যানজট নিরসনে নগরে পে–পার্কিং (টাকার বিনিময়ে গাড়ি রাখার স্থান) চালু করতে ২০১৯ সালে সিডিএ এবং ২০২০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) উদ্যোগ নেয়। ওই সময় দুটো সংস্থা আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের নিচে পে–পার্কিং চালু করতে চেয়েছিল। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) আপত্তিতে যা থমকে যায়। তবে এবার নগরের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে পে–পার্কিং চালু করছে চসিক। আজ রোববার সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। এর মধ্য দিয়ে নগরে পে–পার্কিং চালুর দীর্ঘ ৫ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে। জানা গেছে, পে–পার্কিংয়ের নির্ধারিত জায়গায় অ্যাপসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে গাড়ি রাখা যাবে। এক্ষেত্রে যিনি গাড়ি রাখবেন তাকে গাড়ির ধরন ও সময় অনুযায়ী ১৫ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে। তবে প্রচারণার অংশ হিসেবে আগামী দুই সপ্তাহ গাড়ি রাখলে কোনো চার্জ পরিশোধ করতে হবে না। পে–পার্কিংয়ের মাধ্যমে নগরের পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আসার পাশাপাশি চসিকের রাজস্ব আয়ও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, পে–পার্কিং কার্যক্রমটি পরিচালনা করবে বি–ট্র্যাক সলিউশনস লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। গত ৩ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে চসিকের। এমওইউ অনুযায়ী, পাইলট প্রকল্পের মেয়াদ হবে ছয় মাস। তবে এরপর দুই পক্ষের আলাপ–আলোচনার প্রক্ষিতে আরো ছয় মাসের জন্য সময় বৃদ্ধি করা যাবে।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, পর্যায়ক্রমে পুরো শহরে পে–পার্কিং চালু করব। পার্কিংয়ের জন্য জায়গা নির্ধারিত থাকলে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং বন্ধ হবে। এতে সড়কে শৃঙ্খলা আসবে, যানজট কমবে।
তিনি বলেন, যেখানে সেখানে গাড়ি রেখে যানজট সৃষ্টি হয়। ট্রাফিক বিভাগে বললে তারা গাড়ির চালক–মালিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলে, গাড়ি রাখার জায়গা তো নেই, রাখবে কোথায়। পর্যায়ক্রমে পুরো শহরে পার্কিংয়ের জায়গা করে দেব। তখন আর যেখানে সেখানে গাড়ি রাখতে পারবে না।
মেয়র বলেন, শহরে অনেকগুলো মার্কেটে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেখানে গাড়ি রাখা যায় না। তাই মার্কেটে আসা লোকজন রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে রাখে। এমনকি মার্কেটের অনেক দোকানদারও রাস্তায় গাড়ি রাখে। আমরা ওসব মার্কেটের কর্তৃপক্ষকে ডাকব।
বি–ট্র্যাক সলিউশনের ডেপুটি ম্যানেজার মো. শাহ ফারুক আজাদীকে বলেন, পে–পার্কিংয়ের অবকাঠামোগত সব কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। উদ্বোধনের পর থেকে গাড়ি রাখা যাবে। তবে আগামী দুই সপ্তাহ ক্যাম্পিংয়ের অংশ হিসেবে ফ্রিতে গাড়ি রাখা যাবে।
পে–পার্কিংয়ের ফি কত : পে–পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত জায়গাটিকে ‘ইয়েস পার্কিং’ নামে অবহিত করা হয়। প্রাথমিকভাবে প্রায় ৩০০টি গাড়ি রাখার জায়গা থাকবে এখানে। সেখানে যারা পার্কিং করবেন তাদের তিন চাকা (অটোরিকশা/সিএনজি ট্যাঙি ইত্যাদি) ও চার চাকার (প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মিনিবাস, জিপ, পিকআপ ইত্যাদি) গাড়ি রাখতে ঘণ্টায় ৩০ টাকা দিতে হবে। এসব গাড়ি সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত টানা রাখতে চাইলে দিতে হবে ২০০ টাকা। এছাড়া মোটরসাইকেল বা স্কুটি রাখতে ঘণ্টায় দিতে হবে ১৫ টাকা এবং সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাখলে দিতে হবে ১০০ টাকা।
চুক্তি অনুযায়ী, পার্কিংয়ের কার্যক্রম সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বুকিং চলমান থাকবে। বুকিং পরবর্তী সময়ের পরে অবস্থানকারী যানবাহনের নিরাপত্তা ও সেবাগ্রহীতা নির্ধারিত ফির দ্বিগুণ হারে প্রদান সাপেক্ষে পার্কিং ব্যবহার করবে।
চসিকের কেমন আয় হবে : চুক্তি অনুযায়ী পে–পার্কি থেকে যা আয় হবে তার ৩৫ শতাংশ পাবে চসিক। অর্জিত আয়ের হিসাব চসিক ও বি–ট্র্যাক সলিউশনস লিমিটেডের গঠিত আর্থিক পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে। এদিকে চসিকের ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পে–পার্কিং থেকে ৫০ লাখ টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
পাঁচ বছরের অপেক্ষার অবসান : ২০১৯ সালের ৫ মে সিডিএর ৪৩৫তম বোর্ড সভায় জিইসিতে ফ্লাইওভারের নিচে পার্কিংয়ের জন্য জায়গা ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের ২৮ থেকে ২৫ নম্বর পিলারের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা হোটেল দি পেনিনসুলাকে বরাদ্দ দেওয়া হবে, যা চসিকের আপত্তিতে বাস্তবায়ন করতে পারেনি সিডিএ। পরে একই বছরের ১ ডিসেম্বর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার চসিকের কাছে হস্তান্তর করে সিডিএ।
এরপর আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের নিচে পে–পার্কিং চালু করতে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি ট্রেড ম্যাঙ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে চসিক। একই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি এর অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ উদ্বোধনও করা হয়। কিন্ত পরদিন ১১ ফেব্রুয়ারি সিএমপি থেকে লিখিত আপত্তি দেওয়া হয়।
পরে রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নেওয়ার পর আবারও পে–পার্কিং চালুর উদ্যোগ নেন। ২০২২ সালের ২২ জুন অনুষ্ঠিত চসিকের ১৭তম সাধারণ সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তখনও সিএমপির আপত্তির কারণে পে–পার্কিং চালু করা সম্ভব হচ্ছিল না। পরে ২০২৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত চসিকের ৩২তম সাধারণ সভায় পে–পার্কিং চালু করতে অনুমতি না দেওয়ায় সিএমপির ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন মেয়র। এরপর ১ অক্টোবর সিএমপির একটি প্রতিনিধিদল মেয়রের সঙ্গে তার দপ্তরে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেখানে পে–পার্কিংয়ের বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়। এর প্রেক্ষিতে সিএমপিসহ সার্ভে করে স্থান নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া সমঝোতা চুক্তির আওতায় পরিচালিত পে–পার্কিং কার্যক্রম বাস্তবায়ন, তদারকি, পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের লক্ষ্যে গঠিত কারিগরি কমিটিতে সিএমপির প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।