মো. রাশেদুল আলম পেশায় ব্যবসায়ী। গত ৬ জুলাই দুপুরে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন করে অজ্ঞাত ব্যক্তি বলেন, কক্সবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বলছি। আপনার মোবাইল নম্বরটি আমাদের সার্ভারের সাথে সংযুক্ত হয়ে গেছে বিধায় সার্ভারে সমস্যা হচ্ছে। এরপর তার নম্বরে একটি কোড পাঠানো হয় এবং সেটি হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়ার জন্য বলা হয়। রাশেদুলের মোবাইলটি ৩০ মিনিটের জন্য বন্ধ রাখতে বলা হয়। যথারীতি তিনি তা করেন। ৩০ মিনিট পর মোবাইল ফোন চালু হলে তার কাছে পরিচিতজনদের একের পর এক ফোন আসতে থাকে। তিনি জানতে পারেন, ০১৭৫৩৩৪৮৮৫৬ নম্বরে নির্দিষ্ট অংকের টাকা পাঠাতে বলে তার হোয়াটসঅ্যাপ থেকে তাদের কাছে ম্যাসেজ গেছে। এর মধ্যে অনেকে টাকা পাঠিয়েও দিয়েছেন উল্লেখিত নম্বরে।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে জিডি করার পর শুরু হয় নতুন যন্ত্রণা। তার পরিচিতজনদেরকেও একইভাবে ফোন করা হচ্ছে এবং একইভাবে ম্যাসেজ পাঠানো হচ্ছে। প্রতারণার নতুন কৌশল এটি। স্মার্টফোনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এ ধরনের সাইবার অপরাধের ঝুঁকি অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি। এক শ্রেণীর অপরাধী চক্র এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে কখনো সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের নাম–পরিচয় ব্যবহার করে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ, কখনো আবার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি পরিচয়ে দিচ্ছে প্রাণনাশের হুমকি। ইতোমধ্যে মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃক্সখলা বাহিনী বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। ধরা পড়েছে তাদের অনেকে। এরই ফাঁকে প্রতারক চক্র ‘সিম ক্লোনিং’ করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে যোগ হয়েছে ‘মোবাইল নম্বর স্পুফিং’। শুধু তাই নয়, আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এসএমএস এডিটিং, যা মোবাইল প্রতারকদের নতুন কৌশল হতে পারে। স্পুফিং ও সিম ক্লোনিং হচ্ছে মোবাইলে প্রতারণায় ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর প্রথম ধাপ মাত্র। এসবে ব্যবহৃত সফটওয়্যারগুলোর আরো আপডেট ভার্সন আছে। এমনও শক্তিশালী প্রযুক্তি আছে, যার মাধ্যমে একজনের পাঠানো এসএমএস আরেকজন এডিট করে পাঠাতে পারে, কথা শুনতে পারে এবং রেকর্ডও করা যায়। এসএমএস এডিটিংয়ের মাধ্যমেও হতে পারে প্রতারণা। এসএমএস পরিবর্তন করেও পাঠানো যায়।
প্রযুক্তিগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিত্য নতুন অপরাধ সংঘটন প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) আইটি বিশেষজ্ঞ কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার আসিফ মহিউদ্দীন বলেন, সাইবার ক্রাইমের ধরন পাল্টাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা কোনো অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। তবে বাস্তবতা হলো, পুরোপুরি দমন করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। বেশ কিছু অভিযান চালিয়েছি। জড়িতদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে জামিনে এসে তারা একই অপরাধে জড়িয়েছে। বিষয়টা আমাদের জন্য এলার্মিং।
মোবাইল নম্বর স্পুফিং : আইটি জগতে স্পুফিং মানে কোনো সিস্টেম বা ইউজারকে ধোঁকা দেওয়া। সাধারণত কোনো ইউজারের আইডি গোপন করে অথবা নকল করে স্পুফিং বা প্রতারণা করা হয়। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এটি করা যায়। সফটওয়্যারের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তির মোবাইল নম্বর হুবহু নকল করে কাউকে ফোন করা যায়। আর যার নম্বর ব্যবহার করা হচ্ছে তিনি বুঝতেই পারছেন না যে তার নম্বরটি ব্যবহার করে প্রতারণা করা হচ্ছে।
অনুসন্ধান ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, এ ধরনের কল সাধারণ মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার পরিবর্তে ইন্টারনেটে বিদেশি সার্ভারের মাধ্যমে ঘুরে আসে। তাই এ ধরনের কলে কোনো অপরাধ হলে তা বের করতে প্রযুক্তিগত অনেক সহায়তার প্রয়োজন হয়। বিশ্বের ৬০টি দেশে এর মাধ্যমে কল করা যায়। এছাড়া মেইলের মাধ্যমে স্পুফিং করা হয়। এটি হ্যাকিংয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। একে ফেইক মেইলিং বা স্পুফিংসহ অনেকে অনেক নামে ডাকেন।
সিম কার্ড ক্লোনিং : সিম কার্ড ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে সিমের পুরো তথ্যই চুরি করা হচ্ছে। একটি সিম কার্ডের মাইক্রো কন্ট্রোলারে থাকা তথ্য নকল করা হচ্ছে। ফলে সিম কার্ডে থাকা সকল তথ্য নকল সিম কার্ডে চলে যাচ্ছে। এমনকি সিম কার্ড ক্লোনিংয়ের ফলে সঠিক সিম কার্ডের রেকর্ড যেমন কল লিস্ট, ডায়াল কল লিস্ট, মেসেজ লিস্ট, পিন কোড, আইসিসিআইডি নম্বর এবং সিম কার্ডের ব্যালেন্স স্থানান্তর হচ্ছে। এক্ষেত্রে অপারেটর পরিবর্তন করা হলেও কলগ্রহীতার মোবাইল সেটে সেভ করা ব্যক্তির নাম দেখাবে। তবে যদি নম্বরটি সেভ না থাকে তাহলে কলগ্রহীতার কাছে অপরিচিত নম্বর হিসেবে দেখাবে। ক্লোন সিম দিয়ে সহজেই ফোন কল করা ও মেসেজ পাঠানো যায়। এতে করে পরিচয় গোপন রেখে অপরাধ করে পার পেয়ে যেতে পারে অপরাধীরা। পুলিশের দাবি, মিসড কল বিনিময়ের মাধ্যমে সাবস্ক্রাইবার আইডেন্টিফিকেশন মডিউল বা সিম কার্ড ক্লোন করা সম্ভব।
আইসিটি বিশেষজ্ঞরা জানান, শুধু ফোন নম্বর বা মেসেজ নয়, ক্লোনিং দল মোবাইল ফোন থেকে ছবি, ভিডিওসহ যেকোনো নথিপত্র কপি করে ফেলতে পারে। তারা বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের হার বাড়ছে বলেই সিম ক্লোনিং বেড়েছে। ক্লোনিং দলের টার্গেটে তারাই থাকেন, যারা নিয়মিত ফোনের মাধ্যমে টাকা পাঠান।