দেশ হতে দেশান্তরে

বেইজিংয়ের ডিমরাজ্যে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৭ জুলাই, ২০২৪ at ৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ

স্ত্রীর আদালাতের ঘোষিত রায়ে বুঝতে পারলাম বিরাট ভুল করে ফেলেছি! আদালত অবমাননার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তারপর ভাবলাম আত্মপক্ষ সমর্থন করি। কারণ জান বাঁচানো ফরজ বলে কথা আছে না! মরিয়া হয়ে বললাম তাই সবগুলো আমি খেয়ে টেস্ট করে করে কিনেছি, খুবই মজার ওগুলো। সুইস চকলেট চায়না থেকে কিনে নিয়ে যাওয়ার তো মানে নাই। ওসবতো দেশেই পাওয়া যায়?

আচ্ছা, দাদা, তোর হাতের পোটলাগুলোতে যদি ক্যান্ডি আচারই থাকে, তবে বিকেলে যে গিফটগুলো কিনলাম সেগুলোর প্যাকেট তো তোর কাছে ছিল, সেগুলো কোথায়? আমি তো এতক্ষণ এগুলিকেই ওইগুলো মনে করেছিলাম।’

আত্মপক্ষ সমর্থন নিমিত্তে এইমাত্র দেয়া আমার মরিয়া জবাবের বিপরীতে মহামান্যা আদালত মুখ খোলার আগেই, হেলেন এ কথা বলে উঠতেই, এক্কেবারে যাকে বলে আঁতকে উঠা, তাই হল এ অধমের!

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে ভাবলাম, আরে তাই তো! গেল কই ঐগুলা?

হায়, হায়! তাইতো। ওইগুলি কোথায় ফেলে আসছো? হারিয়ে ফেলেছ নাকি? কোনও কিছুরই তো কখনো খেয়াল রাখতে পারো না! দেখো গিয়ে যেখান থেকে ক্যান্ডি, আচার কিনেছ ওইখানেই ফেলে এসেছ কী না ঐ গিফটগুলো।’

কপাল ভালো যে মহামান্যার এই ভর্ৎসনা ধন্বন্তরির মতো কাজ করলো! কারণ এসময় নিমিষেই মনে পড়লো, আরে ঐ প্যাকেটগুলোতো জমা রেখেছিলাম ঐ খেলনার দোকানের ঢোকার মুখে যে ক্রেতাদের হাতের ব্যাগপত্র জমা রাখার যে কাউন্টার আছে, ঐখানে! এ কথা মনে হতেই দ্রুত বা হাতের প্যাকেটটা দীপ্রর হাতে চালান করে দিয়েই প্যান্টের পেছনের পকেট হাতড়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম যে, আছে কী না সেই টোকেনটা, সহি সালামতে!

যাক! বাঁচা গেল। কালো কালিতে ইংরেজিতে ২৭ লেখা হলুদ রঙের গোল প্লাস্টিকের টোকেনটা পকেট থেকে বের করে চোখের সামনে ধরে নিশ্চিত হবার পিঠাপিঠিই কি না, এসময় দেখা দিল মন ছেয়ে গেল ঘনঘোর কৃষ্ণ মেঘে!

জাগলো ঘোরতর সন্দেহ জাগল মনে, আচ্ছা খোলা আছে কি এখনো খেলনার ঐ দোকান? তবে মুখ ফুটে তা না বলে মনের সেই আশঙ্কা মনেই পাথর চাপা দিয়ে তড়িঘড়ি করে বাকি প্যাকেটটা হেলেনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, দ্রুত এবাউট টার্ন হয়ে, দাঁড়াও যাচ্ছি ঐ প্যাকেট গুলো আনতে বলেই, কাউকেই আর কোনও কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত ধরলাম হাঁটা শ খানেক মিটার দূরের ঐ খেলনার দোকানের দিকে।

যতোই সামনে দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার, ঐ তো জ্বলছে আলো বিশাল ঐ খেলনার স্টোরে, তারপরও মনে ধুকপুক আশংকা আছে তো খোলা স্টোরটা? কারণ কথায় তো আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়! ভাবতে ভাবতে এরই মধ্যে ছোঁয়া ফোন পকেট থেকে বের করে পর্দায় যখন দেখলাম বাজছে ৭ টা ৫৬, তাতে আরেকটু সাহস পেলাম এই ভেবে যে, আর যাই হোক আটটার আগে তো নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে যাবার কথা নয় কোনও মার্কেট বা স্টোরের। তারপরও জোরে হাঁটা বাদ দিয়ে দিলাম বলতে গেলে স্টেশনে ঢোকার মুহূর্তে ট্রেন ছাড়ার হুইসেল বাজলে যেমন দেয় দৌড়, মানুষ ওইরকম এক দৌড়।

