আমার কলিজার টুকরো শাহেদের সৌদি আরবে যাওয়া হলো না। আর কোনোদিন যেতে পারবে না। এর আগেই আমাদের সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে। আর কোনদিন ফিরবে না। কোন দিন মা বলে ডাকবে না। ফোন করে কেমন আছি, ভাত খেয়েছি কিনা জিজ্ঞাসা করবে না। শহর থেকে এসে মা বলে জড়িয়ে ধরবে না। গতকাল শুক্রবার দুপুরে বিলাপ করে এসব কথা বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়া সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের মির্জারখীল কুতুব পাড়ার শাহাদাত হোসেন শাহেদের মা খুরশিদা বেগম। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে আবার বিলাপ শুরু। কান্না করতে করতে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। তার আহাজারিতে উপস্থিত সকলের চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। একেক জন একেক ভাবে তাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোনো সান্তনায় তার কান্না থামানো যাচ্ছিল না।
শাহাদাত হোসেন শাহেদের খালাতো ভাই একই ইউনিয়নের আছারতলীর মোজাহিদুল ইসলাম চোখ মুছতে মুছতে জানান, শাহেদের পরিবারে কোনো অভাব নাই। এলাকায় থাকলে খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে নষ্ট হওয়ার ভয়ে শহরে চাকরিতে দিয়েছিল। মাত্র কয়েক মাস আগে চাকরিতে গিয়েছে। শাহেদ সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বেঁচে থাকলে হয়তো কয়েক মাস পরে সৌদি আরবে চলে যেতো। এখন আর সৌদিয়া আরবে যাওয়া হলো না। তিনি জানান, আগুনের ধোঁয়া যখন তাদের বাসায় ঢুকে তখন শাহেদ তার দোকান মালিক ও সৌদি আরবে বড় ভাইকে ফোন করে জানায়। বাসায় ধোঁয়া প্রবেশ করার পর শাহেদ তার বন্ধু ইকবালসহ বাথরুমে ঢুকে পড়ে। কিন্তু চারদিকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ায় তারা সেখান থেকে আর বের হতে পারেনি। ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে বাথরুমেই তাদের মৃত্যু হয়।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ৩ জনই সাতকানিয়ার বাসিন্দা। নিহতরা হলো– সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের মির্জারখীল কুতুব পাড়ার সৈয়দ আহমদের পুত্র মো. ইসমাইল হোসেন ইকবাল, একই এলাকার ভেট্টা মিয়ার পুত্র শাহাদাত হোসেন শাহেদ ও এওচিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম গাটিয়াডেঙ্গা তাজর পাড়ার শামসুল আলমের পুত্র মো. রিদুয়ান। মো. ইসমাইল হোসেন ইকবাল জুতার হাট দোকানের কর্মচারী এবং শাহাদাত হোসেন শাহেদ ইমতিয়াজ টেলিকমের কর্মচারী।
অগ্নিকাণ্ডে ৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় পুরো এলাকা জুড়ে চলছে শোকের মাতম। নিহতদের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে এলাকার বাতাস। নিহত ইকবাল ও শাহেদ প্রতিবেশী এবং ঘনিষ্ট বন্ধু। ঘটনার দিন রাতে মো. ইসমাইল হোসেন ইকবাল নিজের বাসা ছেড়ে বন্ধু শাহেদ হোসেন শাহেদের বাসায় গিয়ে ঘুমিয়েছিল। রাতে এক সাথে ঘুমিয়ে পড়ে, বাথরুমে একসাথে ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা যায় এবং এলাকায় কবরস্থানে পাশাপাশি কবরে দুই বন্ধুকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
এদিকে, মো. ইসমাইল হোসেন ইকবালের বাবা সৈয়দ আহমদ ছেলেকে চিরনিদ্রায় শায়িত করার জন্য খোড়া কবরের পাশে দাঁড়িয়ে গতকাল দুপুরে জানান, দুই বছর আগে আমার স্ত্রী মারা যায়। মা মারা যাওয়ার পরপর ইকবাল চাকরিতে চলে যায়। কোরবানের সময় ছুটিতে এসেছিল। বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার থেকে ঘুরে এসে গত শনিবার চাকরিতে চলে যায়। চলে যাওয়ার সময় আমার সাথে দেখা হয়নি। পুরো সপ্তাহের মধ্যে ফোনেও কথা হয়নি। গতকাল গভীর রাতে জানতে পারলাম আমার ছেলে ইকবাল মারা গেছে।
সৈয়দ আহমদ আরো জানান, আমার ছেলে ওসমান সৌদি আরবে রয়েছে। তার সাথে কথা হয়েছিল ইকবালকে সৌদি আরবে পাঠানোর বিষয়ে। আমার ঘরের চারদিকের সব ঘর পাকা। শুধুমাত্র আমারটা ভাঙ্গা গুদাম ঘর। এজন্য ইকবাল বারবার বলতো– বাবা, আমাদের এই ভাঙ্গা গুদাম ঘরও একদিন পাকা হবে। আমি বিদেশ যাওয়ার পর প্রথমে ভাঙ্গা ঘর পাকা করবো। কিন্তু হলো না, ভাঙ্গা ঘর ভাঙ্গাই রয়ে গেলো। আর ইকবাল আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলো। চিরদিনের জন্যই চলে গেলো। আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। আমাকে বাবা বলে ডাকবে না। আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় স্ত্রী, মেয়ে ও ইকবালকে হারিয়েছি। আমি স্বজন হারানোর ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছি।
মো. ইসমাইল হোসেন ইকবালের দোকান মালিকের অন্য দোকানে কর্মরত কর্মচারী নাঈমুল ইসলাম নাঈম জানান, ইকবাল আর আমি একই মালিকের ভিন্ন ভিন্ন দোকানে চাকরি করি। রাতে একই বাসায় থাকি। ইকবাল খুব ভালো ছেলে। ঘটনার দিন রাতে সে আমাদের বাসা ছেড়ে তার বন্ধু শাহেদের বাসায় চলে যায়। ইকবাল আর শাহেদ একই বাসায় ছিল। একই সাথে মারা গেছে এবং পাশাপাশি কবরে দুইজনকে কবর দেয়া হয়েছে।