এটি সর্বজনবিদিত যে, মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়ে ভারতের ভূমিকা কোন দিন মুছে ফেলার নয়। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন দেশের মানুষ ভারত সরকার ও জনগণের কাছে চিরঋণীরূপে আবদ্ধ। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ঐ সময় থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ অনুপম সম্পর্ক বিশ্বব্যাপী প্রতিবেশী কূটনীতির রোল মডেল হিসেবে প্রতিভাত। সম্প্রতি টানা তৃতীয় বারের মত জনাব নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সরকার গঠন এতদ অঞ্চলে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। উভয় দেশের সরকারের ধারাবাহিকতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন অধ্যায় সূচনার অপার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অতিসম্প্রতি ভারতের নবগঠিত সরকারের সাথে দেশের নানামুখী সমঝোতা স্মারক আশাজাগানিয়া অনুপ্রেরণায় উদ্ভাসিত। সরকার গঠনের পরপরই বাংলাদেশ সরকার প্রধানের ভারত সফর ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য সফরে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত সমস্যার দ্বার উম্মোচন আশাব্যঞ্জক।
সফরে বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে আরও সুসংহত করতে ৭টি নতুন এবং ৩টি নবায়নসহ ১০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়। দুপক্ষের মধ্যে চুক্তিগুলো হলো– ‘বাংলাদেশ–ভারত ডিজিটাল পার্টনারশিপ’ এবং ‘বাংলাদেশ–ভারত গ্রিন পার্টনারশিপ’। সমঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে– মেরিটাইম কোঅপারেশন, মহাকাশ সহযোগিতা, রেলওয়ে কানেক্টিভিটি, ওশেনোগ্রাফি এবং মিলিটারি শিক্ষা সহযোগিতা। এছাড়াও পুনর্নবায়ন করা ৩টি সমঝোতা স্মারকগুলো হচ্ছে– স্বাস্থ্য ও ওষুধ সহযোগিতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপন এবং মৎস খাতে সহযোগিতা ইত্যাদি। যেটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা হলো গঙ্গা চুক্তি নবায়ন এবং তিস্তার পানি বন্টন ইস্যু। উভয় ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার সমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি–সমঝোতার মেলবন্ধনের জোরালো আহ্বান ইতিবাচক বার্তা বহন করছে। একদিকে ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তি নবায়নের বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত। অন্যদিকে তিস্তার সমস্যা সমাধানে পানি বন্টন সংক্রান্ত কারিগরি কমিটি পাঠানো ইতিবাচক কৌতুহল তৈরি করেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও সম্পাদিত সমঝোতা নিয়ে আলোচনা–সমালোচনার অন্ত নেই। বিশেষ করে রেল ট্রানজিটের সংবাদ প্রকাশ পেলে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে মিথা্য–বানোয়াট–ভিত্তিহীন কার্যকলাপ অতিশয় দৃশ্যমান। ইতিমধ্যে এই ইস্যুগুলোকে নিয়ে দেশে তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। কতিপয় বিরোধী দল–ব্যক্তি–সংস্থা মিথ্যাচারের আশ্রয়ে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস অধিকমাত্রায় পরিলক্ষিত। তারা উল্লেখ্য সফরকে একপাক্ষিক দাবি করে বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের গোলামির চুক্তির ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিযোগ করছে। তাদের মতে, বাংলাদেশ ভূখন্ডকে সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনে ব্যবহার করতে চায় বলেই ভারত রেল ট্রানজিট নিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব হুমহিকর মুখে পড়বে বলেও অযাচিত আশঙ্কা বহুল প্রচার পাচ্ছে।
বিজ্ঞজনের মতে, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের ট্রেন চলাচলে দেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হবে বলে যে কুৎসিত অপপ্রচার চালাচ্ছে তা মোটেও সঠিক নয়। সমঝোতা স্মারকের ৩ নং ধারায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে বলা আছে, রেড ট্রাফিক অর্থাৎ অস্ত্র–গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরকসহ বিপজ্জনক ও আপত্তিকর কোন পণ্য পরিবহন করা যাবে না। ৪ নং ধারায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ–ভারতের মধ্যে পণ্য ও মানুষের চলাচল, সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় আইন–প্রবিধান এবং প্রশাসনিক বিধানের অধীনেই হবে। রেলওয়ে কানেক্টিভিটির আওতায় ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ট্রেন চলবে নেপাল ও ভুটান পর্যন্ত। নেপাল–ভুটান থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে ট্রেন বাংলাদেশে আসবে এবং কলকাতা বন্দরের পরিবর্তে ব্যবহার হবে মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর। এছাড়াও ভারতের অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ গ্রিডের মাধ্যম, ভারতের ট্রান্সমিশন লাইন ব্যবহার করে নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে বাংলাদেশ। ভারতের বুক চিরে যদি বাংলাদেশের ট্রেন চলে তাহলে কী ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি হবে না?
