বিশ্বব্যাংক সমপ্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। চলতি বছরে ৩ শতাংশের কম বাড়বে রেমিট্যান্স। গত বছর ৩ শতাংশের বেশি বেড়েছিল। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ রয়েছে। গত মে থেকে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে ডলারের দাম একদিনে ৮ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আইএমএফ–এর শর্ত অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করতে হবে। তখন এর দাম আরও বেড়ে গিয়ে টাকার মান কমিয়ে দেবে। আইএমএফ–এর মতে, বাংলাদেশের টাকা অতিমূল্যায়িত। এর মান আরও কমাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। তিনি বলেন, আগের চ্যালেঞ্জগুলো তো রয়েই গেছে। মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, বিনিয়োগ বাড়ানো ও রাজস্ব আয় বাড়ানো। এগুলোর পাশাপাশি এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে ২০২৬ সাল থেকে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ আসবে। সেগুলোও এখন থেকে মোকাবিলা করতে হবে। অর্থ পাচার, হুন্ডি, খেলাপি ঋণ– এগুলোও চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেবে। এ অর্থবছরেও সরকারকে খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। নজর রাখতে হবে সুদের হার যাতে বেশি না বাড়ে। ডলারের প্রবাহ বাড়িয়ে টাকার মানকে স্থিতিশীল রাখাটা জরুরি।
আইএমএফ–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এখন বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হচ্ছে। অর্থনীতিকে করোনা মহামারির আগের অবস্থায় নিতে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে।
চলতি মাসের শেষদিকে আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফ–এর শর্তে এতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর নীতি গ্রহণ করা হবে। ফলে ঋণের সুদের হার আরও বাড়বে। ব্যাংকে তারল্যের প্রবাহও কমবে। ফলে ঋণের খরচ বেড়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের একটি মত প্রকাশিত হয়েছে তাতে। এতে বলা হয়েছে, নতুন অর্থবছরে দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হবে। এগুলো হচ্ছে– মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানা, ডলার সংকট মোকাবিলা করে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা এবং রাজস্ব আয় বাড়ানো। দেশে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এসব খাতে লক্ষ্য অর্জন বেশ চ্যালেঞ্জিং।
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরেও খাতগুলোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এমনকি অর্থবছরের মাঝপথে অর্থাৎ গত জানুয়ারিতে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েও তা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এসবের পাশাপাশি আরও কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আইএমএফ–এর শর্তের বাস্তবায়ন এবং এর প্রভাব মোকাবিলা। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে আস্থার সঞ্চার করা, রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক অবস্থায় আনা। এছাড়া টাকা পাচার রোধ এবং হুন্ডির প্রভাব কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়েছে।
এদিকে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাব্লিউইএফ) এক জরিপে বলা হয়েছে, আগামী দুই বছরে জ্বালানি ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা, বৈষম্য, সরকারি ঋণ ও বেকারত্ব– এই ছয়টি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
গত ১০ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্ট ২০২৪‘ এ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এই তথ্য জানিয়েছে। দেশের ৭১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের নিয়ে করা জরিপের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
২০২৩ সালে এই মতামত জরিপ পরিচালনা করে বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলো ছিল– উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণ সংকট, উচ্চ পণ্য মূল্যের ধাক্কা, মানবসৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি ও সম্পদের জন্য ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। এ বছর ব্যবসায়ীরা মনে করছেন জ্বালানি ঘাটতিই হবে বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ, যা আগের বছর তাদের জন্য উদ্বেগের বিষয় ছিল না। এ বছরের প্রতিবেদনে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম আগামী দুই বছরে বাংলাদেশসহ ১০০টিরও বেশি দেশের জন্য মারাত্মক কিছু ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে।
পরবর্তী দুই বছরে, বিশ্বের ব্যবসায়ীরা ভুল ও অপতথ্য সবচেয়ে গুরুতর বৈশ্বিক ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এরপর আছে আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতা, সামাজিক বিভেদ, সাইবার নিরাপত্তাহীনতা, অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাত।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে এককভাবে মূল্যস্ফীতির হার কমানো সম্ভব নয়। এজন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।