আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের একজন মৌলিক শক্তিমান আধুনিক কবি। অন্য অনেকের মতো তিনি অজস্র কবিতা লেখেননি। তবে আট দশক দীর্ঘ জীবনকালে তিনি যা লিখেছেন, উৎকর্ষ বিচারে তা অনন্য। বাবুই পাখির মতো তাঁর কবিতার বুনন, যা শিল্পোত্তীর্ণ। বলা যায়, আল মাহমুদ কবিতার নিপুণ বুনন শিল্পী বাবুইপাখি। এজন্যই হয়তো নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার কোলকাতা অবস্থানকালে (২২ এপ্রিল ১৯৮৩) অনুযোগ করে বলেছিলেন ; ‘কলিকাতার কাব্য পাঠকেরা কিন্তু এখনও আপনাকেই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে স্বীকার করেন। কবিতা লেখার ব্যাপারে আপনার সহৃদয় আলস্য লক্ষ্য করা যায়। আরও কবিতা লিখুন। না লিখলে আমরা এতিম।’ আল মাহমুদ প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসসহ সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তিনি নিজেকে ‘কবি’ হিসেবে ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তাঁর কথায়–
‘গন্ধ মদির আমি পৃথিবীর /
কবি একজন, আর কিছু নই– /
আমার কথাতো আমিই লিখেছি /
লিখেছি কাব্য, কবিতার বই /
আমি শুধু কবি একজন বটে,/
আর কিছু নই।’
(জন্মদিনে ৬ জুলাই, ১৫ দৈনিক প্রথম আলো)
বিনয়ী কবি এখানে খুব সাধারণভাবে নিজেকে প্রকাশ করলেও তার কবিতাসমূহে রয়েছে এক অসাধারণ নিপুণ শিল্পকর্ম, যা থেকে চুঁইয়ে পড়া জলের ধারায় ঝরে কাব্য নির্যাস। দৃষ্টি– শ্রুতি–ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়ের সমন্বিত উপস্থাপনায় তাঁর কবিতা– প্রতিবেশ রচিত। তাঁর কবিতার রচনা প্রকৌশল, প্রকরণ, ভাষাভঙ্গি, শব্দ প্রয়োগ এবং অন্তর্গত ভাবনায়ও এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য দৃষ্ট হয়, যা একে পরিণত করে মৌলিক ও বিশুদ্ধ শিল্পকর্মে। বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে তাঁর কবিতা আধুনিক ; কিন্তু দৃশ্যপট, চিন্তা–চেতনা, দর্শনে তা চিরায়ত, ত্রিকালস্পর্শী। তাঁর কাব্যিক চেতনা এতই শানিত ছিল যে, কবি আত্মার ভেতরের তাড়নায় তিনি আমাদের কাব্যবোধকে অবিরাম চ্যালেঞ্জ করে আমৃত্যু যৌবনের মতো সচল ছিলেন এবং একজন মৌলিক ও শক্তিমান কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে নিজের আসন তৈরি করে নিয়েছেন। তিনি ছিলেন তাঁর সময় ও সমসাময়িকদের অতিক্রমকারী একজন অগ্রসরমান কবি। কবির কথায়–
‘আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও তাদের ছাড়িয়ে যাই / গতিই আমার নিয়তি ।’
–না কোন শূন্যতা মানি না।
আল মাহমুদের একটা নিজস্ব কাব্যভাষা আছে, আছে নিজস্ব রচনাভঙ্গি, কাব্যিক পরিচর্যা। তাঁর কবিতা সাধারণভাবে ছন্দায়িত, ছন্দে তার দক্ষতা অসামান্য। তবে তাঁর গদ্যকবিতাও আপন স্বাতন্ত্র চিহ্নিত। শব্দ কি করে কবিতা হয়ে উঠতে পারে, আল মাহমুদ তার এক সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শব্দ–বয়ন কৌশল তাঁর কবিতার এক অনন্য সম্পদ। এ সম্পদ কবিতায় ব্যবহৃত শব্দরাজিকে কবিতার অনিবার্য অঙ্গে পরিণত করে। তিনি সেইসব ভাগ্যবান কবিদের অন্যতম, যারা জীবিতকালে নিজের সাফল্য ও খ্যাতি দেখে গেছেন। কোলকাতার ‘কবিতীর্থ’ সম্পাদক উৎপল ভট্টাচার্যের মতে, ‘তিরিশের কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তথা আধুনিক বাংলা কবিতার জনকপুরুষ কবি জীবনানন্দ দাশের পরে মৌলিকতা ও সাফল্যের দিক থেকে আল মাহমুদের কীর্তি সত্যিকার অর্থেই অতুলনীয়।’ শিবনারায়ণ রায়ের মতে, ‘সমকালীন যে দু’জন বঙালি কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বার বার আকৃষ্ট করেছে, তাদের মধ্যে একজন হলেন– বাংলাদেশের আল মাহমুদ, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’ সৈয়দ আলী আহসান বলেন, ‘উভয় বঙ্গের কাব্যকীর্তি, সব কবিদের কাব্যকীর্তি পরীক্ষা করলে আল মাহমুদকে একজন শ্রেষ্ঠ কবি আখ্যা দিতে হয়।’ কবি ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দের কথায়, ‘মধ্য–পঞ্চাশে আল মাহমুদ প্রবেশ করেন এদেশের কবিতায়, কবিতা ও আধুনিকতা নিয়ে এদেশের প্রথম আধুনিক কবিদের অন্যতম তিনি ; তাঁর কবিতা গ্রামীণতার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি, তাৎপর্যময় ও উপকারী এই নতুন আলিঙ্গনকারী আধুনিকতা।’
আল মাহমুদ স্বদেশ, স্বকাল, স্ব–সমাজকে ধারণ করে শুরু করেন তাঁর কাব্যযাত্রা। তিনি জানান, ‘আমি লিখতে শুরু করি মধ্যপঞ্চাশ অর্থাৎ ১৯৫৪–৫৫ এর দিকে।’ (ভূমিকা, আল মাহমুদের কবিতা, হরফ, ১৯৮৪)। তবে পঞ্চাশের কবিদের কবিতায় শুরুতে যেভাবে বহিঃজীবন, সামাজিকতা প্রভাব বিস্তার করেছে, আল মাহমুদের প্রথম পর্যায়ে তা পরিলক্ষিত হয় নি, যদিও তিনি ছিলেন পঞ্চাশ প্রবেশক কবি। তিনি কিছুটা প্রচ্ছন্ন বিনম্রভাবে, আকারে ইঙ্গিতে এগিয়েছেন। তাঁর প্রথম বই ‘লোক লোকান্তর’, তারপর ‘কালের কলস’, তারপরে ‘সোনালি কবিন’। কাব্যচর্চায় এসব গ্রন্থে ত্রিশের কাব্য প্রবণতা, আবহ, প্রভাব, অভ্যাস বা আবর্তন লক্ষণীয়। কিন্তু ‘সোনালি কবিনে’র পরে ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ থেকে শুরু করে ‘দ্বিতীয় ভাঙ্গন’, ‘বিরামপুরের যাত্রী’, ‘না কোন শূন্যতা মানি না’– গ্রন্থগুলোতে তিনি ত্রিশের প্রভাব পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠেন। নির্মাণ করেন আপন কাব্যভুবন, যা ক্রম অতিক্রমধর্মী।
‘লোক লোকান্তর’ আল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এ কাব্যগ্রন্থে কবিতার সংখ্যা ৫১টি। এটি মূলতঃ এক গভীর উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিঃসঙ্গতার কাব্য; যার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে কবির যৌবন– জীবিকার সংগ্রামে সময় জর্জরিত দুঃখ– বিষাদ বেদনা, অতৃপ্ত একাকিত্ব ও অপ্রাপ্তির বেদনা। এতে দ্বিধা–দ্বন্দ্বের দোলায় ভরা আত্নজগত উন্মোচন করেন কবি এভাবে–
‘কেবলই আমার মধ্যে যেন এক /
শিশু আর পশুর বিরোধ। ’
(বিষয়ী দর্পণে আমি)
কিন্তু কবি হতাশ নন, তিনি জানেন তাকে অনেক দূর যেতে হবে। যার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই নিচের কবিতায়–
‘লোক থেকে লোকান্তরে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে শুনি /
আহত কবির গান। কবিতার আসন্ন বিজয়। ’
(লোক লোকান্তর)
