লেবার দলের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ:
পারবেন কি স্যার স্টারমার সামাল দিতে?
দীর্ঘ ১৪ বছর অপেক্ষার পর এক ‘ঐতিহাসিক ভূমিধস নির্বাচনের‘ মধ্য দিয়ে বৃটেনের ক্ষমতায় ফিরে এলো লেবার পার্টি। লেবার পার্টির জয় হবে সেটি অনেক আগ থেকেই অনুমান করা হয়েছিল। কিন্তু লেবার পার্টির এমন বড়–জয় বোধ করি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও আশা করেননি। লেবার দলের এই যে আশাতীত সাফল্য তার কৃতিত্ব কিন্তু দলীয় প্রধান স্যার কিয়ার স্টারমারের নয়। টাইম ম্যাগাজিন ‘লেবার ডেলিভার্ড এ ডিসাইসিভ ভিকট্রি ইন ব্রিটেন: নাউ কামস দি হার্ড পার্ট‘ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে চমৎকার এক মন্তব্য করেছে। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘নির্বাচনে বিরোধী দলের জয় হয় না। পরাজয় হয় সরকারি দলের‘। এর মধ্যে এই কথাটিই এই প্রতিবেদন বুঝাতে চেয়েছে যে জনগণ সরকারের ওপর কোন কারণে তিক্ত–বিরক্ত হয়ে পড়লে বিরোধী দলের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তখন জয়লাভ ঘটে বিরোধী দলের। কথাটা প্রায় ক্ষেত্রে সত্যি। সত্যি লেবার পার্টি ও এর নেতা স্যার কিয়ার স্টারমারের বেলায়ও। ব্রেক্সিট–পরবর্তী সময়ে টোরি (কনজারভেটিভ) দলের নড়বড়ে নেতৃত্ব, বার কয়েক নেতৃত্বের বদল, নড়বড়ে অর্থনীতি, জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, অভিবাসন সমস্যা, অপরাধ মাত্রার উর্ধ্বগতি– সব মিলিয়ে দলটির প্রতি সাধারণ জনগণ বেশ বিরক্ত ছিল। কনজারভেটিভ দলের নেতৃত্বের প্রতি জনগণ তাদের আস্থা রাখতে পারছিলেন না। অন্যদিকে, দলীয় প্রধান ভারতীয় বংশোদ্ভূত বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী ঋষি সুনাক নানা ধারায় বিভক্ত দলটিকে ঠিকমত নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। প্রধান মন্ত্রী হিসাবে তার জনপ্রিয়তাও তেমন একটি ছিলনা, ছিলনা তার টনি ব্লেয়ার কিংবা বরিস জনসনের মত ক্যারিশমা। এরই মধ্যে গত ২ মে যুক্তরাজ্যে যে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে টোরি পার্টি হতাশজনক ফলাফল করে। ঋষি সুনাকের গদি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ভরাডুবি নিশ্চিত জেনেও তিনি আগাম–জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন। জনগন তাকে ও তার দলকে প্রত্যাখ্যান করেন। ঋষি সুনাক এমন এক কট্টর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করেছিলেন যা খোদ ইংরেজ রাজা চালর্স তাকে ‘ভয়াবহ‘ বলে অভিহিত করেছিলেন। এই অমানবিক আইনের ফলে বৈধ ডকুমেন্ট ছাড়া ব্রিটেনে বসবাসরত ও ব্রিটেনের দিকে অবৈধ পথে ধেঁয়ে অভিবাসীদের জোর করে রুয়ান্ডায় ক্যাম্পে পাঠানো শুরু করে সুনাক সরকার, যা বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনগুলি নিন্দা করে।
দুই. ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্থ আয়ারল্যান্ড মিলিয়ে গোটা দেশে মোট আসন সংখ্যা ৬৫০। এর মধ্যে লেবার পার্টি শতকরা ৩৫% ভোট পেয়ে মোট ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৪১২টি অর্জন করে। অন্যদিকে টোরি দল শতকরা ২৪% ভোট পেয়ে আসন লাভ করে ১২১টি। লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পেয়েছে ৭১টি আসন (১২% ভোট), রিফর্ম ইউ কে ও গ্রিন পার্টি ৪টি করে আসন লাভ করে, স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি পেয়েছে ৯টি আসন। সিন্ ফেন ৭ টি আসন। জয়ী হয়ে ব্রিটেনের ৫৮তম প্রধান মন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, সময় এসেছে পরিবর্তনের। তবে এই পরিবর্তন সহজে ও সহসা আসবে তা নয়। জনগণ আমার ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন। দেশকে পুনরায় নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্যে, রাজনীতিতে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে বলে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন। তবে নতুন প্রধান মন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সামনের দিনগুলিতে রয়েছে চ্যালেঞ্জ। ব্রিটেনের থিংক ট্যাংক, ব্রিটিশ ফিউচারের এক পরিচালকের মতে, ‘স্টারমার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন একটি ‘উদ্বিগ্ন, ভগ্ন, কিছুটা বিধ্বস্ত এবং ক্লান্ত একটি দেশ‘। তার সামনে দেশের অর্থনীতি, ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান অভিবাসী সমস্যা যা মোকাবেলা করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।
তিন. ঋষি সুনাককে প্রধান মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছে। দলীয় প্রধানের আসন ছাড়বেন কিনা কিংবা ছাড়তে বাধ্য হবেন কিনা সেটি এখনো জানা না গেলেও অনুমান করা হচ্ছে তিনি দলীয় প্রধানের আসন থেকে নিজেই সরে দাঁড়াবেন। ইতিমধ্যে দলের পরাজয়ের পর তিনি তা মেনে নিয়ে জনগণের কাছে ‘ক্ষমা‘ চেয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল থেকে টোরি পার্টিকে এখন আসন নিতে হবে বিরোধী বেঞ্চে। এদিকে লেবার পার্টিকে ভোটের আগে জনগণকে দেয়া ‘পরিবর্তনের প্রতুশ্রুতি‘ নিয়ে তাদের কাজ করতে হবে, যা শুরুতেই বলেছি খুব একটা সহজ হবেনা। মূল ইউরোপের সাথে তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে তারা মনোযোগী হবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। আগেই উল্লেখ করেছি, ঋষি সুনাকের চাইতে স্যার স্টারমার অনেক বেশি জনপ্রিয় হলেও লেবার দলীয় টনি ব্লেয়ার বা টোরি পার্টির বরিস জনসনের যে ‘অনুমোদন রেইটিং‘ বা ‘এপ্রোভাল রেইটিং‘ ছিল, তার থেকে অনেক পিছিয়ে। ব্লেয়ার কিংবা বরিস জনসনের যে ক্যারিশমা ও নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষমতা তার কোনোটাই তার (স্টারমার্ক) নেই। ২০১৯ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টি যে ভোট পেয়েছিল তার চাইতে এবার লেবার পার্টি স্টারমারের নেতৃত্বে ভোট কিছু বেশি পেয়েছে, যদিও বা আসন অনুপাতে অনেক বেশি অর্জন করেছে। ২০১৭ সালে জেরেমি করবিন যে সংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন, সে তুলনায় এবার স্টারমার কম পেয়েছেন। সে নির্বাচনেও লেবার দল পরাজয় বরন করে। বলা হচ্ছে পপুলিস্ট ‘রিফর্ম ইউ কে‘-র কারণে টোরি দলের অনেক ভোট ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এই বলে তাদের অভিমত প্রকাশ করেন যে, লেবারের যে জয় তা ভঙ্গুর। অতএব এটি অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, স্যার স্টারমার সরকার পরিচালনায় রক্ষণশীলদের পাশাপাশি রিফর্ম পার্টি দ্বারাও প্রতিরোধ ও বাধার সম্মুখীন হবেন। তার পূর্বসূরি করবিন যাকে দল এক সময় বহিষ্কার করেছিল এবং যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে এবারের নির্বাচনে ইসলিংটন নর্থ থেকে জয়ী হয়ে এসেছেন তিনিও সচেষ্ট থাকবেন নতুন প্রধান মন্ত্রী লেবার লিডার স্যার স্টারমারের কাজকে কঠিন করে তোলার জন্যে। স্টারমারও ছাড় দেয়ার নয়। জয়ী হবার পর তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে জয় আকাশ থেকে পড়েনা। কঠিন যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে একে জয় করে নিতে হয়।‘
চার. টোরি দলের নেতৃত্বে এবারের মত পরাজয় আর দেখা যায়নি। দলের বাঘা বাঘা নেতা ও মন্ত্রীরা ‘ডোমিনোর‘ মত একটির পর একটি তাদের আসন হারিয়েছেন। এমন কী প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী লিজ ট্রাস তার অনেকটা নিশ্চিত আসন হারিয়েছেন। তার পরাজয়ের পর তিনি কথা বলতে অস্বীকার করেন এবং নীরবে মঞ্চ ত্যাগ করেন। আসন হারিয়েছেন দলের নেতা পেনি মোরডেন্ট, জেকব রিস–মগ, রবার্ট বাকল্যান্ড, আলোচক। ভুতপূর্ব চ্যান্সেলর জেরেমি হান্ট কোনভাবে তার আসন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। এই নির্বাচনের আগে বিগত এক শতকে মাত্র তিনজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী তাদের আসন হারিয়েছিলেন এবং তারা সবাই ছিলেন লিবারেল ডেমোক্র্যাক্ট দলের। তারা তখন টোরি পার্টির সাথে কোয়ালিশন সরকারের অংশ নিয়েছিলেন। নির্বাচনের এই ফলাফলের পর টোরি দলের অভ্যন্তরে এখন অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছে। দলের এই ভরাডুবির জন্যে তাদের কেউ কেউ দলের নেতৃত্ব দায়ী বলে জানান। দলকে বাঁচাতে ইতিমধ্যে নেতৃত্বে বদলের কথা উঠেছে। ইতিমধ্যে কয়েক আইনপ্রণেতা দলের নেতৃত্বের জন্যে তাদের অভিলাষের কথা প্রকাশ করেছেন। দলের মধ্যে ইতিমধ্যে দুটি ধারা– একটি পপুলিস্ট ব্লক, অন্যটি মডারেট ব্লক। পপুলিস্ট ব্লক অভিবাসী ইস্যুতে কট্টর সমালোচক, অন্যদিকে মডারেট ব্লক ‘ওয়ান–নেশন‘ এই থিয়োরিতে ফিরে যেতে চায়। হার্ডলাইনার হিসাবে পরিচিত ভূতপূর্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারমান এক বক্তৃতায় বলেন, ‘কনজারভেটিভ পার্টি আপনাদের হতাশ করেছে। আপনারা–গ্রেট ব্রিটিশ জনগণ– ১৪ বছর ধরে আমাদের ভোট দিয়ে এসেছেন, কিন্তু আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি। আমরা এমনভাবে কাজ করেছি যেন আপনাদের ভোট আমাদের অধিকার। এই পরাজয় থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, যদি না নেই, তাহলে আজকের রাতটি যেমন আমার দলের জন্যে খারাপ রাত, তেমনি সামনে আরো অনেক খারাপ রাত আসবে। এখন প্রশ্ন– টোরি দলের নেতারা কি পারবেন তাদের এই অবিশ্বাস্য পরাজয় থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে? পারবেন কি তারা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া জনগণকে পুনরায় তাদের দিকে টানতে? কার হাতে যাবে দলের নতুন নেতৃত্ব? অন্যদিকে, লেবার দলীয় নেতা স্যার স্টারমার কি পারবেন তার দলের এই অবিশ্বাস্য জয়কে ধরে রাখতে? নির্বাচন–প্রচারাভিযান সময় জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানা বা দেখার জন্য আমাদের আরো অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট