প্রফেসর ড. আবদুল করিম স্মরণে

সোহেল মো. ফখরুদ-দীন | বুধবার , ২৪ জুলাই, ২০২৪ at ৩:২৮ অপরাহ্ণ

ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজশাসন, ধর্মীয় অনুশাসন, ধর্মীয় শাসন, মোগল সুলতান, মুসলমান আগমনসহ প্রত্নইতিহাস গবেষণার মাধ্যমে চট্টগ্রামের কৃতী পুরুষ প্রফেসর ড. আবদুল করিম একজন স্মরণীয় ও বরণীয় মনীষী হিসেবে নিজের অবস্থানকে ইতিহাসে ধরে রেখেছেন। বঙ্গীয় মুসলমান ইতিহাস ও ভারত উপমহাদেশের মুসলমান শাসনের ইতিহাসকে তিনি গ্রন্থিত করে নবপ্রজন্মকে হাজার বছরের ইতিহাস উপহার দিয়েছেন। তাঁর জন্মগত জন্মভূমি এই চট্টগ্রাম ড. আবদুল করিমের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে পৃথিবীব্যাপী। নন্দিত এই ইতিহাসবিদের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করছি। তাঁর ইতিহাস রচনার মাধ্যমে আজকের দিনে ইতিহাস লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিষয়ক অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকবৃন্দ উপকৃত হচ্ছেন। বলা যেতে পারে, মরেও অমরত্ব লাভ করা প্রফেসর আবদুল করিম ইতিহাসের সন্ধানদাতা মহাপুরুষ হয়ে জনম জনম বেঁচে থাকবেন। ‘ভারত উপমহাদেশের মুসলমান শাসন’, ‘ঢাকাই মসলিন’, ‘বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল)’, ‘চট্টগ্রামে ইসলাম’, ‘বাংলা সাহিত্যের কালক্রম (মধ্যযুগ)’, ‘ইসলামের ইতিহাস: পশ্চিম এশিয়া, স্পেন ও আফ্রিকা’, ‘বাংলার ইতিহাস (মুসলিম বিজয় থেকে সিপাহী বিপ্লব পর্যন্ত: ১২০০১৮৫৭)’, ‘সুলতান আমল মুসলিম বাংলার স্বর্ণ যুগ’ গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে ড. আবদুল করিম সারা পৃথিবীতে এই অঞ্চলে ইতিহাসের তথ্যদাতা ও বর্ষীয়ান ইতিহাসবিজ্ঞানী হিসেবে স্মরণীয়।

প্রফেসর ড. আবদুল করিম ২০০৭ সালের ২৪ জুলাই ইন্তেকাল করেন। ২০২৪ সালের ২৪ জুলাই তাঁর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। চট্টগ্রামের ইতিহাসঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণার কাজে স্যারের সাথে আমার গভীর সম্পর্ক ছিল। স্যারের বাসভবনে প্রায় যাওয়া হতো আমার। স্যারের একান্ত আগ্রহে আমরা তরুণ কজন ইতিহাস গবেষকের সম্মিলনে চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র গঠন করি। একই সাথে প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস সমিতি নামে একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করি। দুর্ভাগ্য, প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস সমিতি সংগঠনটি আজ বিলুপ্ত। চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের বহু সভা, সেমিনারে প্রফেসর ড. আবদুল করিম অতিথি হিসেবে যোগদান করে চট্টগ্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। তাঁর নির্দেশনা ও প্রেরণামূলক বক্তব্যকে সামনে রেখে আজও চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র এ অঞ্চলের ইতিহাসকে তুলে ধরছে দেশ ও বিদেশে। ড. আবদুল করিম আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া মহামূল্যবান গ্রন্থগুলো আমাদেরকে আলোর পথ দেখাচ্ছে।

চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক ড. আবদুল করিম ১৯২৮, ১ জুন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার বাঁশখালী থানার চাপাছড়ি গ্রামের সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম সৈয়দ ওয়াইজুদ্দীন। তিনি স্বগ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে চট্টগ্রামের ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালে তিনি সেখান থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন এবং ১৯৪৬ সালে প্রথম বিভাগে অষ্টম স্থান অধিকার করে ইন্টরমিডিয়েট পাস করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে বিএ অনার্স পাস করেন এবং ১৯৫০ সালে ইংরেজীতে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ পাস করেন। ১৯৫১ সালে তিনি প্রভাষক হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন এবং গবেষণায় লিপ্ত হন। তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে পিএইচডি লাভ করেন। অতঃপর উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে পিএইচডি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডন থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে রিডার পদে উন্নীত হন। ১৯৬৯ সালে এপ্রিল মাসে তিনি চট্টগ্রাম ইতিহাস বিভাগের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে আর্ট ফ্যাকালটির ডিন হন। ১৯৭৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিযুক্ত হন। প্রফেসর ড. আবদুল করিমকে প্রশংসনীয় ঐতিহাসিক অবদান রাখার জন্য লন্ডনের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি অফ গ্রেট ব্রিটেন এন্ড আয়ারল্যান্ড ফেলোশিপ প্রদান করেন। ভারতের বেনরস্থ, ন্যুমিস্টিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া, বাংলাদেশে উক্ত বিভাগে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য তাঁকে আকবর রৌপ্য পদক ও সদস্য পদ প্রদান করেন, ২০০৩ সালে ভাষা আন্দোলনের স্থপতি অধ্যক্ষ আবুল কাশেম সাহিত্য একাডেমী পদক, ২০০৬ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী গবেষণা পরিষদ স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে ইতিহাস সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ভারত ও পাকিস্তান সফর করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থাবলী Social History of the Muslims in Bengal গ্রন্থ ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত। Corpous of the Muslims Coins of Bengal গ্রন্থ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত। Murshid Quli Khan and hit Times গ্রন্থ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত। Dacca the Mughal Capital গ্রন্থ ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত। এই চারটি গ্রন্থ এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত হয়। ঢাকাই মসলিন, ১৯৬৫ ইংরেজি, বাংলা একাডেমী। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, বাংলা একাডেমি, বাংলার ইতিহাস: সুলতানী আমল, ১৯৭৭ইং, বাংলা একাডেমি। চট্টগ্রামে ইসলাম, ১৯৬৯ ইংরেজি, সোসাইটি ফর পাকিস্তান স্টাডিজ। নশরুল্লাহ খোন্দকার রচিত শরীয়তনামা, সম্পাদনা ১৯৭৫ইং, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। Catalogue of the Coins of Bangladesh in the Chittaging University Museumসহ আরও অসংখ্য গ্রন্থের প্রণেতা। এ ছাড়া দেশিবিদেশি বিভিন্ন গবেষণা পত্রিকায় ৫০০টিরও অধিক প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। চট্টগ্রাম নগরীর ঐতিহাসিক গরীবউল্লাহ শাহ (রহ.) মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে এই মহান মনীষীকে চির সমাহিত করা হয়। তাঁর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

লেখক: সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র (সিএইচআরসি)

পূর্ববর্তী নিবন্ধইচ্ছের প্রগাঢ়তায়
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে