প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র, বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীতে আবারও একটি বড় গাঙ্গেয় ডলফিন ও একটি মৃত মা মাছ (রুই) মরে ভেসে উঠেছে। গত ১২ দিনে এ নদীতে মোট দুটি ডলফিন ও ছয়টি মা মাছ মরে ভেসে ওঠে। গতকাল মঙ্গলবার রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। কয়েকদিনের ব্যবধানে ছয়টি মা মাছ এবং দুটি ডলফিনের মৃত্যুকে অস্বাভাবিক ঘটনা মনে করছেন হালদা বিশেষজ্ঞরা।
গত সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে নদীর রাউজান উপজেলার পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাট এলাকায় ডলফিন ও মা মাছ ভেসে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা এজন্য হালদা নদীর দূষণকে দায়ী করছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশ হলে নদী দূষণের উৎসসমূহ চিহ্নিত করতে ২৩ জুন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর দপ্তর ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি করে। জেলা মৎস্য বিভাগ আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটি আগামী ৭ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেবে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বরাবর। ইতোমধ্যে দুটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে।
এদিকে প্রায় প্রতিদিন মা মাছ ও ডলফিনের মৃত্যু দেখে নদীপাড়ের মানুষের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। তারা মনে করছেন, দেশের একমাত্র প্রকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মৎস্য, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরের যথাযথ ভূমিকা না থাকায় হালদা এখন জলজ প্রাণীহীন নদীতে পরিণত হতে চলেছে।
এই নদীর মৎস্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল ও মৎস্য সম্পদ রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবী রাউজান আজিমের ঘাট এলাকার রোসাঙ্গীর আলম জানান, ১ জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি আজিমের ঘাটে আরও একটি বড় ডলফিন ও মা মাছ মরে ভেসে এসেছে দেখে ফোনে বিষয়টি হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান মনজুরুল কিবরিয়া এবং রাউজানের মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুনকে জানান। রাতে ভেসে আসা মাছটি ৭–৮ কেজি ও ডলফিনটি বড় আকারের। তিনি জানান, ওই সময় জোয়ারের তীব্রতা ও ভারী বর্ষণের কারণে মাছ ও ডলফিন নদী থেকে উদ্ধার করা যায়নি। নদীর পাড়ে তার মাছের প্রজেক্ট থাকায় তিনি জোয়ারের সময় প্রতিরক্ষা বাঁধের উপর নজর রাখছিলন। এ সময় তিনি নদীর পাথর ব্লকের কাছে মরা ডলফিন ও মাছটি দেখেন। মোবাইলে ছবি তুলে রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তার কাছে পাঠান।
মৎস্য বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান হাটহাজারী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক ময়েদুজ্জামান বলেন, বিষয়টি আমি জানি না। রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুনের কাছে ছবি ও সংবাদ পাঠানো হয়েছে জানালে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, খবর নিতে একটু সময় দেন ভাই।
রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, রাতে ফোনে বিষয়টি জেনেছি। গভীর রাতে বৃষ্টির কারণে নদীতে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, রাতেই ঘটনাটি জেনেছি। মরা ডলফিন ও মাছের ছবি পেয়েছি। তিনি বলেন, ১২ দিনে দুটি ডলফিন ও ৬টি মাছ নদীতে মরে ভেসে ওঠার ঘটনা অস্বাভাবিক ও উদ্বেগজনক। পানি দূষণসহ অন্যান্য কারণগুলো চিহ্নিত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনিক বিভাগসমূহ নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করা জরুরি।
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা অনেকদিন ধরে নদীর পানি দূষণের উৎস চিহ্নিত করার জন্য দাবি জানিয়ে আসছি। এর মধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সর্বশেষ জেলা মৎস্য ও পরিবেশ বিভাগ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করায় তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
হাটহাজারী উপজেলার ইউএনও এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, হালদা নদী দূষণের উৎস খুঁজে বের করতে গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে। গতকাল তারা পানির নমুনা সংগ্রহ করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মঙ্গলবার ড্রোন নিয়ে হালদা নদীর সংযোগ খাল ও ছড়ার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে সোমবার হালদা নদী দূষণের উৎসসমূহ চিহ্নিত করতে উপজেলার বুড়িশ্চর ইউনিয়নের খন্দকিয়া খাল, কৃষ্ণ খাল, শিকারপুর ইউনিয়নের কাটাখালী খাল, বাথুয়া খাল, নগরের চান্দগাঁওয়ের অনন্যা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত ব্রাহ্মণ সাঁই খালসহ হালদা নদীর বিভিন্ন শাখা–প্রশাখা এবং নদীর বিভিন্ন অংশ, খালি জমি পরিদর্শন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের রিসার্চ অফিসার মো. আশরাফ উদ্দিনসহ হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ইউএনও, হাটহাজারী উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক ময়েদুজ্জামান, শিকারপুর ও বুড়িশ্চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রমুখ।
বিডিনিউজ জানায়, হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, গত সাড়ে পাঁচ বছরে হালদায় মৃত ডলফিনের সংখ্যা হলো ৪২টি। তিনি বলেন, ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত হালদা নদীতে যে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং ছিল তাতে সম্প্রতি কিছুটা ভাটা পড়েছে। হালদা নদীকে রক্ষা করতে হলে সমন্বিত প্রশাসনিক নজরদারির বিকল্প নেই।
নদী তীরের বাসিন্দা রোসাঙ্গীর আলম বলেন, ধারণা করছি, কাছাকাছি সময়ে হালদায় বিষ প্রয়োগের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। আর দূষণ এখন খুব বেশি। বিশেষ করে কোরবানির ঈদের পর ট্যানারির বর্জ্য ক্রমাগত হালদায় এসে পড়েছে। পরশু থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় হালদায় ঢল নেমেছে। তার আগে হালদায় পানি ছিল কম। তখন দূষিত পানি খাল হয়ে নদীতে পড়ার দৃশ্য পরিষ্কার দেখা গেছে।
গত কয়েকদিনের মধ্যে যেসব মৃত মাছ দেখা গেছে এগুলোই হালদার প্রাণ মা মাছ। হালদা নদীর সঙ্গে যুক্ত হাটহাজারী ও নগরীর পাঁচটি খালে পড়ে বিভিন্ন কলকারখানা ও গৃহস্থালী বর্জ্য। এসব খালের পানি সরাসারি গিয়ে পড়ে হালদায়। জুনের শুরু থেকে এসব খালে বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রিত পানি দেখা যাচ্ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।