চট্টগ্রামে কয়েকটি এলাকা ছিল, সন্ধ্যা নামলে যানজট লাগত। রিকশা থেকে নামছে–উঠছে নানান বয়সের ছেলে–মেয়ে। কারো সঙ্গে অভিভাবক আছে। কেউ আসছে একা। কারো হাতে বাদ্যযন্ত্র। কারো পায়ে নুপুর। সন্ধ্যায় এমন দৃশ্য দেখতাম সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে। কুড়িটির অধিক সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০হাজার। স্বাধীনতার পূর্বসময়ে সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল পাঁচটি।
করোটির ভেতর ঘুমিয়ে থাকা সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্মৃতি জাগাতে গিয়ে স্মরণে আসে সিনেমা প্যালেসের মোড়ে আর্য্য সংগীত ভাঙ্গ–চুড়ের ঘটনা। এখনও ভেতরটা দুমড়ে–মুচড়ে দেয়। সেদিন আর্য্য সংগীতের অফিস–মহড়াকক্ষ গুঁড়িয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করেছিল। তবলা–হারমোনিয়াম–নুপুর–সেতার–দোতারা–খঞ্জনি লুট করল। চর–চাক্তাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক প্রয়াত প্রভাস রজ্ঞন চৌধুরীর এক ভাগ্নে সেদিন এক জোড়া তবলা নিয়ে বাসায় ঢুকেছিল। তিনি সে ভাগ্নেকে বের করে দিয়েছিলেন। কোনোদিন তাঁর বাসায় আর না আসতেও বলেছিলেন। আমরা অক্ষমরা রুখতেও পারিনি। প্রতিবাদও করিনি। সবাই প্রতিবাদী হলে আর্য্য সংগীত হয়ত স্ব–ভূমিতে শত বছরের স্মৃতি বহন করে বেঁচে থাকত।
হাজারী লেইনের একটি ভাড়া বাড়িতে ১৯০৬ সালে আর্য্য সংগীত প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ত্রিপুরা চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক যোগেন্দ্রলাল দত্ত। সংগীতাচার্য সুরেন্দ্রলাল দাস আর্য্য সংগীতের সঙ্গে যুক্ত হলে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। তিনি ঠাকুরদা নামে পরিচিত ছিলেন। সংগীতাচার্য সুরেন্দ্রলাল দাসের পিতা ছিলেন বিশিষ্ট কীর্তনিয়া চট্টগ্রামের জমিদার প্রাণহরি দাস। সংগীতাচার্য সুরেন্দ্রলাল দাসও অনেক গুণীজন ছিলেন। ৬০টির বেশি রাগে অক্রেস্ট্রা সৃষ্টি করেছিলেন। অক্রেস্ট্রায় ব্যবহারের জন্য নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন। সংস্কৃত ছন্দকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করে নানান সুর–তালে সাজিয়ে অক্রেস্ট্রায় ব্যবহার করেছেন। বই লিখেছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে এসেছিলেন নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ী, নৃত্যাচার্য উদয়শঙ্কর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ প্রমুখ। আর্য্য সংগীত মাঠে স্থায়ী মঞ্চ নির্মাণের জন্য আবদুল হক দোভাষ বাঁশের মঞ্চ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। শরৎ কানুনগো পরে ওটা পাকা করেছিলেন। রেঙ্গুন, আকিয়াব, কোলকাতায় আর্য্য সংগীতের শাখা ছিল। ড. সুরেশ চক্রবর্তী অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করতে কোলকাতা থেকে এসেছিলেন। তাঁর পরে অধ্যক্ষ হয়েছেন ওস্তাদ ফজলুল হক, প্রিয়দারঞ্জন সেনগুপ্ত, জগদানন্দ বড়ুয়া, দেবব্রত ভট্টাচার্য, নীরদ বরণ বড়ুয়া, মিহির লালা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের বোমা হামলার কারণে আর্য্য সংগীতের ক্লাস ধলঘাট, কেলিশহর, ধোরলা, কানুনগোপাড়া স্থানান্তর হয়েছিল। কানুনগোপাড়ার নীরেন্দ্রলাল দত্ত (খোকাবাবু) আর্য্য সংগীতের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে আমরাও একধরনের সম্পৃক্ততা অনুভব করতাম।
সংগীত পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৯ সালে। তখন ছিল নন্দনকাননে। ১৯৪৮ সালে এনায়েত বাজারে স্থানান্তরিত হয়। গঙ্গাপদ আচার্য, শ্রীপদ আচার্য, গোপাল দাশগুপ্ত প্রমুখরা আর্য্য সংগীত থেকে বেরিয়ে জমিদার ক্ষীরোদচন্দ্র রায়কে নিয়ে সংগীত পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। দেশভাগের পর আচার্য ভ্রাত্বদ্বয় ভারতে চলে যান। হাল ধরলেন শিবশঙ্কর মিত্র। তিনি চমৎকার পাখোয়াজ বাজাতেন। তাঁর সঙ্গী হলেন সৌরীন্দ্রলাল দাশগুপ্ত (চুলুবাবু)। ক্রমে যুক্ত হলেন জুনু মিয়া, সুলতান আহমদ চৌধুরী, আলিমুল্লাহ চৌধুরী, বিনোদবিহারী চৌধুরী, এস.পি. তালুকদার প্রমুখ। অধ্যক্ষ হিসেবে চুলুবাবু দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। চুনীলাল সেন ছিলেন উপাধ্যক্ষ। সংগীত শিক্ষক হিসেবে আরও ছিলেন আবুল হোসেন খান, মলয় ঘোষ দস্তিদার, হারিস উদ্দিন প্রমুখ।
আগ্রাবাদ ব্যাংক কলোনিতে শিল্পী অনিল মিত্র ১৯৫২ সালে প্রাচ্য ছন্দ গীতিকা নামে একটি সংগীত প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এটি কুসুমকুমারী বিদ্যালয়ে স্থানান্তর হয়। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে তাসের দেশ মঞ্চায়ন করে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিল। একই বছর ওস্তাদ জগদানন্দ বড়ুয়া জামালখান লিচু বাগানে প্রতিষ্ঠা করলেন চিটাগাং মিউজিক ক্লাব। তাঁরা সেন্টপ্লাসিডস চার্চের শত বার্ষিকীতে কার্ডিনাল বাদনসহ চার হাজার পাদ্রির উপস্থিতিতে ওয়েস্টার্ন মিউজিক ও পাকিস্তানি কনর্সাট করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।
আর্য্য সংগীতের অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে ওস্তাদ প্রিয়দারঞ্জন সেনগুপ্ত ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন সংগীত ভবন। প্রবর্তক বিদ্যাপীঠে পারিবারিক পরিবেশে সংগীত ভবনের সংগীত শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করেন। প্রিয়দারঞ্জন সেনগুপ্তের অবর্তমানে পারিবারিক কলহের প্রভাব পড়ে সংগীত ভবনের উপর। ১৯৯৫ সালে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। এক অংশের অধ্যক্ষ হলেন পূরবী সেনগুপ্তা। অপরাংশের অধ্যক্ষ হলেন কাবেরী সেনগুপ্তা। পূরবী সেনগুপ্তা প্রবর্তক বিদ্যাপীঠে, কাবেরী সেনগুপ্তা বাওয়া স্কুলে কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন।
আলাউদ্দিন ললিত কলা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে। নৃত্যগুরু রুনু বিশ্বাস আলাউদ্দিনের প্রাণপুরুষ ছিলেন। ঘাটফরহাদবেগে নৃত্যগুরু রুনু বিশ্বাসের বাসায় আলাউদ্দিনের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তিনি কবিরাজ বিল্ডিং–এ স্থানান্তরিত হলে আলাউদ্দিনের কার্যক্রম ওখানে স্থানান্তরিত হয়। আলাউদ্দিন চট্টগ্রামে নৃত্য শিক্ষার জন্য প্রশংসীত ছিল। নৃত্যগুরু রুনু বিশ্বাস অসুস্থ হলে তাঁর কন্যা জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী কৃষ্ণা বিশ্বাস আলাউদ্দিনের হাল ধরলেন। এখান থেকে অনেক বিখ্যাত নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়েছিল। নৃত্যগুরু রুনু বিশ্বাস বিদ্রোহী, রানার একক নৃত্যনাট্যের জন্য অমর হয়ে আছেন। আমার বাবার সঙ্গে রুনু বিশ্বাসের বন্ধুত্ব ছিল। পরবর্তীকালে অঞ্চলদা সাধারণ সম্পাদক হলে আলাউদ্দিনের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা বাড়ে। মুসলিম হলে আলাউদ্দিনের উৎসবে নানান প্রতিকূলতায় দেওয়ান মাকসুদ, অনুপ বিশ্বাস, এডভোকেট মৃদুল গুহসহ অনেকে সহযোগিতা করেছেন। সেদিনের কথা ভেবে আজও গর্ববোধ করি। সে উৎসবে মিলন চৌধুরীর নির্দেশনায় আমিনা সুন্দরী মঞ্চস্থ হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামে অনেক সংগীত প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো শিল্পীনিকেতন। শিল্পী অমল মিত্র ছিলেন শিল্পী নিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। এনায়েত বাজার বৌদ্ধ মন্দিরের উল্টোদিকে এর কার্যক্রম চলত। আমার বাবা মৃণাল কান্তি বল শিল্পীনিকেতনের বহু বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সময়ে শিল্পীনিকেতনের উদ্যোগে মুসলিম হলে শাপমোচন, চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থ হয়। তাঁরা চট্টগ্রামের বাইরেও অনেক অনুষ্ঠান করেছিলেন। শিল্পীনিকেতন সেতার, গিটার শিক্ষার জন্য নন্দিত ছিল। আমাদের বাড়িতে একারণে কিনা জানি না বাবার একটা সেতার ছিল। তবে বাবাকে বাজাতে দেখিনি। আমিও শিল্পীনিকেতনে গিটার ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম। বাবা ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। আর্য্য সংগীত ও সংগীত পরিষদের সঙ্গেও বাবা যুক্ত ছিলেন।
বঙ্গশ্রী শিল্পী সংসদ ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কোতয়ালির মোড়ে ষোড়শী কুঞ্জে। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন অরুণ দাশগুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মিহির কানুনগো। বঙ্গশ্রী’র কার্যক্রম কবিরাজ ভবন, পাথরঘাটা বংশাল রোডেও স্থানান্তর হয়। বঙ্গশ্রী’র সংগীত শিক্ষালয়ের নাম ছিল চুনীসেন সংগীত বিদ্যাপীঠ। আমাদের অঞ্চলদা বঙ্গশ্রী’রও সক্রিয় সদস্য ছিলেন। একই বছর শাশ্বত ললিতকলা একাডেমী নামে রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ড শিল্প কুটিরে আরেকটি সংগীত প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করে। শিল্পপতি এ কে খান এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
অগ্রণী সংঘ সংগীত শিক্ষা কেন্দ্র ১৯৭৫ সালে আত্মপ্রকাশ করে অমৃতাঙ্কুর সেন, প্রবাল চৌধুরী প্রমুখের উদ্যোগে। প্রদীপ দেওয়ানজী নির্দেশিত অগ্রণীসংঘ নিবেদিত বাল্মীকি প্রতিভা চট্টগ্রামের অন্যতম সেরা রবীন্দ্রনাটক হিসেবে নন্দিত হয়। কুসুমকুমারী স্কুলে কার্যক্রম পরিচালিত হতো। অধ্যক্ষ ছিলেন ওস্তাদ মিহির নন্দী। তিনি ১৯৮০ প্রতিষ্ঠিত আনন্দধ্বনি’রও অধ্যক্ষ ছিলেন। এটা ছাড়াও ফুলকীতে তানসেন নামে শিশুদের সংগীত শিক্ষার আরও একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এটার অধ্যক্ষ শীলা মোমেন। ফুলকীর শাখা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হতো।
আলাউদ্দিন একাডেমী, নির্মলেন্দু চৌধরী পরিচালিত সুরতীর্থ, পূরবী সরকার পরিচালিত সানি টিউটোরিয়াল সংগীত বিদ্যালয়, ছন্দ নিকেতন, চট্টগ্রাম ললিতকলা একাডেমী, সপ্তক, সুরসপ্তক, ইমন ললিতকলা, চট্টগ্রাম সংগীত নিকেতনসহ আরও সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। চট্টগ্রাম সংগীত নিকেতনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন দীপেন চৌধুরী। দীপনেদা ধ্রুবপরিষদ নামে ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আরও একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওস্তাদ জগদানন্দ বড়ুয়া ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশে সংগীত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিত। এটাকে বলা হতো বেসরকারি সংগীত শিক্ষা বোর্ড। ধু্রবপরিষদ ১৯৮৯ সালে সার্সনরোডে বাংলাদেশ সংগীত মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। চট্টগ্রাম সংগীত মহাবিদ্যালয় ছিল এর শাখা। অধ্যক্ষ ছিলেন পরেশ কুরী। ধু্রবপরিষদ আয়োজিত জাতীয় সংগীত সম্মেলনে পরিবেশিত ওস্তাদ জগদানন্দ বড়ুয়া’র জলতরঙ্গের ঝংকার, বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের সংগীত আজও ভুলতে পারিনি।
উদীচী, চারণ, আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠীকে সংগীতের মাধ্যমে রাজপথ কাঁপাতে দেখেছি। সেন্টুদাকে দেখলেই বুঝতাম আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠী আছে। উদীচী মানেই মৃদুলদা, চন্দনদা, রবীণদা। অনেক সংগীত প্রতিষ্ঠানের নাম মনে পড়ছে। এদের সরব উপস্থিতি টের পেতাম ডিসি হিলে নববর্ষে কিংবা বিজয়মেলায়। সবার কথা লিখতে পারলে ভালো লাগত। এখনও কি সন্ধ্যা নামলে তেমনি করে যানজট লাগে? খুব জানতে ইচ্ছে করে।
তথ্যসূত্র : হাজার বছরের চট্টগ্রাম, দৈনিক আজাদী, ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা; বোধন শতবার্ষিকী অভিজ্ঞান, সম্পাদক সরোজ কুমার বল, প্রকাশক বান্ধব পাঠাাগার, চট্টগ্রাম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১২।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার