আগামী নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর দুজনের বয়সের ফাঁরাক মাত্র চার বছর। সিটিং প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রার্থী, জো বাইডেনের বয়স বর্তমানে ৮১, অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্ধ্লী রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৭৮। বয়সের বিচার্যে জো বাইডেন মার্কিন ইতিহাসে সবচাইতে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি আসন্ন নির্বাচনে পুনর্বার নির্বাচিত হন তাহলে তিনি বাইডেনকে ছাড়িয়ে হবেন মার্কিন ইতিহাসে হবেন প্রথম বয়স্ক প্রেসিডেন্ট। কেননা চার বছর আগে বাইডেন যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন তার বয়স ছিল ৭৮। নির্বাচন হবে চলতি বছরের নভেম্বর মাসে। সে হিসাবে আরো মাস পাঁচেক বাকি। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি নির্বাচিত হন তাহলে তার বয়স তখন দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৭৮। দুজনের মাঝে বয়সের ব্যবধান খুব বেশি নয়। কিন্তু মেক্সিকো বর্ডার, মাইগ্রেশন, অর্থনীতি সহ দেশের বিবিধ অভ্যন্তরীণ সমস্যা, ভূ–রাজনীতির অনেক জরুরি ইস্যুকে ছাড়িয়ে প্রার্থীর ‘বয়স‘ আগামী নির্বাচনকে ঘিরে আলোচনা, জল্পনা–কল্পনার মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে জো বাইডেনের বয়স নিয়ে। কেবল আলোচনার বিষয় না, এই বয়সের কারণে তিনি (বাইডেন) নির্বাচনী–দৌড়ে ডেমোক্র্যাক্ট দলের হয়ে শেষতক আদৌ টিকে থাকতে পারবেন কিনা এই বিষয়টি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার অনেক আগেই বয়সের কারণে জো বাইডেনকে দলের ভেতর–বাইরে থেকে অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আসন্ন নির্বাচনে না দাঁড়াতে। কিন্তু তিনি তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি। দলের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে তাকে প্রকাশ্যে, আড়ালে–আবডালে দলের অনেক নেতা–কর্মী ‘ত্যাগ‘ দিতে আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কারো কথা, কোন যুক্তি শোনেননি। শুরুতে আশা ছিল প্রেসিডেন্টের পরিবার তাকে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি করাবে। বিশেষ করে সপ্তাহ দেড়েক আগে ‘সিএনএন‘ আয়োজিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে প্রথম বিতর্কে চরমভাবে মন্দ পারফরম্যান্স করার পর। উল্টো তার (বাইডেনের) পরিবারের সদস্যরা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং ইংরেজিতে যাকে বলে ‘টোটাল সাপোর্ট‘ অর্থাৎ সম্পূর্ণ সমর্থন, তাই দিয়েছেন। ক্ষমতার কী মোহ! কথায় আছে ‘নেতার আগে দল, দলের আগে দেশ।‘ কিন্তু দেশ–বিদেশে বাস্তবে যে চিত্র আমরা দেখি তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাস্তবে যা দেখা যায় তা হলো, সবার আগে ব্যক্তি বা নেতা। এই নিয়ে গতকাল সকালে কথা হচ্ছিল একুশে পদক প্রাপ্ত বরেণ্য সাংবাদিক দৈনিক আজাদী সম্পাদক, এম এ মালেকের সাথে। তার অফিস কামরায় কফি খেতে খেতে নানা বিষয় নিয়ে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘ক্ষমতার মোহ পরিত্যাগ করা বড় ‘ত্যাগের‘ ব্যাপার। একবার ক্ষমতার–গদিতে আসীন হলে সেখান থেকে কেউ উঠে আসতে চাননা, তখন তাদের কাছেই বয়স কোন ফ্যাক্টর নয়।‘ তারপর বলেন, ‘রাষ্ট্র ক্ষমতার কথা বাদ দেন, জেলা পরিষদ এমন কী উপজেলা পর্যায়েও আপনি দেখুন না, কেউ একবার গদিতে বসলে তা তারা বাকি জীবন অবধি আঁকড়ে ধরে থাকতে চান।‘
