নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, অনেক আমদানিকারক কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে ঘিরে সংঘটিত সহিংস পরিস্থিতির কারণে পণ্য খালাস করতে পারেননি। তারা বন্দরের ডেমারেজ চার্জের মুখোমুখি চলে এসেছে। আপনারা জানেন, চট্টগ্রাম বন্দর করোনার সময় পাঁচশত কোটি টাকার ওপরে ওয়েভার দিয়েছিল। আমাদের কাছে ব্যবসায়ীরা সেভাবে যদি উপস্থাপন করে চট্টগ্রাম বন্দর নিশ্চিতভাবে সেটা বিবেচনা করবে। কারণ শুধু তো ব্যবসা করার জন্য নয়, দেশের অর্থনীতিকে সেবা করার জন্য এ বন্দর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এ বন্দর পরিচালনা হবে না। অর্থনীতির সেবার ক্ষেত্রে এ বন্দর কাজে লাগবে। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। সঠিক তথ্য প্রমাণসহ আসলে আমরা পাশে দাঁড়াব।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত শ্রমিকদের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ২০১৯ সালে বলেছিলাম, ২০২৪–২৫ সালে আমরা চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনালের কাজ করবো। কিন্তু পারিনি তো। এটাই বাস্তবতা। কেন পারিনি, কারণ তিন বছর ব্লক ছিলাম। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা থেমে গিয়েছিল। এখন আমরা সচল হয়েছি। কিন্তু এখন যে সংকট তৈরি হলো পৃথিবীর দেশে দেশে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থার ওপর যে বার্তা গেল সেটা আমাদের জন্য ভালো নয়। আমি জানি না, যাদের সঙ্গে আমরা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করবো তারা কীভাবে দেখছেন। পরবর্তীতে আলোচনা না করে এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে পুঁজি করে পুলিশের পোশাক পরে দুর্বত্তরা সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। দুর্যোগ ভবনে আগুন দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের সার্ভার স্টেশন পুড়িয়ে দেওয়া হলো। সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে সংবাদের কনটেন্ট আগে থেকেই তৈরি করে সরবরাহ করা হয়েছে। তারা বাংলাদেশকে একটি পরিত্যক্ত দেশ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিল। এত রক্তপাত, হতাহতের ঘটনা আমি কখনও দেখিনি। একজন দারোয়ান তার ভবনের দরজা খুলে দেয়নি বলে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এক নারী সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। এগুলো কোনো মানুষের কাজ হতে পারে না। ১৯৭১ সালে যেভাবে রাজাকার–আলবদররা সাধারণ মানুষকে খুন করেছে, নারীদের ধর্ষণ ও লুটপাট করেছে, একই দৃশ্য আমরা দেখলাম গত কয়েকদিনে। ছাত্রদের আন্দোলনের ওপর ভর করে তারা যেভাবে ধ্বংসলীলা চালালো, সেটা সবাই দেখেছে। ছাত্ররা স্পষ্ট জানিয়েছে, তারা এ ধ্বংসাত্মক কাজের সঙ্গে জড়িত নয়। এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না। এখানে শ্রমিক যারা আছেন, তাদেরও অনেক দাবি আছে। স্কপের পাঁচ দফা দাবিতে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। সব রাজনৈতিক দল এক হয়ে শ্রমিকদের ওই আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। কিন্তু সে শ্রমিক আন্দোলন কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়নি, পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করেনি। সেটা একটা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল।
দেশ দখল করতে বিদেশ থেকে উসকানি দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সে উসকানিতে মির্জা ফখরুল বললেন কোটা আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি আছে, সরকার উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। কিন্তু এখন মির্জা ফখরুল বলছেন এ আন্দোলনের সঙ্গে আমরা নেই, আমরা সমর্থন দিয়েছি, সম্পৃক্ত হইনি। এতবড় অভিনেতা আমি কোনোদিন রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখিনি। আমরা সিনেমা, নাটক ও যাত্রাপালা দেখেছি। অনেক অভিনেতার অভিনয় দেখে প্রশংসা করেছি। এখন মির্জা ফখরুলের অভিনয় দেখে প্রশংসা না করে পারা যায় না। আগেরদিন বলছে এ আন্দোলন শেষ হবে না, যতক্ষণ সরকারের পতন হবে না। আবার পরের দিন বলছে এ আন্দোলনের সঙ্গে আমরা নেই। এ দ্বিচারিতা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বাংলাদেশে বন্ধ করতে হবে।
