নগরের বাকলিয়া চেয়ারম্যানঘাটা এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া। জটিল রোগে আক্রান্ত তিনি। তাই কয়েকদিন পর পর চিকিৎসকের কাছে যেতে হয় তাকে। ওই এলাকার আবদুল লতিফ হাটখোলা রোড হয়ে আসা–যাওয়া করেন তিনি। চলতি বর্ষা মৌসুমে কয়েক দফা বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে বৃহত্তর বাকলিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি। ইট–বিটুমিন উঠে গিয়ে সড়কে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। এ সড়কের কয়েক জায়গায় পানিও জমে আছে।
হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া আজাদীকে বলেন, হাটখোলা রোড দিয়ে সিএনজিতে করে যখন ডাক্তারের কাছে যাই তখন আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ি। রাস্তা ভাঙা হওয়ায় প্রচুর ঝাঁকুনি খেতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে সড়কটির জন্য এলাকাবাসীর সীমাহীন কষ্ট হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাকলিয়া আবদুল লতিফ হাটখোলা সড়ক ছাড়াও শহরে প্রতিটি ওয়ার্ডে অসংখ্য রাস্তা চলতি বর্ষার ভারী বর্ষণে নষ্ট হয়েছে। যা উঠে আসে নগরের সড়ক রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রকৌশল বিভাগের প্রতিবেদনেও। গত বৃহস্পতিবার প্রস্তুতকৃত ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নগরের ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৬টি ওয়ার্ডে ১ লক্ষ ২১ হাজার ৮১৪ বর্গমটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ বর্ষায়। নষ্ট হওয়া সড়কের প্রস্থ ১০ ফুট ধরলে ক্ষতির পরিমাণ হবে প্রায় ৪২ কিলোমিটার। অর্থাৎ চলতি বর্ষায় এখন পর্যন্ত শহরের ৪২ কিলোমিটার সড়ক নষ্ট হয়েছে। পুরো শহরকে ৬টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রস্তুতকৃত ওই তালিকা অনুযায়ী, ১নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী, ৩নং পাঁচলাইশ, ৩৬ নং গোসাইলডাঙ্গা, ২৬নং উত্তর হালিশহর এবং ৩৭নং মধ্য হালিশহর; এই পাঁচ ওয়ার্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক নেই। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ২ নম্বর অঞ্চলের অধীন ৫নং মোহরা ওয়ার্ডে। যার পরিমাণ ২৫ হাজার ৯৭৪ বর্গমিটার। এছাড়া ৪নং অঞ্চলের অধীন দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে সবচেয়ে কম ৪১ দশমিক ৮২ বর্গমিটার সড়ক ক্ষতি হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী শাহীন–উল–ইসলাম আজাদীকে বলেন, বৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়া সড়ক সংস্কারে ইতোমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। কিছু সড়ক কর্পোরেশনের নিজস্ব অ্যাসপল্ট প্ল্যান্টে তৈরি মিঙার দিয়ে মেরামত করা হবে। কিছু সড়ক চলমান আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় মেরামত করা হবে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের কাজ দ্রুত শুরু করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শহরের প্রধান সড়কগুলো মোটামুটি ভাল আছে।
এদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে নগরের বিভিন্ন সড়ক পরিদর্শনে দেখা গেছে, শহরের প্রধান সড়কগুলো তুলনামূলকভাবে ভাল আছে। কিছু জায়গায় নষ্ট হলেও তা দ্রুত মেরামত করে ফেলছে চসিক। তবে বেশি বেহাল রয়েছে ওয়ার্ডের অভ্যন্তরীণ বা অলিগলির সড়ক। ক্ষতি হওয়া সড়কগুলোর বিটুমিন, ইট, বালি ওঠে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট–বড় গর্ত। এতে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় দেখা গেছে, সৃষ্ট গর্তের অধিকাংশে জমে আছে পানি। দূর থেকে মনে হয় মিনি পুকুর। এসব গর্তে আটকে যাচ্ছে বিভিন্ন যানবাহনও। এসব গর্তও যান চলাচলে বাড়াচ্ছে ভোগান্তি। একইসঙ্গে দুর্ঘটনার শঙ্কা বাড়ছে।
গতকাল পূর্ব বাকলিয়া ওর্য়াড বড় মৌলভীবাড়ি সড়ক, মিয়াখান নগর সড়ক, কালামিয়া বাজার সড়ক, নগরে বাওয়া স্কুলের সামনেসহ বিভিন্ন সড়কে বেহল দশা দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় দুই প্রভাবশালী নেতার দ্বন্দ্বে মৌলভীবাড়ি সড়কের উন্নয়ন কাজ থমকে আছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।
বাওয়া স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রানা আজাদীকে বলেন, প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী এবং অভিভাবককে স্কুলে আসতে হয়। সড়ক ভাঙা থাকায় চরম ভোগান্তি হচ্ছে সবার।
এদিকে গত সপ্তাহে নগরের স্ট্র্যান্ড রোড, হালিশহর ওয়াপদা এলাকা, বড়পোল, নন্দনকানন অর্পণাচরণ সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে এবং ২ নম্বর গেট এলাকার শেখ ফরিদ (রহ.) মসজিদ রোডটিসহ কয়েকটি এলাকায় সড়ক ভাঙা দেখা গেছে। এর মধ্যে কিছু কিছু সড়কে ইতোমধ্যে ইট, ইটের খোয়া ও বালি দিয়ে মেরামত করা হয়েছে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, নগরে পিচঢালা সড়ক রয়েছে এক হাজার ৪৫০টি। যার দৈর্ঘ্য ৯২০ কিলোমিটার। এসব সড়কের গড় প্রস্থ ৭ দশমিক ২ মিটার। এছাড়া দেড় হাজারটি কংক্রিটের সড়ক রয়েছে। ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এসব সড়কের গড় প্রস্থ ৩ দশমিক ৬৬ মিটার। এর বাইরে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৩টি কাঁচা সড়ক রয়েছে নগরে।
জানা গেছে, প্রতিবছর বর্ষায় শহরের সড়কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকৌশলীরা বলছেন, বিটুমিন রয়েছে এমন সড়ক নষ্ট হওয়ার প্রধান কারণ পানি। বলা যায় বিটুমিনের শত্রু পানি। কোনো কারণে সড়কে পানি জমে থাকলে এবং এর ওপর দিয়ে ভারী গাড়ি চলাচল করলে সড়ক দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
চসিকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর (২০২৩) ভারী বৃষ্টিতে ৫০ দশমিক ৭১ কিলোমিটার সড়ক নষ্ট হয়। এর আগে ২০২২ সালে প্রায় ১০০ কিলোমিটার, ২০২১ সালে ৩৬ দশমিক ২৭ কিলোমিটার এবং ২০২০ সালে ১৭০ কিলোমিটার সড়ক নষ্ট হয়। এছাড়া গত ৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক নষ্ট হয়েছিল ২০১৭ সালে; যার পরিমাণ ৩০০ কিলোমিটার।
জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশন নিজস্ব অ্যাসপল্ট প্ল্যান্ট থেকে তৈরি মিঙার (ইট, বালি, সিমেন্টে, বিটুমিনের মিশ্রণ) দিয়ে বর্ষায় ক্ষতি হওয়া সড়কের ছোট ছোট গর্ত ভরাট করে থাকে। সংস্থাটির ভাষায় এটি প্যাঁচওয়ার্ক। চলতি ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরে প্যাঁচওয়ার্কের মালামাল ক্রয়ে ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হযেছে। গত ২০২৩–২০২৪ অর্থবছরে ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও খরচ হয় ১৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। ওই বছর প্রকল্পের আওতায় সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হয় বেশি। তাই প্যাঁচওয়ার্কে কম খরচ হয়।