কিন্তু চাইলেই যে সব সময় সব ক্ষেত্রে পাওয়া হয় তা নয়। প্রথম বিতর্কে খারাপ পারফর্মেন্স করার কারণে ডেমোক্র্যাট দলের নেতাদের অনেকে যারা এক সময় জো বাইডেনের প্রতি জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন, তাদের অনেকে ইতিমধ্যে তাকে প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন নির্বাচন থেকে সরে এসে দলের অন্য কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দিতে, দলকে বাঁচাতে এবং ট্রাম্পকে হারাতে। বাইডেনের কাছ থেকে এই ব্যাপারে কোন সাড়া না পাওয়ায় ডেমোক্রাট দলীয় এক সিনিয়র নেতা এই বলে মন্তব্য করেন, ”বাইডেন সম্পর্কে কেবল একটি শব্দই উপযুক্ত, তা হলো ‘একগুঁয়ে‘।” টেক্সাসের ডেমোক্রাট দলীয় প্রতিনিধি লয়েড ডগেট এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমি কংগ্রেসনাল জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা প্রতিনিধিত্ব করি যেটি এক সময় লিন্ডন জনসন প্রতিনিধিত্ব করতেন। লিন্ডন জনসনের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিকে উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে সরে আসতে হয়েছে। তিনি তা করেছিলেন দল ও দেশের স্বার্থে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনেরও উচিত একই পথ অনুসরণ করা।‘ নাম প্রকাশ না–করার শর্তে ডেমোক্র্যাক্ট দলের এক আইনপ্রণেতা সিএনএনকে বলেন, ‘আমরা তার (বাইডেন) গতিপথ এবং জেতার ক্ষমতা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তবে নির্বাচনী লড়াই থেকে তাকে সরে যাবার জন্যে কিছুটা সুযোগ ও সময় দেয়া দরকার। কিন্তু এরপরও যদি তিনি সরে না দাঁড়ান তাহলে আমরা আমাদের উদ্বেগের বিষয়ে ক্রমশ সোচ্চার হবো।‘
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দেখা যায়, ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিকান দলীয় কোন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হলে তারা দ্বিতীয়বারের মত নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতায় বসেন। সেটি আমরা সিনিয়র ও জুনিয়র দুই বুশ থেকে শুরু করে বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামাকে দেখেছি। তবে ব্যতিক্রমও আছে। সামপ্রতিক সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি দ্বিতীয় দফায় হেরে গিয়েছিলেন জো বাইডেনের কাছে, যদিও বা ট্রাম্প সেই পরাজয় বিগত সাড়ে তিন বছর ধরে অস্বীকার করে চলেছেন। তারও অনেক আগে ১৯৬৩ সালে আততায়ীর গুলিতে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি নিহত হলে, প্রেসিডেন্ট পদে বসেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন। কেনেডির চার বছরের প্রেসিডেনশিয়াল–টার্ম শেষ করে ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মধ্যে দিয়ে জনসন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়েই জনসন ‘গ্রেট সোসাইটি‘ নামে এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার ঘোষণা দেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল ‘ওয়ার এগেইনস্ট পভার্টি‘ অর্থাৎ ‘দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ‘। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ পরিচালনায় তার ব্যর্থতা, নিজের দুর্বল স্বাস্থ্য, পাশাপাশি তার নিন্মগামী জনপ্রিয়তা সব মিলিয়ে তিনি দ্বিতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে প্রার্থী না হবার সিদ্ধান্ত নেন। জনসন ছাড়াও আরো বেশ কয়েক প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বারের জন্যে নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাননি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, জেমস কে পলক, জেমস বুকানন, রাথারফোর্ড বি হেইস, ক্যালভিন কুলিজ ও হ্যারি ট্রুম্যান।
এদিকে প্রথম নির্বাচনী বিতর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুলনায় জো বাইডেন চরমভাবে খারাপ পারফরম্যান্স করার পর তার এই লড়াইয়ে এখানেই সমাপ্তি টানা দরকার বলে অনেকে মনে করলেও কেউ কেউ আবার এই বলেও মন্তব্য করেন, কেবল একটি বিতর্কের ফলাফল দিয়ে একজন প্রার্থীর যোগ্যতা বা নির্বাচনে জয়–পরাজয়ের কথা বলা সম্ভব নয়। তারা এই বলে যুক্তি দেখান, বারাক ওবামাও ২০১২ সালে প্রথম নির্বাচনী–বিতর্কে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী মিট রমনির তুলনায় ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি। কেবল যদি একটি বিতর্কে এমন