খাতুনগঞ্জে ব্যবসায় আস্থাহীনতা প্রকট হয়ে উঠছে। দিন দিন এই সংকট বাড়ছে। ২৬ জুন দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যবসা–বাণিজ্যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এলাচ বিক্রির ৫০ কোটি টাকা মেরে ব্যবসায়ী লাপাত্তা হওয়ার ঘটনার পর থেকে এ অবস্থা বিরাজ করছে। এলাচের পাওনাদাররা এখনো পথে পথে ঘুরছেন। এ অবস্থায় খাতুনগঞ্জে ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আস্থাহীনতা। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। দীর্ঘ বছর ধরে চলে আসা মৌখিক বিশ্বাসেও ফাটল ধরেছে। বিশ্বাসের লেনদেনে একের পর এক প্রতারণার ঘটনায় খাতুনগঞ্জের নিজস্ব বৈশিষ্ট হারাচ্ছে।
জানা গেছে, অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে ইতোমধ্যে অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। এছাড়া সংকীর্ণ সড়কে রাত–দিন যানজট লেগে থাকে। ফলে হেঁটে চলাফেরা করা দায়। চেক প্রতারণা এবং আরেকজনের টাকা মেরে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের বড় দারোগাহাটের ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেলের কারণে অনেক আমদানিকারক লাইটার জাহাজে করে নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে পণ্য আনলোড করছেন। কারণ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় কিংবা দেশের অন্য কোথাও পণ্য পরিবহনের একটি ট্রাকে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করা যায় না। অথচ একসময় খাতুনগঞ্জ থেকে সারা দেশে সিংহভাগ ভোগ্যপণ্য পরিবহন হতো।’
বলা অনাবশ্যক যে, চাকতাই–খাতুনগঞ্জ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ইতিহাসে ঐতিহ্যবাহী নাম। এই দুটি নাম যেমন অনন্য, তেমনি ঐতিহাসিকও। চট্টগ্রামের এই দুই বাণিজ্যিক এলাকার অবস্থান কাছাকাছি। পাশাপাশি উচ্চারিত হয় নাম দুটি। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পাইকারী বাজার। চট্টগ্রাম নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের আনাগোনায় প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এ দুটি বাজার। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য এসে জমা হয় এই বাজারের আড়তগুলোতে। কর্ণফুলী ও সমুদ্র বন্দরের কারণে দেশের সিংহভাগ আমদানি অর্থাৎ ৬০ থেকে ৮০% চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা করে থাকেন। এখানে খাতুনগঞ্জের ভূমিকা মুখ্য। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, প্রায় দেড়শ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ বাজারগুলোর সাথে দেশের অর্থনীতির প্রবাহ সমৃদ্ধি ও উন্নতির বিষয় ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এ বাজার দুটি মূলত দেশের সকল প্রকার খাদ্য–নিত্যপণ্যসহ মানুষের মৌলিক চাহিদার অধিকাংশই যোগান দিয়ে থাকে। এই বাজারের উপর নির্ভর করে দেশের পণ্যদাম, পণ্য সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ। এখান থেকেই তৈরি হয়েছে দেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সমাজপতির। চট্টগ্রামসহ দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বের বিশাল একটি অংশ এ খাতুনগঞ্জ–চাকতাই থেকেই উঠে এসেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে চাকতাই–খাতুনগঞ্জের সেই জৌলুস আর নেই। নানা রকম সংকটে জর্জরিত এ দুটি বাজার।
সরু সড়কে নিত্য যানজট, অবকাঠামোগত সমস্যা এবং চেক প্রতারণাসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীর টাকা মেরে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনার কারণে আস্থা নষ্ট হচ্ছে, বাড়ছে সন্দেহ। এসব সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে ইতোমধ্যে অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ চাকতাই খাতুনগঞ্জ থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। চাকতাই–খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিভিন্ন সমস্যার কারণে চাকতাই খাতুনগঞ্জে ব্যবসা কমে গেছে। এছাড়া শত শত বছর ধরে চলে আসা মৌখিক বিশ্বাসের ওপর লেনদেনের সংস্কৃতিতেও ধরেছে বড় ফাটল। অন্যদিকে বর্তমানে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের বড় দারোগা হাটের ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেলের কারণে অনেক আমদানিকারক নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ এবং যশোর নওয়াপাড়াতে পণ্য আনলোড করছেন। আগে এক সময় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি সব পণ্য চাকতাই খাতুনগঞ্জে আসতো। তারপর সেখান থেকে নৌপথে এবং সড়কপথে আশপাশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় যেত।
নানাবিধ সমস্যা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শত বছর ধরে চাকতাই খালের মাধ্যমে নৌ–পথে ব্যবসা–বাণিজ্য পরিচালনায় চাকতাই–খাতুনগঞ্জের গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রতিবছর পানিবদ্ধতায় ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থার অবসান জরুরি। চাকতাই খাল খননসহ ওই এলাকাকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তাঁরা বলেন, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ সরকারি বিনিয়োগের তিন গুণ যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে থাকে। তাই চাকতাই–খাতুনগঞ্জে ব্যবসা–বাণিজ্য নির্বিঘ্ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে ঐতিহ্যবাহী এই বাজারের।