মূলত রেল ট্রানজিট বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ভূ–খন্ড ব্যবহার করে রেলযোগে দেশের এক অংশ থেকে আরেক অংশে সরাসরি নিজেদের পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে ভারত। ট্রানজিট প্রশ্নে ভারতের বক্তব্যে জানা যায়, দুই দেশের মধ্যে বহুমাত্রিক সংযোগকে পরের ধাপে উন্নীত করার লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ। বাংলাদেশের ভূখন্ড দিয়ে ভারতের রেলগাড়ি চললে কী হারে মাশুল, শুল্ক বা ট্রানজিট ফি আদায় করা হবে এবং ঐ ট্রেনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, এই সব খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে দুই দেশের টেকনিক্যাল কমিটি নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসবে। প্রাসঙ্গিকতায় বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা গণমাধ্যমে বলেন, ‘এই রেল ট্রানজিট বা তিস্তা প্রকল্প যে আখেরে বাংলাদেশের জন্য লাভবান হবে সেটা ঐ দেশের বেশিরভাগ মানুষ বুঝবেন সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। এই ট্রানজিট শব্দটা তো এক সময় বাংলাদেশে প্রায় “ট্যাবু” বা নিষিদ্ধ বলে ধরা হতো। এখন আমরা বলি কনেক্টিভিটি, সংযোগ ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশ কিন্তু মেনে নিয়েছে এটা দুই দেশের স্বাভাবিক সম্পর্কের অংশ। কোভিড লকডাউনের মধ্যেও যে ভারত সরাসরি ওয়াগনে চাপিয়ে মহারাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ পাঠিয়েছিল, সেটাও সম্ভব হয়েছিল সীমান্তে রেল কানেক্টিভিটি ছিল বলেই।’ তাঁর মতে, বাংলাদেশ স্ট্র্যাটেজিক লোকেশনের ফায়দা নিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বা কৌশলগত সুবিধাও আদায় করতে পারে।
ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া বাংলাদেশের জন্য একবারে নতুন কোন বিষয় নয়। বাংলাদেশ আগেও প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো ‘অভ্যন্তরীণ নৌ–ট্রানজিট ও বাণিজ্য’ প্রটোকল স্বাক্ষর হয়েছিল। এরপর স্থলপথে ট্রানজিট সুবিধা পেতে ২০১০ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি করে ভারত। ২০১৮ সালে দু’দেশের মধ্যে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে সড়কপথে উত্তর–পূর্বের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনেরও অনুমতি পায় ভারত। বর্তমানে পাঁচটি রুটে বাংলাদেশ–ভারত ট্রেন চলাচল করছে। এর মধ্যে তিনটি যাত্রীবাহী ইন্টারচেঞ্জ। বাকি দুটি পণ্যবাহী। তবে বর্তমান পদ্ধতিতে ট্রেন সীমান্তে আসার পর বাংলাদেশি ইঞ্জিনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসে। এরপর বাংলাদেশি চালক তা চালিয়ে আনেন। ফেরার সময়ও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। নতুন যে চুক্তিটি হয়েছে, সেটির আওতায় ভারতের মালবাহী ট্রেন পশ্চিমবঙ্গের গেদে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করবে।
২৫ জুন ২০২৪ ভারত সফর নিয়ে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে রেল ট্রানজিট দেয়ার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না বলে মন্তব্য করেন। বাংলাদেশের ভূ–খন্ড ব্যবহার করে ভারতকে রেলযোগে সরাসরি পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে কেন সমালোচনা হচ্ছে; প্রধানমন্ত্রী তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। তিনি বলেন, “যত ছোট হোক, এটা আমাদের সার্বভৌম দেশ। সেই সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও স্বকীয়তা বজায় রেখে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে কাজ করছি। একটা দেশের সঙ্গে আরেকটা দেশের ট্রানজিট দিলেই–বা ক্ষতিটা কী? ইউরোপের দিকে তাকান। সেখানে কোনও বর্ডার নেই। তাহলে কি এক দেশ আরেক দেশের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে? তাহলে সাউথ এশিয়ায় আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো? দেশের মানুষের কল্যাণের কথা মাথায় রেখেই ভারতের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে রেল যেগুলো এতদিন বন্ধ ছিলো, সেগুলো আস্তে আস্তে খুলে দিচ্ছি। তাতে আমাদের ব্যবসা–বাণিজ্য সহজ হচ্ছে। এই যে আমরা সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা খুলে দিলাম, তাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে আমাদের দেশের মানুষ।”
সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারতের সাথে সৌহার্দ–সম্প্রীতির মেলবন্ধন অধিকতর জোরালো করা একান্তই জরুরী। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে বিভিন্ন পন্থায় সম্পর্ক উন্নয়ন দেশের অগ্রগতিকে অবশ্যই সমৃদ্ধ করবে। ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট যে নামেই হোক না কেন রেল সংযোগ স্বাভাবিকভাবে দুই দেশের আর্থ–সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনুপ্রেরণার ক্ষেত্র তৈরি করবেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।