দারুচিনি দ্বীপের কিশোর এক কিশোর। নাম তার আবদুর রাজ্জাক। সত্তরের জলোচ্ছ্বাসে ভিটেমাটি সব হারানোর পর পাকিস্তানে পাড়ি জমায়। তখন পশ্চিম পাকিস্তান। কাজ জুটিয়ে নেয় কাঁচের এক কারখানায়। শ্রমিকের কাজ করে দিব্যি চলে যাচ্ছিল তার। কতোই বা বয়েস? ষোল কি সতেরো। কোনো এক ক্লান্ত দুপুরে দেখা এক কিশোরীর সঙ্গে। দুধে আলতা বরণ তার। সেই কিশোরীর বাবা মাও দিনবদলের আশায় বাংলা থেকে পাড়ি জমিয়েছিল পশ্চিমে। আবদুর রাজ্জাক নিজেকে হারিয়ে ফেলে সেই কিশোরীর চোখের তারায়। স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করে ওরা দু’জনে।
পূর্বে আগুন জ্বলছে। রক্ত ঝরছে। মাতৃভূমি তখন রণভূমি। অশরীরী কিছু যেন ডাক দিয়ে যায় আবদুর রাজ্জাককে। একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধে নেমেছে যারা, তাদের সাথে হাত মিলিয়ে অস্ত্র ধরার জন্য নিশপিশ করছে হাত দুটো। মন আনচান করে ওঠে তার কিশোরীর জন্যে। অকুতোভয় কিশোরী হাসিমুখে বিদায় জানায় তাকে। আকাশ–বাতাস, আর কোরাআন সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করে ওরা এই জনমে দেখা না পেলে অন্য কারও সঙ্গে ঘর বাঁধবে না ।
কিশোর রাজ্জাক বেরিয়ে পড়ে দেশের ডাকে। সরাসরি রণাঙ্গনে। চা বাগানের দেশে পাঠানো হয় তাকে। প্রথমদিকে বড় যোদ্ধাদের ফাই ফরমাশ খেটে দিন কাটতো তার। অল্পদিনে শিখে ফেলে সে কিভাবে অস্ত্র চালাতে হয়। রণক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর উপর। পাহাড়ে, বস্তিতে কতো রাত কাটে তার; অভুক্ত, নির্ঘুম। শত্রুপুরিতে আটকে পড়া কিশোরীর মুখটা ভেসে ভেসে উঠে মনের গহীনে। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অপূর্ব সুন্দর ছোট্ট দ্বীপের বাসিন্দা বাবা মা’র কথাও মনে পড়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে। সেই যে ওদের ফেলে এসেছিল আর সে বাড়িমুখো হতে পারেনি। আর কি তবে হবে দেখা প্রিয়মুখদের !
বরষা গেলো, শরৎ গেলো। হেমন্ত গিয়ে শীতও আসি আসি করছে। শত্রু দিনকে দিন হিংস্রতর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আনাচে কানাচে। আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে বঙ্গজননীর সর্বাঙ্গ। বিশ্বজুড়ে মাতম ওঠে– শেষ হোক এই অন্যায় যুদ্ধের। পরাশক্তিরা জুড়ে দেয় কূটনীতির খেল। রাজনীতির মারপ্যাঁচ। অবশেষে একদিন। শেষ হয় সকল খেলা। পতন হয় পিশাচের। ততোদিনে ঝরে গেছে তিরিশ লক্ষ প্রাণ। দেশটা হয়ে গেছে বধ্যভূমি। মৃত্যুপুরী যেন সমগ্র বদ্বীপ।
তবুও লাল সবুজের পতাকা হাতে ঘরে ফেরার দিন আসে কিশোর রাজ্জাকের। মাঠ ঘাট পাহাড় নদী পেরিয়ে জেলে নৌকায় চেপে বসে সে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেবার আশায়। সাগর তখন শান্ত। নদীর মতোন। ঝিকমিক করছে রূপোলী জলরাশি। গাঙচিলেরা পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় তাকে গহিন বালুচরে।
বাবা মা ভেবেছিলেন হারিয়ে গেছে তাঁদের খোকা; আর কোনদিন ফিরবেনা ঘরে। আবদুর রাজ্জাককে দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পান তাঁরা। কিন্তু আবদুর রাজ্জাকের চোখে অমাবস্যার অন্ধকার, বুকে বাজে উত্তাল বঙ্গোপসাগরের ঢেউ। কেমন করে খুঁজে পাবে সেই কিশোরীকে, যার হাত ধরে জীবনে মরণে একসাথে থাকার শপথ নিয়েছিল সে !
