৪৭ মাস পর সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে জুন মাসে। গত ২ জুলাই দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, প্রবাসী আয়ের গতি জোরালো হওয়ার মধ্যে সবশেষ মাস জুনে রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন হয়েছে; ৪৭ মাস পর সর্বোচ্চ আয় এসেছে ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের জুনের চেয়ে সদ্য সমাপ্ত ২০২৩–২৪ অর্থবছরের শেষ মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। ২০২২–২৩ অর্থবছরের জুনে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ২ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকিং চ্যানেলে জুন মাসে এতটা বেশি রেমিট্যান্স এল ৪৭ মাস পর। এর আগে ২০২০–২১ অর্থবছরের জুলাইতে এসেছিল ২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।
খবরটা আসলে আমাদের দেশের জন্য শুভ। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, জনশক্তি রফতানি বাড়লেও রেমিট্যান্স তেমন বাড়েনি। তার প্রধান কারণ হুন্ডি। ব্যাংকগুলো এখন রেমিট্যান্সে যত টাকা দর দিচ্ছে। সেখানে হুন্ডি কারবারিরা তারচেয়ে বেশি দিচ্ছে। আবার কোনো ঝামেলা ছাড়াই প্রবাসীর কর্মস্থলে গিয়ে তারা অর্থ সংগ্রহ করে। আবার ভিন্নমতও আছে, বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়লেই যে রেমিট্যান্স বাড়বে সেটাও নয়। বিদেশে কী পরিমাণ দক্ষ কর্মী পাঠানো হচ্ছে সেটাই বড় বিষয়। কেননা অদক্ষ কর্মী পাঠালে তাদের ব্যয়ের টাকা তুলতেই কয়েক বছর লেগে যায়। আর হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে এ ধারণাকেও উপেক্ষা করা যাবে না। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ বৃদ্ধির বিষয়ে আমাদের সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে রিজার্ভ সংকট এড়ানোর জন্য রেমিট্যান্স বাড়াতে যা যা করণীয় সেগুলো করতে হবে। কেননা রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লে ডলার সংকট কমবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের কর্মক্ষম ২৫ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় অভিবাসনের মাধ্যমে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান না হলে বাংলাদেশে দরিদ্র লোকের সংখ্যা ১০ শতাংশ বেড়ে যেতো। অভিবাসী শ্রমিকদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। আমরা এখনো পর্যন্ত অভিবাসী কর্মীদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে পারিনি। অভিবাসী শ্রমিকদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। অভিযোগ রয়েছে বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলো থেকে তারা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। অথচ আমাদের অভিবাসী কর্মীরা তাদের শ্রমে ঘামে অর্জিত অর্থ দেশে প্রেরণ করে আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। তাদের সামাজিক মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদানে সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রেরণকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করা উচিৎ। তাঁরা বলেন, বর্তমানে প্রদত্ত রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনা ২.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা জরুরি। যারা স্বল্প আয়ের অভিবাসী কর্মী তাদের জন্য রেমিটেন্সের উপর প্রণোদনা ১০ শতাংশ করা যেতে পারে।
অন্যদিকে, নানা প্রণোদনা দেওয়ার পরও রেমিট্যান্স প্রবাহ তেমন বাড়ে নি। এক্ষেত্রে হুন্ডির পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিংকেও দায়ী করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ডলারের বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতার কারণে হুন্ডির বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে অভিবাসীরা অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার পরও সুফল মিলছে না। তবে রেমিট্যান্স সংগ্রহে বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে বৈধ চ্যানেলে ডলার আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানোর বিকল্প নেই। হুন্ডি যে অবৈধ, এটি প্রবাসীদের বোঝাতে হবে। পাশাপাশি হুন্ডিবাজদের তৎপরতা বন্ধ করতে বিদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোর সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। এছাড়া বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মী প্রেরণের বিষয়েও জোর দিতে হবে। এজন্য প্রশাসনের পাশাপাশি প্রবাসীদেরও সচেতনতার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দূতাবাসের তৎপরতার বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি প্রবাসী কর্মীরা যদি সচেতন হন, তাহলে সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে যে কোনো সংকট আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব, এ আশা করাই যায়। মনে রাখতে হবে, দেশটা আমাদের সবার, দেশ সংকটে পড়লে সবাইকেই ভুগতে হবে। যেহেতু বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রবাসী আয়ই হবে আমাদের প্রধান ভরসা, সেহেতু সংকট উত্তরণে সবার সম্মিলিত চেষ্টার বিকল্প নেই।