প্রথম কাব্যগ্রন্থে তিনি কিছুটা জীবনানন্দ প্রভাবিত। প্রকৃতি ও নারীর প্রতি শুরু থেকেই তাঁর অনুরাগ। কিন্তু তিনি জানিয়ে দেন, তিনি এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে আপন পথে চলতে চান–
‘অন্য কোন খোলা /
রাস্তায় হাঁটতে হবে /
অন্তত যাতে /
অনায়াসে মুখ তুলে দুয়েকটা ছোড়া যায় শিস।’
(কঠিন সংসার)
প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তিনি জানিয়ে দেন, কবিতার গাঁথুনি ও নির্মাণে তিনি কত পারঙ্গম। লক্ষ করুন নিচের লাইন–
‘আলোটা উসকে দিই– বললো সে, বললাম থাক। /
আঁধারে কিসের গন্ধ আমাকে বুঝতে দাও, জেগে /
একটু নীরব থেকে দেখা যাক কিসের আবেগে/
মানুষের ঘুম পায়।’ (রাত)
কবি শহীদ কাদরী বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কবিতার দ্রাঘিমা সনাক্ত করতে হলে যে সব গ্রন্থের কাছে বার বার ফিরে যেতে হবে, ‘লোক লোকান্তর’ তার অন্যতম।
১৯৬৬ সালে ৩৫টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কালের কলস’। এ গ্রন্থে সময় ও প্রতিবেশ বিশেষত সমকালের বিপন্নতাবোধ ও রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে শাসকবিরোধী একটি কণ্ঠ উচ্চকিত হতে দেখা যায়। আসলে এ ‘কালের কলস’ পর্বেই জীবন ও জগত বিশ্লেষণে তার কবিতা হয়ে ওঠে মসৃণ শিল্পিত মোহময় এক সৃষ্টি, যা খুঁজে পায় নিজস্ব ভাষা। জীবনের জটিলতা ও অনিকেত অনুভূতি এতে অন্য এক ব্যঞ্জনায় উঠে আসে। কালের ব্যাপকতা, স্থিতি ও অনিশ্চয়তার আশ্চর্য অভিজ্ঞান তার কালের কলস:
‘আকাশে উবুড় হয়ে ভেসে যেতে থাকে এক আলোর কলস /
অথচ দেখে না কেউ, ভাবে না কনককুম্ভ পান করে কালের জঠর ; /
ভাবে না, কারণ তারা প্রতিটি প্রভাতে দেখে ভেসে ওঠে আরেক আধার /
ছলকায়, ভেসে যায়, অবিশ্রান্ত ভেসে যেতে থাকে।’ (কালের কলস)
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কবিন’ আল মাহমুদের কাব্য সাধনার পরিণত ফসল। এতে তার কাব্যিক ম্যাচুয়িরিটি অনন্য উচ্চতায় সংহত, ঘনীভূত ও শীর্ষস্পর্শী হয়ে উঠে। এটি আপাত রোমান্টিক প্রেমের কবিতাগ্রন্থ হলেও এতে ইন্দ্রিয় ঘনিষ্ঠতায় নারীর শারীরিক স্পর্শে মোহগ্রস্ত কবি নদী– নারী, দেশ–প্রকৃতি, ইতিহাস–ঐতিহ্য, প্রেম–পুরাণরসে সিক্ত হয়ে ক্রমাগত হাঁটতে হাঁটতে প্রখর প্রতিভায় শরীর থেকে শরীরহীনতায় পৌঁছে যান, যা এটিকে তাঁর সেরা গ্রন্থে অভিষিক্ত করে। সনেটের সংহতি ও সৌন্দর্য্যের সম্মিলনে নিজ ভাবনার নান্দনিক প্রয়োগ কৌশলে এটি হয়ে উঠেছে আধুনিক কাব্যধারার স্বতন্ত্র বই, যাতে ‘কাবিন’ শব্দের প্রবেশ ঘটে দুর্দান্ত নাটকীয়তায়–
‘বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল /
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল। ’
(সোনালি কাবিন)
‘সোনালি কাবিন’ সম্পর্কে বিশ্বভারতী’র (কোলকাতার) অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ‘আমি আল মাহমুদের সোনালি কাবিন বার বার পড়ি।’ ওপার বাংলার শক্তিমান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় (২৯ নভেম্বর ১৯৮৭) জানান, ‘আল মাহমুদের সোনালি কাবিনে স্বদেশ ভাবনার পটভূমিতে প্রেমের নিখাঁদ চিত্রকল্প পাঠককে অনুভবের নিভৃত প্রকোষ্ঠে ধ্যানমগ্ন করে। একটি দৃষ্টান্ত–