ফলে অচিরেই হাঁসফাঁস করতে করতে সেই কাউন্টারে হাজির হয়ে ঐখানে ডিউটিরত কাউন্টারকন্যাকে দেখতে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে দ্রুত তার হাতে আমার ঐ হলুদ চাকতিটি তুলে দিতেই, ধীরে সুস্থে সে যখন এগিয়ে গেল পেছনে রাখা অসংখ্য খোপ সমৃদ্ধ সেলফটির দিকে, কিছুটা আত্মস্থ হওয়ার সুযোগ পেয়ে, তাকালাম স্টোরের ভেতরের দিকে।

নাহ, এতো টেনশনের কোনও ব্যাপারই তো ছিল না দেখছি। এই হিমে বাইরে তেমন লোকজন না থাকলেও এই স্টোরে মনে হচ্ছে চলছে এখনো, চায়নিজ নতুন বান্দর বছর আগমন উপলক্ষে এক্কাবারে ধুন্দুমার না হলেও ভালোই কেনা বেচা। মোট কথা হল একটু আগে যেরকম উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ভুগছিলাম, ওই রকম উদ্বেগের কোনও কারণই ছিল না। মাঝখান থেকে খালি খালি ভুগ্লাম অযথা টেনশনে। সে যাক, এরই মধ্যে কাউন্টারকন্যা আমার প্যাকেটগুলো এনে কাউন্টারের উপর রাখতেই, তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ওগুলো নিয়ে দিলাম দ্রুত ঘুর হাঁটা।

এখন যে একদম টেনশনমুক্ত তা না। বরং বেশ বিজয়ী বিজয়ীভাবে হস্তচ্যুত হওয়া চায়নিজ স্যুভেনিরের ব্যাগগুলো কিছুমাত্র আগে হস্তগত হতেই ওগুলোকে দু হাতে ঝুলিয়ে স্টোর থেকে বেরুবার দরজায় এসে দাঁড়াতেই ‘বাবা, বাবা পেয়েছো ওগুলো? পেয়েছ ওগুলো’ বলতে বলতে দীপ্রকে এদিকে ছুটে আসতে দেখে বোঝা গেল, পুত্র আমার তার মায়ের কাছে এই বেচারা পিতার সম্ভাব্য নাকাল হওয়ার কথা চিন্তা করে সম্ভবত বেশ চিন্তায় ছিল এতক্ষণ! ফলে যেই না দু হাতে দুই ব্যাগ নিয়ে আমাকে বেরুতে দেখেছে, আনন্দ উত্তেজনায় দিয়েছে ও দৌড় এই দিকে। পুত্রের এই দৌড়ে এরই মধ্যে দলের বাকীরা সচকিত হয়ে এদিকে তাকাতেই তাদের সকলের উদ্দেশ্যে, ঐ যে বললাম বিজয়ী ভাব, সেই ভাব নিয়ে তুলে ধরলাম পলিথিনের ব্যাগ দুটো!

সপুত্রক অতপর দলের কাছে এসে কাউকেই আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, বললাম চল এবার তাহলে ফেরা যাক তবে হোটেলে। তোমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়েই তো আমাকে ফের বের হতে হবে কে এফ সি থেকে খাবার আনার জন্য।

আচ্ছা দাদা, ঐ যে কোণায় দুইটা বড় দোকান দেখা যাচ্ছে খোলা আছে, ওগুলো তো দেখা হয়নি। কী আছে ওখানে ওটা একটু দেখে আসি? আর তো আসবো না এখানে ’

আমিও তাই ভাবছিলাম।’

এ মুহূর্তে আবারো একদিকে যেমন দেখছি বিরল ধরনের ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে ননদ ও ভাবী। তদুপরি অন্যদিকে ‘আর তো আসবো না কোনওদিন এইখানে ’ এ তো এক অতি অকাট্য যুক্তি। এ আর কীভাবে এড়াই! এছাড়া দুজনের কথাতেই মনে হল, তাদের আজকের কেনাকাটার ব্যাপারটা এখনো কবিগুরুর দেয়া ছোট গল্পের সেই সংজ্ঞার মতো হয়ে আছে মানে শেষ হয়েও হইল না শেষ। এখন এই শেষ মুহূর্তে এসে এ নিয়ে আবার ভিন্নমত পোষণ করা, মোটেও নিরাপদ নয়। কারণ দিনটা তো আজ শপিং ডে। এছাড়া এ ক’দিন যে তাদেরকে শপিং থেকে বিরত রাখতে পেরেছিলাম সেটাই তো এক বিরাট অর্জন। অতএব এককথায় রাজি হয়ে গিয়ে বললাম, চল তাহলে যাই। খুব দেরী করা যাবে না কিন্তু

দাঁড়াও দাঁড়াও, এতোগুলো শপিংব্যাগ আর পোটলাপুঁটলি নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে কোনটা কোথায় যে হারিয়ে ফেলে কে, তা তো বলা যায় না। একটু আগেই তো যাচ্ছিল ঐ গিফটগুলো। এগুলো একটু গুছিয়ে নেই।’ বলেই লাজু দু পুত্র যে কূল বয় হয়ে ঘোরার জন্য সারাক্ষণ নিজেদের পিঠে শূন্য পিঠ ব্যাগ বেঁধে নিয়ে ঘুরছে, সেগুলো ওদের পিঠ থেকে নামিয়ে, ওগুলোতে একটু আগে কেনা ক্যান্ডির পোটলাগুলো আর এইমাত্র উদ্ধার করে আনা স্যুভেনিরের পোটলাগুলো ঢোকাতে লেগে যেতেই, কাষ্ঠ হাসি হেসে নিঃশব্দে উপেক্ষা করলাম আমার উদ্দেশ্যে দেয়া খোঁচাটা।

এদিকে পুত্ররা বিশেষত দীপ্র, তার পিঠব্যাগের ওজন বেড়ে যাওয়ায় সেটি পিঠে নিয়ে বহন করতে তার অসুবিধা হবে বলে গাই গুই করতেই, ইশারায় ওকে জানালাম, নো চিন্তা। ওটা আমি নেব, তুমি চুপ থাকো। তাতে ও নিজেকে সামলে নিল।

যেকোনও অবস্থাতেই সবকিছু সবসময় গোছগাছ করে রাখার ব্যাপারে অতি সচেতন লাজু অতপর তার মনমতো আজ বিকেল থেকে এ পর্যন্ত কেনা জিনিশপত্রের একটা হিল্লে করার পর, সদলবলে রওয়ানা করলাম এই চত্বরের আমাদের ঠিক উল্টো দিকের একদম ডান দিকের কোণার দোকানটার দিকে।

শ দেড়শ মিটার দূরের সেই দোকানে পৌঁছুতে খুব একটা সময় লাগলো না। এই চত্বরের চারদিক ঘিরে বেশিরভাগই বহুতল শপিং মল হলেও, আছে এখানে বেশ কটা একতলা দালানও। তার মধ্যে ট্র্যাডিশনাল চায়নিজ সাজসজ্জার এই দোকানটি এতক্ষণ কেন যে আমার চোখে পড়লো না, তা বুঝতে পারছি না। সে যাক, দরজা ঠেলে ওটার ভেতরে পা দিতেই মনে হল এসে গেছি বুঝি কোনও বেইজিংয়ের ডিম রাজ্যে!

হ্যাঁ চমৎকার চায়নিজ শৈলীতে সাজানো এই দোকান ভর্তি দেখছি নানান আকারের সুপ্রচুর ডিম। তবে নাহ, এই ডিমগুলোর কোনওটাই কিন্তু সাদামাটা কোনও ডিম নয়। চমৎকার সব পেইন্টিং করা প্রতিটি ডিমেই। হাবেভাবে মনে হচ্ছে হ্যান্ড পেইন্ট করা সব। হ্যান্ড পেইন্ট মানে তো হচ্ছে, এগুলোর দামও হবে খুবই আক্রা। আবার দোকানটির যে রকম সাজসজ্জা, তাতেও মনে হচ্ছে এহল সৈয়দ বংশীয় কোন স্যুভেনির দোকানই। তবে এ কি হোলসেল দোকান? নাকি খুচরাও বিক্রি করে এরা। বুঝতে পারছি না তা।

স্টোরটির ভেতরের ডানে, বাঁয়ে, মাঝে কাচের নানান শো কেসে যেমন ডিসপ্লে তে রাখা আছে মুরগির ডিমের আকার থেকে শুরু করে উট পাখির ডিম আকারের নানান রং চং করা ডিম, তেমনি দেয়াল লাগোয়া মোটামুটি ছাদ ছঁই ছুঁই করে দাঁড়িয়ে থাকা সেলফ গুলোতেও সাজানো আছে অনেক অনেক ডিম। এ গুলির যে কী কাজ? তা তো ঠাহর করতে পারছি না। মনে হচ্ছে এগুলোর কোনও কাজ না থাকলেও স্যুভেনির হিসাবে শুধু সাজিয়ে রাখার জন্যই কি এগুলো কেনে নাকি চায়নিজ রা বা বিদেশিরা। আচ্ছা এগুলো তাহলে ইস্টার এগ নাকি?

যদি তা হয়ও, কথা হচ্ছে চায়নায় খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী আছে কেমন? নাহ তা তো জানি না! যতোটুকু মনে পড়ছে ১৯০০ সালে বৃটেন, আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, জাপান এই আট দেশের বাহিনী একাট্টা হয় চায়নাকে পরাজিত করে বেইজিংয়ের দখল নিলেও, সে অর্থে চীন কখনই কারো কলোনি হয়নি। আর পশ্চিমা শক্তির কলোনি হওয়ার সাথে দেশে দেশে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রসার হওয়াটার আছে গভীরতম যোগসূত্র। সে সূত্র মিলালে এখানে তো খুব বেশি খ্রিস্টান থাকার কথা না।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএই জনদুর্ভোগের দায় কার?
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