মানুষ কর্মক্ষম থাকার একটা নির্দিষ্ট বয়স থাকে। সেটা প্রাপ্ত বয়স থেকে ষাট বছরের মতো। শারীরিক নানাবিধ অসুস্থতার কারণে এর তারতম্যও হতে পারে। এই বয়সটাতেই ব্যবসা–বাণিজ্য, চাকরি–বাকরি করে মোটামুটি চলা যায়। কিন্তু পড়ন্ত বয়সে মানুষের শরীরে শৈথিল্য নেমে আসে, আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসে শরীর। রথও চলে না তেমন। ন্যুব্জ হওয়া শরীরে বাসা বাঁধে রোগবালাই। একসময় অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাই দায় হয়ে উঠে। পরিবারের আর্থিক সংকট সবকিছুকে আরও দুর্বিষহ করে তুলত পারে। এই অবস্থায় দরকার আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তার অভাবে জীবনের শেষ বয়সে মানুষকে অন্যের গলগ্রহ হতে হয়। এমনকি আর্থিক টানাপোড়েনে নিজের সন্তানের কাছেও নিগ্রহ হতে হয়। এমনকি বৃদ্ধাশ্রমেও ঠাঁই হয় অনেকের। সরকারি চাকরিজীবীরা চাকরিশেষে আজীবন মাসিক পেনশন ভোগ করে থাকেন।
মূলত, বেতন থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কেটে রেখেই সরকার তার কর্মচারীদের এই পেনশন সুবিধা দিয়ে থাকে। এতেই একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী একটা সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার বলয়ে থাকেন। বেসরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, খেটে খাওয়া মানুষ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। জীবনের শেষ বেলায় তাঁরা নিজ পরিবার,আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের কাছে এক ধরনের বোঝা, এমনকি অপাঙক্তেয় হয়ে পড়েন। মানুষের এই দুরবস্থার কথা মাথায় রেখে সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে। যেখানে একজন নাগরিক সরকারি চাকরিজীবীর মতোই আজীবন পেনশন ভোগ করার সুযোগ পাবেন। দেশের সর্বস্তরের জনগণকে টেকসই পেনশন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে সরকার ৩১শে ডিসেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে আইন প্রণয়ন করে। যা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২৩ নামে অভিহিত।
উল্লেখ্য, আইনটি বিগত ২৪শে জানুয়ারি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় সংসদে পাস হয়। আইনে বলা আছে, ‘যেহেতু দেশের সর্বস্তরের জনগণের বিশেষ করিয়া গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতাভুক্ত করা প্রয়োজন; এবং যেহেতু ভবিষ্যতে কর্মক্ষম জনসংখ্যা হ্রাসের কারণে নির্ভরশীলতার হার বৃদ্ধি পাইবে; এবং যেহেতু সর্বজনীন পেনশন সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল’। নাগরিকের পেশা, আয় ইত্যাদি বিবেচনায় সরকার পেনসন স্কিমকে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা এই চার শ্রেণিতে ভাগ করেছে।
প্রবাস : বিদেশে কর্মরত বা অবস্থানরত লক্ষ লক্ষ রেমিট্যান্স যোদ্ধা এই স্কীমের আওতাভুক্ত হতে পারবেন। এতে নির্ধারিত অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় জমা দিয়ে এ স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে পাসপোর্ট নম্বর ব্যবহার করে এই স্কিমে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে। তাঁরা প্রগতি ও সুরক্ষা স্কিমে নিজের পরিবারের সদস্যদের নামেও নিবন্ধন করে বৈদেশিক মুদ্রায় জমা করতে পারবেন। এক্ষেত্রে তিনি যার জন্য পেনসন স্কিম পরিচালনা করবেন তাঁর এনআইডি, ব্যাংক হিসাব /বিকাশ/নগদ নম্বর এবং নামিনি’র তথ্য প্রদানপূর্বক নিবন্ধন করার সুযোগ আছে। মাসিক জমার পরিমাণ ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, প্রবাস থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রেরিত জমার ২.৫০ শতাংশ প্রণোদনাও পাওয়া যাবে। আর এই প্রণোদনার অর্থ তাঁর হিসাবে যোগ হবে। দেখা যায়, অনেকে জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশের মাটিতে কাটিয়ে একসময় দেশে ফিরে আসেন, নতুবা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতায় সর্বস্বান্ত হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন – তাঁদের জন্য এই পেনশন স্কিম এক সুবর্ণসুযোগ বলা যায়। তিনি বিদেশে কর্মরত থাকা অবস্থায় এই স্কীমের মাধ্যমে নিজের এবং পরিবারের জন্য এক আর্থিক নিরাপত্তা তৈরি করতে পারেন।
প্রগতি : বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোনো কর্মচারী বা উক্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক নির্ধারিত হারে চাঁদা প্রদানপূর্বক এই স্কিম্ব অংশগ্রহণ করতে পারবেন। প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্কিমে যোগ দিলে স্কিমের জমার ৫০ শতাংশ কর্মী এবং বাকি অংশ প্রতিষ্ঠান দিবে। মাসিক জমার পরিমাণ ২হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা।
সুরক্ষা : স্ব–কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি – কৃষক, রিক্সা চালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, গৃহিণী, তাঁতিসহ সব অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ নির্ধারিত হারে জমা প্রদান করে এই স্কিমে যুক্ত হতে পারেন। মাসিক জমার পরিমাণ ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা।
সমতা : দেশের দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী (যাঁদের আয়সীমা বাৎসরিক ৬০ হাজার টাকা) নাগরিকদের জন্য এ স্কিম। এ স্কিমে মাসিক জমার পরিমাণ ১ হাজার টাকা। তবে এক্ষেত্রে জমাকারী মাসিক জমা দেবেন ৫শ টাকা, বাকি ৫শ টাকা দিবে সরকার। তাৎপর্যপূর্ণ হলো, এ স্কিমে একজন নাগরিক ৫শ টাকা জমা দিয়েও ১হাজার টাকার সমান সুবিধা ভোগ করবেন। সর্বজনীন পেনশন স্কীমের আওতায় একজন নাগরিক জমাকৃত টাকার উপর কত লাভ করবেন? এর উত্তরে বলা যায়,১৮ বছর বয়সে একজন নাগরিক মাসিক ১হাজার টাকা জমা করলে তিনি ৬০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে ৩৪,৪৬৫টাকা পাবেন। এই টাকা তিনি পাবেন আমৃত্যু। পেনশন হোল্ডার মারা গেলে তাঁর নমিনী ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত এই সুবিধা ভোগ করবেন। সর্বনিম্ন ১০ বছর মাসিক চাঁদা জমা দিয়েও এই সুযোগ পাওয়া যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক