কয়েকদিন ধরে একটানা হালকা ও মাঝারি বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। আবহাওয়ার সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে–দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় চট্টগ্রামেও লাগাতার ভারি বর্ষণ এবং ভূমিধস হতে পারে। এই খবরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে কক্সবাজারের চকরিয়ায় পাহাড়ের টিলা ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী কয়েক হাজার পরিবারের মাঝে। এ অবস্থায় বসতবাড়ি ফেলে অন্যত্র যেতেও অনীহা প্রকাশ করেছেন তারা। এছাড়া, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নিতেও প্রশাসনের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। ভূমিধসের আশঙ্কায় মৃত্যুঝুঁকি থাকলেও নিরাপদ আশ্রয়ে না যাওয়ার কারণ কী–জানতে চাইলে উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের উচিতারবিল গ্রামের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা আজাদীকে জানান, জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে উপকূলীয় এলাকা ছেড়ে এখানে বসতি স্থাপন করেছেন। তাদের আর কোথাও আশ্রয় নেওয়ার জায়গা অবশিষ্ট নেই। তাই মৃত্যুঝুঁকি থাকলেও পাহাড়েই বসবাস করবেন তারা। তবে পরিবার সদস্যদের নিয়ে তারা বেশ সতর্কই আছেন বলে জানান।
জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে প্রায় ১০ হাজার পরিবার মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের টিলা ও পাদদেশে বসবাস করছেন। সুরাজপুর–মানিকপুর ইউনিয়নের ভিলেজার পাড়ার, উত্তর মানিকপুর, মানিকপুর, বমুবিলছড়ির ফাদুখোলা, ছোট বমুসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা, বরইতলী ইউনিয়নের মোহছেনিয়া কাটা, বানিয়ারছড়া, মাহমুদনগর, পাহাড়তলী, ভিলেজার পাড়া, মহেশখালীয়া পাড়া, পহরচাঁদা, পূর্ব বরইতলী, হারবাং ইউনিয়নের মুসলিমপাড়া, শান্তিনগর, ফইজ্যার ডেবা, লম্বা ঘোনা, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ইসলামনগর, কাকারা ইউনিয়নের শাহওমর নগর, বার আউলিয়ানগর, পাহাড়তলী, খুটাখালী ইউনিয়নের মেদাকচ্ছপিয়া, নয়াপাড়া, সেগুনবাগিচা, ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ডুমখালী, মালুমঘাট, চা–বাগান, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের উচিতারবিল, নোয়াপাড়া, রিংভ ছগিরশাহ কাটা, সাইরাখালী, বিএমচর ইউনিয়নের পাহাড়িখালী পাড়ার অধিকাংশ এলাকায় অন্তত ৫০ হাজার মানুষ ঝুঁকিতে বসবাস করছেন। ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে এসব মানুষ সংরক্ষিত বনের ভেতর বনভূমি অবৈধভাবে দখলে নিয়ে বসবাস করে আসলেও তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কোন ধরনের তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সম্প্রতি টানা বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসের চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন তারা।
কঙবাজার উত্তর বন বিভাগ সূত্র জানায়, চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের পাঁচটি বনবিট এবং ফুলছড়ি রেঞ্জের সংরক্ষিত বনের ভেতর অন্তত ১০ হাজার পরিবার অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করে বসবাস করছে। তন্মধ্যে চরম মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় দুই হাজার পরিবারের অন্তত ১০ হাজার মানুষ। একইভাবে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের চুনতি রেঞ্জের আওতাধীন হারবাং ও বরইতলী এলাকায়ও কয়েকশত পরিবার মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের টিলা ও পাদদেশে বসবাস করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বনবিভাগের এক কর্মকর্তা আজাদীকে বলেন, লাগাতার ভারি বর্ষণ ও ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঝুঁকি থাকলেও বনের ভেতরকার এসব অবৈধ দখলদার নিজেরা সরছেন না। তবে বনের ভেতর থেকে এসব পরিবারকে উচ্ছেদে প্রশাসন উদ্যোগ নিলে বনবিভাগ সকল ধরনের সহায়তা দিয়ে যাবে।
সুরাজপুর–মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা পাহাড়বেষ্টিত। পাহাড়ের টিলা ও পাদদেশে বসবাসকারী পরিবারগুলোর সিংগভাগ হতদরিদ্র শ্রেণির। জলবায়ু উদ্বাস্তু এসব দরিদ্র পরিবার মৃত্যুঝুঁকি থাকলেও পাহাড়েই বসবাস করছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আবহাওয়ার সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, ভারী বর্ষণ ও ভূমিধস হতে পারে। এই বার্তা পাওয়ার পর আমার ইউনিয়নে পাহাড়ে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে নিরাপদে আশ্রয় নিতে এবং সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন বলেন, আমার ইউনিয়নের উচিতারবিল, নোয়াপাড়া, মুসলিমনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় চরম ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের টিলা ও পাদদেশে বসবাস করছেন হাজারো পরিবার। ভারি বর্ষণ ও ভূমিধসের আশঙ্কার বিষয়টি জানিয়ে এসব পরিবারকে ইতোমধ্যে সর্তক করে দেওয়া হলেও তারা কানে নিচ্ছেন না।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, যেসব ইউনিয়নে পাহাড় রয়েছে, সেই পাহাড়ের টিলা বা পাদদেশে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে সচেতন করা হচ্ছে। এজন্য স্ব স্ব ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১২ বছরে বর্ষাকালে চকরিয়া উপজেলার হারবাং, খুটাখালীসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন এবং পাশ্ববর্তী লামার ফাইতং ইউনিয়নে পাহাড় ধসে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এবারের বর্ষায় যাতে কোন প্রাণহানি না ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সচেতন লোকজন প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।