পিণ্ডির দেশে ঝড় ওঠে কিশোরীর বুকেও। কেমন করে বলে সে কথা বাবা–মাকে! দিন বদলের ফেরে কাজ খোয়ান বাবা। অতঃপর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেই সই। কিন্তু কোথা গিয়ে কেমন করে বসত গড়ি– ভাবনায় পড়ে যান বাবা। কিশোরীর ভাবনা জুড়ে দ্বীপের কথা। বেঁচে থাকলে নিশ্চয় সেখানেই আছে তার ভালোবাসার মানুষটা। দ্বীপের কথা মনে ধরে কিশোরীর বাবার। পিণ্ডির পাট চুকিয়ে সেই দ্বীপেই নৌকা ভেড়ান সপরিবারে। তারপর সব রূপকথা।
বর্ষার উন্মত্ত বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে নাফ নদীর ওপাড়ের গঞ্জে যায় যুবা পুরুষ রাজ্জাক। লাল শাড়ি, আলতা, ফিতা আর একটা সোনার নাকছাবির জন্য। শামুকের মালা, চুড়ি কানের দুলে সেজে, কদম কেয়ার গন্ধে মাখামাখি হয়ে, ঝিঁঝিঁ পোকাদের দেখিয়ে দেয়া পথ ধরে, আলতা রাঙা পায়ে মনের মানুষের ঘরে আসে কিশোরী। দেখতে দেখতে তিন কুড়ি বছর পার করে দেয় ওরা। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস কতোবার এলো গেলো! সাজানো ঘর, হাঁড়ি–কুঁড়ি ভেসে গেলো কতোবার! মাটি কামড়ে এই দ্বীপেই থেকে যায় ওরা। আবার বাড়ি তোলে আবদুর রাজ্জাক। আবার ঘর সাজায় সেই কিশোরী। স্বর্গ এসে ধরা দেয় ওদের ছোট্ট কুটিরে। দেবশিশুদের ছোট্ট ছোট্ট পায়ের মিষ্টি মিষ্টি আওয়াজে ভরে ওঠে ওদের ঘর, উঠোন, পুরো দ্বীপটাই।
দিনে দিনে কিশোর, যুবা হয়ে সমর্থ মানুষ হয়ে ওঠে শিশুগুলো। মাথায় রূপোলি চুলের আভা রাজ্জাক আর সেই কিশোরীর। প্রাণশক্তি তখনও অটুট, ভালোবাসা সীমাহীন। দুই জোড়া হাতের জায়গায় ওদের ঘরে এখন দশ জোড়া হাত। শাখা প্রশাখারা ঘিরে রাখে ওদের পরম মমতায়। তবুও ছুটি নেই তাঁদের। সত্তর পাড়ি দিয়েও কর্মিক আবদুর রাজ্জাক। ষাট পেরুনোর পরও রূপে গুনে জুড়ি মেলা ভার সেই কিশোরীর। বটবৃক্ষের মতো ছায়া হয়ে আছেন পরিবার আর দ্বীপের সবার মাথার ওপর।
ছোট ছেলের জন্য লাখ টাকা খরচা করে বউ এনেছেন গঞ্জ থেকে। ভারি মিষ্টি আর পয়মন্ত ছোট বউমাটি। বুদ্ধিতে শক্তিতে তার তুলনা হয় না। বড় বউমা দুটিও কম যায় না। বাণিজ্যের মৌসুমে সবাই মিলে হাল ধরে ভাজা মাছের ব্যবসার। দোকানের সাথে লাগোয়া বসতভিটা আবদুর রাজ্জাকের। বিশাল রান্নাঘরে কাঠ কয়লার উনুন জ্বলে, সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাত। অতিথিদের বাছাই করা তাজা মাছ কুটে বেছে, ধুয়ে মুছে, মসলায় সাজিয়ে ডুবো তেলে মুচমুচে করে ভেজে তাৎক্ষনিক পরিবেশনে জুড়ি নেই তাদের। দলবেঁধে কাজ করে ওরা সবাই। কেউ বাটনা বাটে, কেউ কুটনা কোটে, কেউ ধোয়, কেউ মুছে। হাত গুটিয়ে বসে থাকে না বুড়িও।
বুড়োর তেমন কিছু করার থাকে না তখন। তিনি আছেন সবখানে। সবকিছু দেখভাল করেন। নাতি নাতনিরা ঘুরঘুর করে তাঁর আশেপাশে। অতিথিদের সাথে সুখ–দুঃখের গল্প বলে সময় কাটান তিনি। তাঁর জীবনকাহিনী শুনিয়ে দেন কেউ আগ্রহ দেখালে। যুদ্ধদিনের কথা বলতে গেলে এখনও চকচক করে ওঠে চোখদুটো। ফিরে ফিরে যান কৈশোর আর যৌবনের আগুনঝরা দিনগুলোতে। যদিও সরকারি খাতায় নাম ওঠানোর কথা কোনদিন মনে আসেনি। ভাতা, পদক কিংবা স্বীকৃতিও মেলেনি কারও কাছ থেকে। এনিয়ে অহেতুক ভাবনা নেই আবদুর রাজ্জাকের। সেই কিশোরী বুড়ি হয়েও আছেন তাঁর পাশে পাশে। জীবন কেটে যায় জীবনের নিয়মে।
দ্বীপদেশে জীবন চলে ষড়ঋতুর খেয়ালে। গ্রীষ্ম বর্ষা শরতে থমকে থাকে ঘড়ির কাঁটা। সকাল দুপুর সন্ধ্যা হয় অলসভাবে। কারো কোনো তাড়া নেই। মায়েরাই সামাল দেন ঘর গেরস্থালি। হাঁস–মুরগি পালেন, সবজি লাগান, গরু ছাগল চরান, ছেলেমেয়েদের জন্য খাবার তৈরি করেন। বিদ্যালয় আছে এখানে; প্রাথমিক আর মাধ্যমিক, একটি করে। অল্প শিশুই ওমুখো হয়। মসজিদের বারান্দায় মক্তব বসে সাত সকালে। একযোগে বেজে ওঠে শিশুকণ্ঠ। কখনও মাছে ভাতে, কখনওবা নুনে ভাতে কেটে যায় কোনমতে। ভবিষ্যৎ নিয়ে অযথা ভাবনা নেই। স্বপ্নেরা ডানা মেলে না এখানে।
পথে মাঠে ঘাটে পুরুষ মানুষ দেখা যায় কালেভদ্রে। দিনশেষে বাবারা ঘরে ফেওে না। বসন্তের শেষে বঙ্গোপসাগর ফুঁসে ওঠার আগে সেই যে দ্বীপ ছেড়ে যায়, আর ফিরে আসে তারা হেমন্তের শেষে। তখন দ্বীপটা ভরে ওঠে অতিথি পাখিতে। দূষিত নগরের মানুষরা বিশুদ্ধ বাতাসে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবার আশায় জাহাজ ভেড়ায় এই দ্বীপে। তখন এখানে পা ফেলার জো থাকে না। অতিথিদের আপ্যায়ন করে দুটো বাড়তি পয়সা কামানোর সুযোগ আসে ওদের এই ক’মাসে। গ্রীষ্ম বর্ষা শরতে কোনো অতিথি থাকেনা। ওরা তাই গঞ্জে চলে যায়। কেউ কারখানায় কাজ নেয়, কেউবা হোটেলে। কেউ আবার গাড়ি চালায়, কেউ মাটি কাটে, মুটের কাজ নেয় কেউ কেউ, আবার কেউবা করে অন্য কিছু। পরিবারে সুদিন আনার আশায় দিনরাত খেটে মরে তারা।
আজকের গল্পের নায়ক আবদুর রাজ্জাকও এমনি করে বাড়ি ছাড়েন, যেদিন শেষ জাহাজটা দ্বীপ ছেড়ে যায় সেদিন। সঙ্গে যায় তার জোয়ান ছেলেরা। টেকনাফ শহরে মনোহারি দোকান আছে ওদের। মাস চারেকের জন্য ভাড়া দিয়ে এসেছিল। চৈত্রের শেষেই ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে দোকান বুঝে নেয় বাপ ব্যাটারা। দিন চলে তখন ঘড়ির কাঁটায়। একঘেয়েমিতে। বুড়ির জন্য আনচান করে আবদুর রাজ্জাকের মনটা। ডালপালা সব ঘিরে থাকে বুড়িকে। তাই কিছুটা নির্ভার। কপাল ভালো। মুঠোফোনের কল্যাণে এখন দুটো কথা বলা যায়। আগেতো চিঠিও পাঠানো যেতো না।
দিন শেষে রাত আসে। রাত শেষে দিন। এমনি করেই দিন যায়। মাস যায়। সাঁতরে চলে যেতে ইচ্ছে করে বুড়ির কাছে। বঙ্গোপসাগর অশান্ত। দুয়েকটা জেলে নৌকা দেখা যায়। ওরা যাত্রী নেয় না। কিন্তু ঈদ কোরবান এলে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনা বুড়োকে। জেলেদের হাতে পায়ে ধরে রাজি করায়। বুড়ি, বউমা আর নাতিদের জন্য নতুন কাপড় আর সেমাই, চিনি কিনে নিয়ে চেপে বসে জেলেনৌকায়। ঢেউ এর তোড়ে উল্টে যেতে চায় নৌকা; মনে হয় এক্ষুনি বুঝি ডুবে যাবে, হারিয়ে যাবে অতল সাগরে। কিন্তু ভেসে ভেসে ঠিকই পৌঁছে যায় ওরা। দ্বীপের কাছে, বুড়ির কাছে। বুড়োর মতো আরও অনেকে আসে, এমনি করে প্রাণটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে। বাবা চাচা দাদা, নানা মামাদের পায়ের আওয়াজে গম গম করে সেইন্টমার্টিন দ্বীপের মাটি। ঈদ এলে ঘুমন্ত দ্বীপটা যেন জেগে ওঠে। ঈদ শেষে আবার নীরব হয়ে যায় সমস্ত চরাচর। গিন্নিদের মনটা ভার হয়ে থাকে কিছুদিন। আস্তে আস্তে ফিরে আসে সব নিত্য রোজনামচায়। এমনই করে বছর ঘুরে দূর দ্বীপবাসীনিদের। আবদুর রাজ্জাকের প্রিয়তমারও।