সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষক সমিতি, অফিসার সমিতি ও কর্মচারী ইউনিয়ন। ত্রিমুখী এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছে একাডেমিক অচলাবস্থা। এর ফলে গতকাল সোমবার বন্ধ ছিল সব ধরনের ক্লাস–পরীক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল দাপ্তরিক কাজ। এদিকে একই দাবিতে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) কর্মকর্তা–কর্মচারীদের কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনের সামনে চুয়েট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা কর্মসূচি পালন করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : চবি প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকাল ১০টা থেকে শিক্ষক সমিতি কার্যালয়ে কর্মবিরতি পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দাপ্তরিক কাজ থেকে বিরত থেকে অফিসার সমিতির কার্যালয়ে অবস্থান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের কার্যক্রম থেকে নিজেদের বিরত রেখে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
চবি অফিসার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল আসাদ বলেন, ২০২৩ সালে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের যে বিধিমালা হয়েছে ২০২৪ সালে ওখানে ‘প্রত্যয় স্কিম’ সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে আমাদের এই কর্মবিরতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সমিতি ও কর্মচারী ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা ঐক্য পরিষদ গঠন করেছি। এটার মাধ্যমে আমাদের কর্মসূচি চলবে।
চবি কর্মচারী ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, প্রজ্ঞাপন অনুসারে আজ থেকে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী হিসেবে যোগ দেবেন তাদের সঙ্গে বর্তমান কর্মচারীদের বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে। এ ধরনের বৈষম্যমূলক পেনশন স্কিম আমরা চাই না। আগের পেনশন নীতি চলমান থাকুক–এটাই আমাদের দাবি।
চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর এবিএম আবু নোমান বলেন, আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে স্কেলের আন্দোলন করছিলাম তখনই দেখি মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। ভুলে গেলে চলবে না, যে সমস্ত মেধাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন, যদি সামাজিক সুরক্ষা না থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের থাকবে না। যদি মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষক হিসেবে যোগদান না করেন সেক্ষেত্রে আমাদের আগামী প্রজন্ম সেভাবে মেধাবী হয়ে গড়ে উঠবে না।
তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলনের কারণে যদি শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আমরা অবশ্যই বিগত দিনগুলোতে সেশনজট কমানোর জন্য শিক্ষার্থীদের যেভাবে নিজেদের নিবেদিতপ্রাণ করেছিলাম, এখনও সেটি করব। এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এদিকে চলমান আন্দোলনের কারণে একাডেমিক সেশনজট সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অপরদিকে বিভিন্ন কারণে প্রশাসনিক কাজে আসা ব্যক্তিরাও ভোগান্তিতে পড়েন। বিভিন্ন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো বিভাগে ইতোমধ্যে সেশনজট রয়েছে। তার ওপর রেজাল্ট অনেক বিলম্বিত হয়। আন্দোলনের কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক অচলাবস্থা বিরাজ করছে। আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে ব্যাপক সেশনজটের সম্মুখীন হবে শিক্ষার্থীরা।
ছাত্র উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজগর চৌধুরী বলেন, করোনার সময় যেমন আমরা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে ছাত্রদের ক্ষতিপূরণ করেছি, সর্বাত্মক কর্মসূচির কারণে ছাত্রদের যা ক্ষতি হবে তা অনলাইনে ক্লাসের মাধ্যমে পূরণ করব।
চুয়েট : রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি জানান, প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) কর্মকর্তা–কর্মচারীদের কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনের সামনে চুয়েট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা কর্মসূচি পালন করেন।
কর্মসূচিতে কর্মকর্তা–কর্মচারীরা জানান, দাবি না মানা হলে আগামী ৭ জুলাই থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে যাবেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে। তাই তারা সরকারের কাছে অবিলম্বে তাদের দাবি মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম আবার বহাল করার অনুরোধ করেন।
চুয়েট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. জামাল উদ্দীন বলেন, আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করি, তারা বেতনের বাইরে গিয়ে অন্যদের মতো টাকা আয় করতে পারি না। তাই আমাদের যে সম্বলটুকু আছে সেগুলোকে আঁকড়ে ধরতে চাই। আমরা সরকারের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু যতদিন আমাদের ন্যায্য দাবিগুলো না মানা হবে ততদিন আন্দোলন চালিয়ে যাব।
এদিকে এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল চুয়েটের বিভিন্ন বিভাগে চলমান স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সকল পরীক্ষা স্থগিত ছিল। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
চুয়েটের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতির পরিস্থিতির জন্য চুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলমের সভাপতিত্বে সমন্বিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় চুয়েটের উপ–উপাচার্য অধ্যাপক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ এবং বিভিন্ন অনুষদের ডিনদের উপস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্থগিত পরীক্ষাগুলো কখন হবে এ নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত মার্চ মাসে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আগের চারটি স্কিমের সঙ্গে প্রত্যয় স্কিম নামের একটি প্যাকেজ চালু করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন সব ধরনের স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ২০২৪ সালের ১ জুলাই পরবর্তী সময়ে যোগ দেওয়া কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা। শিক্ষকদের দাবি, এ স্কিম বৈষম্যমূলক। এতে আগামী ১ জুলাই এবং এর পরে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।