‘কতদূর এগোলো মানুষ। /
কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে /
আজও উবু হয়ে আছি। ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে /
কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে /
ভাবলাম, এ মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষাণী আমার। ’
(প্রকৃতি ; সোনালি কাবিন)
‘সোনালি কাবিনের ১৪টি চতুর্দশপদী কবিতা আসলে কবিতামাত্র নয়, এগুলো বাংলা কবিতার বাঁক পরিবর্তনকারী মানবিক মায়াজাল ও মুগ্ধতা সৃষ্টিকারী ছন্দ উচ্চারণ, যে উচ্চারণ আমাদের বশীভুত নয়– বিদ্যুতায়িত করে, শুধু মুগ্ধ নয়– ক্রিয়া বা অ্যাকশনে রূপান্তরিত করে চিন্তাজগতকে উস্কে দেয়। এ ধরনের কবিতা এ অঞ্চলের কবিতা– ইতিহাসে তুলনারহিত এবং অভিনব।
আল মাহমুদের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। এই কাব্যগ্রন্থ থেকে শুরু হয় আল মাহমুদের দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তন”
‘প্রভু, আমার গতি কোনদিকে ? /
আমি এখন কোথায় যাবো ? বহুকাল যাবত /
আমার কোন ঘর নেই। মানবিক নির্মাণের প্রতি /
আমি আস্থা হারিয়েছি।’
(এখন একটা সময় ; মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো)
এভাবে কবি অগ্রসর হন নিজের পথের খোঁজে। ফলতঃ এই প্রত্যাবর্তন কবির আধ্যাত্ন ভাবধারা ও বিশ্বাসে আত্মসমর্পণের চিহ্নবাহী। আল মাহমুদ কয়েদী জীবনের এক পর্যায়ে তার মনের মায়াবী পর্দা দুলে উঠে। কারাগারের অভিজ্ঞতা ছাড়া কি এই গ্রন্থের ‘প্রাচীর থেকে কথা’, ‘দেয়াল’, ‘সক্রেটিসের মোরগ’, ‘ধাতুর ওলান থেকে’ ‘সৌভাগ্যে কাতর’ এর মতো কবিতা লেখা সম্ভব হতো ?
আল মাহমুদদের কবিতা গ্রন্থসমূহের অধিকাংশই স্বমহিমায় ভাস্বর। তাঁর অন্যান্য কব্যগ্রন্থ ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ (১৯৮০), ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ (১৯৮০), ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ (১৯৮৫), ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’ (১৯৮৭), ‘প্রহরান্তের পাশ ফেরা’ (১৯৮৮), ‘একচক্ষু হরিণ’ (১৯৮৯), ‘মিথাবাদী রাখাল’ (১৯৯৩), ‘তোমার জন্য দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী’ (২০০৫), ‘না কোন শূন্যতা মানি না’ (২০০৫), ‘আমি দূরগামী’, ‘দোয়েল ও দয়িতা’, ‘দ্বিতীয় ভাঙ্গন’, ‘নদীর ভিতরে নদী’, উড়াল কাব্য,- ইত্যাদিতে তাঁর কবি মানস একেবারে সুস্পষ্ট। এসব গ্রন্থ একটু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পড়লে বুঝা যায়, তাঁর কাব্যভাবনা কত উঁচুমার্গের ও আধুনিক। এসব গ্রন্থে তার উপমা, রুপক, চিত্রকল্প ও অনুপ্রাসের ব্যবহার আশ্চর্য কারুময় শৈল্পিক সুষমাসমৃদ্ধ।
আল মাহমুদের কবিতায় বিষয়বস্তুর বহিরঙ্গতাকে ছাপিয়ে বেরিয়ে আসে অন্তরের নির্যাস। এতে নগরের আধুনিকতা, গ্রামীণ প্রাচীনতা, চেনাজীবন–অচেনা জগৎ, নৈঃশব্দের স্তব্ধতা– শহরের কোলাহল, শিল্পীর কারুকাজ–সাধারণের সহজতা বিনি সূতোর মালা হয়ে পাঠককে নিবিষ্ট রাখে। তার কবিতায় পাণ্ডিত্যের আতিশয্য নেই, আছে ইঙ্গিতময়তার সহজবোধ্য শিল্পসৌরভ। তিনি কবিতায় গভীরভাবে খোঁজেন মানুষ, জীবন, প্রেম ও প্রকৃতিকে এবং তুলে আনেন এসবের ভেতরের অদেখা অনুভবের জগত।
আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ, গ্রাম বাংলার বিপুল নির্বাক জনগোষ্ঠীর আশা–আকাঙ্ক্ষা, প্রেম–কাম, পরিচিত লোকজ উপাদান যুক্ত করে আধুনিক ভিন্ন ঘরানার এক কাব্যভুবন তৈরি করে বাংলা কবিতায় নতুন সম্ভবনার দ্বার উন্মোচন করেন। তাঁর তৈরি করা এ–ভুবন অবশ্যই কবি জসীম উদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ থেকে ভিন্ন। কবি নিজেই বলেছেন, ‘আমি গ্রাম নিয়ে এসেছিলাম এবং ভালো করেই এনেছিলাম– না জসীম উদ্দীন, না জীবনানন্দ। আমার পথ, আমার ভাষা, আমার উপমা উৎপ্রেক্ষা আমি সংগ্রহ করেছিলাম কৃষাণ সমাজ থেকে, উন্নিত মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানদের উৎসভূমি থেকে। সন্দেহ নেই, এটা ছিল আমার এক অকল্পনীয় আনন্দের অফুরান ভাণ্ডার। আমিই প্রথম সম্ভবত আঞ্চলিক শব্দের অসঙ্কোচ ব্যবহার করি।’ (বইয়ের বিদ্যুৎবিভা–আল মাহমুদ। কালের খেয়া ; দৈনিক সমকাল সাময়িকী ৪৫– মে ১২,২০০৬ ইংরেজি, পৃষ্ঠা–৭)।
তাঁর কবিতায় লোকজীবন ও নিসর্গ কবিতার প্রথাগত শরীর ভেঙে নতুন ব্যঞ্জনায় সমুপস্থিত। এতে আবহমান বাংলার রূপ ভেসে ওঠে নান্দনিক আধুনিকতায়।
তাঁর কবিতায় নারীর শরীরী অবয়ব প্রকাশ্য হলেও একে পরকীয়া মানতে কবি কিন্তু নারাজ। তাঁর মতে, ‘ সে আসলে সৃষ্টির আদি এবং স্বকীয়।’ (নারী আমাকে উদ্বাস্তু করেছে (প্রবন্ধ)- আল মাহমুদ। কবিতা প্রতিমাসে। জুন ২০০৫। কোলকাতা, ভারত)।
আল মাহমুদের কবিতায় নারী, প্রকৃতি, গ্রাম ও দেশপ্রেম এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এর বাইরে লোকজ উপাদান, ঐতিহ্য, রাজনৈতিক চেতনা ও আধাত্মভাবনা ইত্যাদিও সঞ্চারিত। এসব তাঁর কবিতার নির্মিতিতে বোধের প্রখরতায় এত প্রাণময় হয়ে উঠে যে, কবিতা পাঠকালে পাঠক এক রহস্যঘেরা কাব্যময়তায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকে। আল মাহমুদ প্রথম জীবনে টগবগে তারুণ্য উদ্ভাসিত হয়ে নারী ও প্রেম বিষয়ে ডালপালা বিস্তারি বিস্তর কবিতা লিখলেও পরিণত বয়সে এসে আগের কবিতা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, ভিন্ন স্বাদের কবিতার প্রতি ঝোঁকেন। কবিতার ভাষাকে তিনি প্রার্থনার ভাষায় পরিণত করতে আগ্রহী ছিলেন। জীবনকে নিয়ে গূঢ় রহস্যের নৈঃশব্দ্যিক কবিতা লেখার দিকে তিনি শেষ বয়সে ঝুঁকেছিলেন, যা হয়তো মানুষকে নৈঃশব্দ্যের নিস্তব্ধতার উপলব্ধির দোরগোড়ায় নিয়ে যেত। কিন্তু তিনি সময় পেলেন না। নিয়তি তাকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়!
আল মাহমুদের কবি প্রতিভার মৌলিকত্বের কারণে কবি পরিচয়ের বাইরে তিনি উপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হয়েও বাস্তবে তিনি কবিতার প্রতিরূপ। তাঁর পদ্য–গদ্য সব কিছুতেই কাব্যের স্বাদ বর্তমান। তাই সব ছাপিয়ে তিনি একজন কবি। চলনে–বলনে–কথনে–লিখনে তিনি আপাদমস্তক একজন মৌলিক শক্তিমান কবি। কবিতা নিপুণ বুনন শিল্পী–কবিতার বাবুই পাখি।