অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় খান বাহাদুর (কে.বি.) আমান আলী সাহেবের মধ্যমপুত্র মোজাহেরুল হক সাহেবের মেয়ের ঘরের নাতি। আবার কে.বি. আমান আলী সাহেবের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন আমার প্রপিতামহ (আমার পিতার পিতামহ) চট্টগ্রামের যস্বশ্বী আইনবিদ উকিল রায়হান আলী (প্রকাশ রেহান আলী)। সেই দিক থেকে অধ্যাপক আলী ছিলেন আমাদের পরমাত্মীয় (জ্যাঠা মশাই) কিন্তু, বাস্তবিক পক্ষে তিনি আমাদের কাছে ছিলেন আত্মীয় থেকেও বেশি। আমাদের পরিবারের সাথে আলী স্যারের পরিবারের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমরা যেভাবে দাওয়াত পেতাম ঠিক তেমনি আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্যারের উপস্থিতি ছিল বহুল আকাঙিক্ষত। স্যারের সহধর্মিণী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক খালেদা হানুম (যিনি সম্পর্কে আবার অধ্যাপক আলীর খালাতো বোন ছিলেন) যাকে আমি “ফুফু” বলে সম্বোধন করতাম তিনিও আমাদেরকে অত্যধিক স্নেহ, আদর ও আপ্যায়ন করতেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর আমি যখন দেশে ফিরে আসি তখন আমি আলী স্যারের সাথে দেখা করতে তাঁর বাসায় যাই। আলী স্যার আমাকে দেখে একটু মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলেন কারণ আমার শারীরিক ওজন সে সময় অত্যধিক বেড়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে অধ্যাপক আলী স্যারের বাসায় যখনই যেতাম তিনি আমাকে সহাস্যে জিজ্ঞাস করতেন “সেলিম, তোমার ওজন কি কমেছে?” তিনি আমার শারীরিক ওজন কমানোর জন্য বারবার তাগিদ দিতেন। অধ্যাপক আলী এবং অধ্যাপক হানুমের সাথে একত্রে বসে লাঞ্চ বা ডিনার অথবা চা এর টেবিলে ক্রমাগত আড্ডা দেয়া এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আলী স্যারের একমাত্র ছেলে ফৈয়াজ ভাই ও তার স্ত্রী শামীমা ভাবীও মাঝেমধ্যে আমাদের সাথে যোগ দিতেন আড্ডায়। আজ তাঁদের দুজনের কেউই আর বেঁচে নেই। যখনই উনাদের কথা মনে হয় এক ধরনের শূন্যতায় ভরে উঠে মন। বৈশ্বিক করোনা মহামারীর সময়েই ২০২১ সনের ২৪ জুন সকালে ৮৭ বছর বয়সে অধ্যাপক আলী ইন্তেকাল করেন এবং ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস তার ঠিক ১০ দিন পরে ইন্তেকাল করেন তার সহধর্মিণী অধ্যাপক হানুম।
অধ্যাপক আলী ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে একজন পন্ডিত ব্যক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। অতঃপর, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য সরকারের বৃত্তি নিয়ে বিশ্বের স্বনামধন্য অফফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৬ সালে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হলো তখন অধ্যাপক আলীকে ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে নিয়ে আসা হয় তাঁর প্রাণের শহর চট্টগ্রামে। শুরু হয় স্যারের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পথ চলা। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তাঁর হাত ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষাসহ ভৌত অবকাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তিনি ছিলেন চারিত্রিক দিক থেকে দৃঢ় ও অবিচল। একজন দক্ষ প্রশাসক হওয়ার জন্য যে সমস্ত গুণাবলী থাকা দরকার তার সবকিছুই তাঁর মধ্যে ছিল। তিনি ছিলেন অনেকের কাছে অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁর ওঠা,বসা হাঁটাচলা সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন একটি রাজকীয় ব্যাপার–স্যাপার ছিল। তিনি দেখতে যেমন ছিলেন রাজপুত্রের মত ঠিক তেমনি তার চলনবলনও ছিল রাজপুত্রের মত। উনার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত আকর্ষণ করতো আমাকে। আর উনি কথার বলার পিঠে কখনো কথা বলতেন না, অন্যকে আগে বলার সুযোগ করে দিতেন। তিনি কখনো গীবত, চোগলখুরি এসব করতেন না বা এসব পছন্দও করতেন না। তাঁর কাছ থেকে সবসময় ভালো ভালো পরামর্শ পেতাম। তিনি গরিব–দুঃখী অসহায়দের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থাকাকালীন সময়ে পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামের অনেকগুলো গরিব, অসহায় পরিবারের চাকুরীর ব্যবস্থা করেছিলেন নিঃস্বার্থভাবে যা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
আলী স্যার ছিলেন রুচিশীল, তীক্ষ্ণ মেধাবী, অমায়িক ও মিষ্টভাষী একজন ব্যক্তি। তবে তিনি যখন রেগে যেতেন তখন তিনি কখনও কর্কশ ভাষা ব্যবহার করতেন না। তিনি শুদ্ধ ও স্পষ্ট ভাষায় যে বাক্যটি বলতেন তাতে মনে হতো গায়ের চামড়া বোধ হয় খুলে পড়ছে। তার বাংলা ও ইংরেজি বলার ঢং ছিল অসাধারণ। এত সুন্দর করে গুছিয়ে তিনি ইংরেজি লিখতেন যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যেত না। আমি যখন প্রথমবার USA তে যাই তিনি আমেরিকার টেনেসি (Tennessee) অঙ্গরাজ্যের একজন ডাক্তার (যিনি আলী স্যারের পূর্বপরিচিত) কে সম্বোধন করে আমার জন্য একটি পত্র লিখেছিলেন যাতে করে সেই অচেনা পরিবেশে আমার সেখানে থাকাটা সহায়ক হয়। এটা ছিল স্যারের আন্তরিকতারই বহিঃপ্রকাশ।
আমি যখন ফার্স্ট ইয়ারে অনার্সে পড়ি তখন একদিন আমাদের গ্রামের বাড়ি পটিয়া যাওয়ার পথে আমার পিতার সাথে স্যারের চাঁন্দগাওস্থ বাসায় যাই। আলী স্যার আমার আব্বাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আমাকে ডেকে বললেন “তোমার প্রথম বর্ষের রেজাল্ট কেমন হয়েছে? আমি খুব খুশি হব যদি তুমি ক্লাসে প্রথম হতে পারো।” স্যারের কথাগুলো সেদিন মনের মধ্যে গেঁথে যায়। পরবর্তীতে অনার্স ফাইনালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্যারকে সালাম করতে আসি। স্যার আমাকে আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
অধ্যাপক আলীর একটি স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য ছিল যে তিনি কথাবার্তায় অত্যন্ত শালীন ছিলেন আবার একই সাথে কঠোর সমালোচকও ছিলেন। তাঁর কথার যুক্তি খন্ডন করা এক প্রকার অসম্ভব ছিল। তিনি একবার আমার একটি জার্নাল আর্টিকেল পড়ে এর বিষয়বস্তু আমাকে বুঝাতে বললেন। আমি বুঝানোর পরে আমার ইংরেজির দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরলেন এবং আমাকে মানোন্নয়নের জন্যে পরামর্শ দিলেন।
আলী স্যার আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়স্থ বাসায় বেশ কয়েকবার তাঁর স্ত্রী দুই নাতনি তামারা, সামিরা ও নাতি ফাহমিদকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন। একবার তিনি আমাদের বাসার গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন, “সেলিম, আমরা কি ভিতরে আসতে পারি?” তাঁর এই প্রকাশভঙ্গি ছিল অত্যন্ত শ্রুতিমধুর ও উদার। দেখে মনে হয়েছিল অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি কতটা সাদামাটা, অমায়িক চরিত্রের অধিকারী।
অধ্যাপক আলী ছিলেন দল–মত নির্বিশেষে সবার কাছে সম্মানের পাত্র। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রায় সকলেই উনার ছাত্রছাত্রী ছিলেন। যারা বর্তমানে দেশে ও বিদেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছাড়াও তিনি পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় (আইআইইউসি), নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় ও সার্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ অলংকৃত করেন। এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পর্ষদে দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিটি পদে তিনি ছিলেন যেন একটি অলংকার যেটি ওই পদের শোভা বাড়াতো। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। যেটি অন্য অনেকের সাথে আমাকেও ব্যথিত করেছে। আমি ভাবতাম হয়তো আর কেউ মনে না রাখলেও অন্ততঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উনাকে আজীবন সম্মাননা দিবে। কিন্তু সে আশা আর পূরণ হয়নি। স্যারের মত গুণী মানুষের সান্নিধ্যে থেকে আমি শিখেছি অনেক কিছু। পরিশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা তিনি যেন আলী স্যার ও ম্যাডামকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে আসীন করে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।