পরাজয় হয়, সেটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু তাদের আশংকা বাইডেনের ক্ষেত্রে এর পুনরাবৃত্তি হবেনা তেমনটি নিশ্চিত করে বলা যায়না। অর্থাৎ বাইডেন যেমন প্রথম বিতর্কে বার কয়েক, কয়েক–সেকেন্ডের জন্যে ‘খেই‘ হারিয়ে ফেলেছিলেন, বিশেষ করে অর্থনীতি ইস্যুতে, তেমনটি আবারো ঘটার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে ডেমোক্র্যাক্ট দলীয় অনেক আইনপ্রণেতা ও নেতাদের ধারণা। আর সেখানেই তাদের ভয়। উল্লেখ্য, এবিসি নিউজ আয়োজিত জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় টিভি–বিতর্ক হবে আগামী ১০ সেপ্টেম্বর। এখন দেখার বিষয়, যে–ভাবে দলের অভ্যন্তরে ও দলের বাইরে জো বাইডেনকে নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হচ্ছে তাতে তিনি দ্বিতীয় বিতর্ক অবধি তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারবেন কিনা, নাকি ইস্তফা দেবেন শেষ তক।
অনেকেই প্রস্তাব করছেন বাইডেনের বিকল্প প্রার্থী দাঁড় করানোর। সেটি কতটুকু বাস্তবসম্মত সে নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। নির্বাচনের মাত্র আর ১৩০ দিন বাকি। এই অল্প সময়ে বাইডেনের বিকল্প প্রার্থী দলের মাঝে খুঁজে বের করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। জো বাইডেনের রয়েছে একটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস সমাধানের অভিজ্ঞতা। দলের মধ্যে তেমন দ্বিতীয়টি আছেন বলে কেউ মনে করেন না। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের প্রেসিডেন্ট হবার মত ‘ক্যারিশমা‘ নেই বলে অনেকের ধারণা। এর বাইরে দলের ভেতর থেকে যে কটি নাম ইতিমধ্যে সামনে এসেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর, গ্যাভিন নিউসম এবং মিশিগানের গভর্নর, গ্রেটচেন হুইটমার। নির্বাচনের ছয় মাসেরও কম সময়ে পৌঁছে এখন বিকল্প প্রার্থীর প্রশ্ন উঠায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই বলে মন্তব্য করেন, ‘অনেকদিন ধরেই জো বাইডেনের দ্বিতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার জন্যে আলাপ–আলোচনা হচ্ছিলো। তখন দলের ভেতর কি এমন কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন না যারা এই প্রশ্নকে সামনে এনে নতুন প্রার্থী দাড় করানোর বিষয়টা তুলে ধরতে? দলের ‘প্রাইমারি‘ যখন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তখন তারা কই ছিলেন?’ আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গেভিন নিউসমকে দেখা গিয়েছিল বাইডেনের ফ্রন্ট–রানার হিসাবে। কিন্তু তিনি (নিউসম) তড়িঘড়ি করে গত সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রেসিডেন্ট–প্রার্থী লড়াইয়ে ক্ষান্ত দেন এই বলে, ‘ব্যক্তি হিসাবে জো বাইডেনের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে।‘ প্রথম নির্বাচনী বিতর্কে খারাপ পারফরম্যান্সের পর তিনি বলেন, ‘একটি বিতর্কে খারাপ করার পর তুমি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারোনা। এটি কোন ধরণের দল করতে পারে?’ মোট কথা এখন ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতর দুটি ক্যাম্প– একটি চায় বাইডেন প্রার্থিতা চালিয়ে যাক, অন্য ক্যাম্প চাইছে বিকল্প প্রার্থী। এমনটি ঘটলে আশংকা করা হচ্ছে দলের ভেতর (ডেমোক্র্যাক্ট) বিভেদ ও ফাটল সৃষ্টি হতে পারে। তবে সেটি হলেও গোটা দেশের মধ্যে ফাটল ও বিভেদ সৃষ্টির চাইতেও ভালো। কেননা অনেকের মতে, ‘আনপ্রেডিক্টবল‘ হিসাবে খ্যাত রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে দেশের গণতন্ত্র যে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তখন দেশ চলবে এক ব্যক্তির ইচ্ছে–অনিচ্ছা, পছন্দ–অপছন্দের ওপর। আর তার নেতিবাচক মারাত্মক প্রভাব কেবল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পড়বে তা নয়, পড়বে গোটা বিশ্বে। আর সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে অধীর উৎসাহ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।