেষক ড. মাহবুবুল হক আর নেই। গত বুধবার (২৪ জুলাই) দিবাগত রাত পৌনে ২টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি… রাজেউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী শিক্ষাবিদ সালেহা বেগম, কন্যা উপমা মাহবুব, পুত্র উপল মাহবুবসহ অসংখ্য আত্মীয়–স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। গতকাল ঢাকায় ড. মাহবুবুল হকের প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আজ শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত সর্বস্তরের জনসাধারণের জন্য শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ড. মাহবুবুল হকের মরদেহ রাখা হবে। বাদ জুমা জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। ওখানে তৃতীয় নামাজে জানাযা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে। তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। ড. মাহবুবুল হক দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ৭ জুলাই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ড. মাহবুবুল হক ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান ফরিদপুর জেলার মধুখালিতে। তবে শৈশব থেকে বেড়ে ওঠেছেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৭০ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কুমিল্লার কোটবাড়িতে অবস্থিত সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন ছিলেন তিনি।
ড. মাহবুবুল হকের জীবন বিচিত্র কর্মে আলোকিত। কৈশোর ও যৌবনে তিনি বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি অধ্যাপনাকে কর্মজীবনের পাথেয় করেছেন। গবেষক হিসেবেও পেয়েছেন স্বীকৃতি। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল– তিন কবি সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্য। পরম যত্নে মাহবুবুল হক তাদের কবিতার বৈশিষ্ট্য উদঘাটন করার চেষ্টা করেছেন। মিষ্টভাষী এই মানুষটার মধ্যে নানা সুন্দর ও অপূর্ব গুণের সমন্বয় ঘটেছে। সৃজনে, মননে সবসময় তিনি ছিলেন ক্রিয়াশীল। ঝঞ্ঝাটমুক্ত ছিল তাঁর পথচলা। শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন মাহবুবুল হক। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতা করেছেন রাঙ্গুনিয়া কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন বাংলা বিভাগে। শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রায়োগিক বাংলা ও ফোকলোর চর্চা, গবেষণা, সম্পাদনা, অনুবাদ ও পাঠ্যবই রচনা করে পরিচিতি লাভ করেন ড. মাহবুবুল হক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় একশ’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকেও তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন। চট্টগ্রামে বসবাস করেও নিজেকে জাতীয় পর্যায়ের একজন অপরিহার্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে সক্ষম হন তিনি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বেশ কয়েকটি বাংলা পাঠ্য বইয়েরও রচয়িতা তিনি। আহ্বায়ক হিসেবে নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী ২০১২ ও ২০১৩ শিক্ষাবর্ষের বাংলা শিক্ষাক্রম ও বাংলা পাঠ্যবই প্রণয়নে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে তাঁর।
শিক্ষাবিদ ড. মাহবুবুল হক জ্ঞান–সাধনায় আজন্ম নিমগ্ন একজন বহুমাত্রিক মানুষ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। শিল্প–সাহিত্য–শিক্ষা–সংস্কৃতি–রাজনীতি তথা বাঙালির সামগ্রিক যাত্রায় তিনি এক প্রাগ্রসর পথিক। ড. মাহবুবুল হক ছিলেন একাধারে অধ্যাপক, ভাষাবিদ, প্রাবন্ধিক, লোকগবেষক, সমালোচক, সুবক্তা ও সংগঠক। শিশুসাহিত্যেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। পাশাপাশি প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চায় দেশের একজন সংগ্রামী মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সদা জাগ্রত ও অবিচল থেকেছেন। প্রগতিশীল শিক্ষা–সমাজ–সভ্যতা তথা মানব মুক্তি ও মানব বিকাশে তিনি সক্রিয় ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার মাঝেও অপরিসীম ধৈর্য ও মনোবলের সাথে তিনি নানা সামাজিক–সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
বহুমাত্রিক ড. মাহবুবুল হক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নজরুল পদক, ফিলিপস পুরস্কার, মুক্তিযুদ্ধ পদক, মধুসূদন পদক, চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কার, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সাহিত্য পুরস্কার, রশিদ আল ফারুকী সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। ড. মাহবুবুল হক চিন্তা ও কর্মে একজন অসাম্প্রদায়িক, মানবব্রতী ও মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন।
প্রখ্যাত এই ভাষা বিজ্ঞানীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন– চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের, চট্টগ্রাম একাডেমির চেয়ারম্যান ড. অনুপম সেন, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, চবি উপ–উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর বেনু কুমার দে, দৈনিক আমাদের সময় সম্পাদক আবুল মোমেন, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু ও সহসাধারণ সম্পাদক কঙ্কন দাশ, পণ্ডিত বিহারের বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি ড. জিনবোধি ভিক্ষু ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল যাত্রা, তাপস হোড়, অ্যাডভোকেট প্রদীপ চক্রবর্তী, স্থপতি বিজয় তালুকদার, আশিক আরিফিন, নাট্যধারকর্মী মোহাম্মদ রাসেল, অমিত বড়ুয়া, সুযশ চৌধুরী, জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা আবু তাহের,
সিপিবি, চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি কমরেড অশোক সাহা ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কমরেড নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়া, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. চন্দন দাশ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শীলা দাশগুপ্ত, উদীচী, চবি শাখার সভাপতি কবি ইউসুফ মুহম্মদ প্রমুখ। তাঁরা এ শিক্ষাবিদের বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছেন এবং শোকসন্তন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।