কারফিউ বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে আনন্দিত করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের গণমাধ্যম এত বেশি শক্তিশালী যে কোনো সংবাদ গোপন থাকে না। দেশের এরকম একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে দেশের সার্বিক মানুষের শান্তি স্থাপন ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা কারফিউ ঘোষণা করেছেন। কারফিউ বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে আনন্দিত করেছে। কারফিউ জারি করার পর পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আল্লাহর রহমতে চট্টগ্রাম অনেক নিরাপদ ছিল। চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। এ জন্য আমি চট্টগ্রামবাসীকে ধন্যবাদ জানাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই। তারা এখন চট্টগ্রামের বড় বড় সব স্থাপনা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে আমরা রক্ষা পেয়েছি, আমাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। গণমাধ্যমের কথা না বললেই নয়, আপনারা কিন্তু প্রতি মুহূর্ত চট্টগ্রাম বন্দরের খোঁজখবর গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন। মানুষ আশঙ্কার মধ্যে থাকে, ব্যবসায়ীরাসহ অর্থনীতি খাতে যারা কাজ করে– চট্টগ্রাম বন্দরে ঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে কিনা। আপনারা প্রতিনিয়ত সংবাদ দিয়েছেন, কন্টেনার কার্গো উঠানামা হচ্ছে। আপনারা দেশবাসীর কাছে অর্থনীতির সুখের খবর প্রতিনিয়ত দিয়েছেন। আমরা আশ্বস্ত হয়েছি আমাদের অর্থনীতির লাইফলাইন এখনো আনটাচ আছে, একদম নিরাপদ আছে। এটা আমাদের জন্য খুবই স্বস্তির ছিল। কিন্তু যে ঘটনা ঘটেছে তার কারণে আমরা অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহন করতে পারিনি। তবে ডিজিটাল সার্ভার স্টেশন, ডাটা সেন্টার পুড়ে দেওয়ার কারণে আমাদের কিন্তু ডিজিটাল প্লাটফরম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কাস্টমস তাদের কার্যক্রম করতে পারেনি বলেই চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার জট তৈরি হয়েছে। কারণ পুরোপুরি ডিজিটালি কাজ করে তারা। যদিও অনেক কষ্ট ও পরিশ্রমের পর ম্যানুয়ালি কিছু কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। তাতে প্রতিদিন যেখানে বন্দরে ৭–৮ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং, ডিসচার্জ হচ্ছে জাহাজ থেকে। এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিল না। এ কারণে সার্বিক অর্থনীতিতে বিরাট ক্ষতি হয়েছে। আমাদের পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা স্লো হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতির বিরাট একটা ধাক্কা। আমি জানি না এ ধাক্কা কীভাবে কাটিয়ে উঠবে।
রেলপথে কন্টেনার পরিবহন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম চলছে। আপনারা জানেন রেল বন্ধ হয়ে গেছে, নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটের অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক ব্রিজ কালভার্ট ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা আলোচনা করছি। আমাদের রেল আছে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে রেলসংযোগ হওয়ার কারণে কমলাপুর আইসিডি অনেক সংকুচিত হয়েছে। অ্যালাইনমেন্ট আমাদের আইসিডির ওপর দিয়ে গেছে। পানগাঁওতে কিছুটা স্থবির অবস্থা তৈরি হয়েছিল। করোনার সময় কনটেইনার জট হয়েছিল। অফডক, কাস্টমস, এনবিআর সাপোর্ট দিয়েছিল। সম্মিলিতভাবে সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। আমি মনে করি, খুব দ্রুত জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারবো।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল, বন্দর কর্মচারী পরিষদের (সিবিএ) মো. নায়েবুল ইসলাম ফটিক প্রমুখ। সঞ্চালনায় ছিলেন বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক।